Logo

ইউক্রেন সংকট ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, মার্চ ১, ২০২২
  • শেয়ার করুন

ইউক্রেন বলতেই পর্যটকদের চোখে ভেসে ওঠে চোখ জুঁড়ানো পাহাড়, নদী অরন্য আর সমুদ্রের অনুপম দৃশ্যাবলী, অপরূপ হলুদাভ-সবুজ সূর্যমুখী ফুলের প্রান্তর, চমৎকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক ইমারতরাজি আর সুভাষিনী ও সৌর্ন্দয্যবতীদের এক দেশ। অবশ্য ইউক্রেনের আরেকটি ইমেজ হলো চেরনোবিল পরমানু কেন্দ্রের ভয়ংকার বিপর্যয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে বর্তমান চলমান যুদ্ধসহ হাজার বছরের অসংখ্য যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি। দ্বিতীয় ইমেজটাই যেন বর্তমানে বড় হয়ে উঠেছে। ইউক্রেন এখন যেন চেরনোবিলের মতো আরেক বিস্ফোরনের মুখোমুখি। বহুদিন পর ইউরোপ একটি ভয়াবহ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। টিভি খুললেই চোখে পড়ে ইউক্রেন সীমান্তে বরফ ঢাকা অঞ্চলে শত শত সাজোঁয়া যানে সৈন্যদের দ্রুত চলাচল। বিশাল ইউরেশিয়ার নিস্তব্ধতা যুদ্ধের দামামায় এখন মুখরিত। একটি জার্মান সংবাদ মাধ্যম গোয়েন্দা সূত্র উদ্ধৃত করে বলেছে, বুধবারই (১৬ ফেব্রুয়ারী) ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে রাশিয়া।

তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি দেশের নাগরিকদের শান্ত থেকে অযথা আতঙ্কিত না হওয়ার বার্তা দিয়েছেন।

পূর্ব ইউরোপে ও রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত প্রায় ৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ইউক্রেন বর্তমানে রাশিয়ার পরই ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ‘শস্যক্ষেত্র’ হিসেবে পরিচিত দেশটির বর্তমান জন সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৪০ লক্ষ। কৃষি, শিল্পে সমৃদ্ধি ও প্রচুর খনিজ সম্পদ থাকলেও দেশটি বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম দরিদ্র দেশ। পূর্বে অল্প কয়েক বছরের জন্য ইউক্রেন স্বাধীন ছিল। তবে ১৯৯১ সালেই প্রথমবারে মতো বর্তমান এলাকা নিয়ে স্বাধীন হয় ইউক্রেন।

ইউক্রেন ও সেখানকার নাগরিকেরা প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করলেও ভূ-রাজনৈতিক হিসেব নিকেশের কবলে পড়ে দেশটি। কমলা বিপ্লব (২০০৪) ও ময়দান বিপ্লব বা রেভলিউশন অব ডিগনিটিতে (২০১৩-২০১৪) ইউক্রেনিয়দের স্বাধীনতাচেতা, জাতীয়তাবাদী, আশা আকাংখা প্রতিফলিত হয়। এইসব বিপ্লবের পর জনগনের প্রবল আশা জাগে যে, এখন তারা রাশিয়ার আধিপত্যের বাইরে একটি গণতান্ত্রিক, আধুনিক, দূর্ণীতিমুক্ত, ও উদার দেশ গঠনের করতে পারবে। যা হবে ইউরোপ ও পশ্চিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ হওয়ার পর তাদের ভেতরকার জনগনের মধ্যে দুই ধরনের শিবির গড়ে ওঠে। রাশিয়ার লাগোয়া (পূর্বাঞ্চল) এলাকা বলে সেখানে অনেক জাতিগত রুশ (২২%) নাগরিকের বাস। সেই রুশ নাগরিকেরা সব সময় রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। অন্যদিকে জাতিগত ইউক্রেনিয়সহ বাকীরা ইউরোপসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। পশ্চিমপন্থিরা চেয়ে আসছে ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত (ইউ) হোক। একই সঙ্গে তারা ন্যাটোভূক্তও হোক। এই ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের যুক্ত হতে চাওয়াতেই রাশিয়ার আপত্তি এবং তখনই বিড়ম্বনা থেকে বিতন্ডার শুরু হয়।

রাশিয়া ও ইউক্রেনিয়ানদের মধ্যে রয়েছে যৌথ জাতীয় ইতিহাস, সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, ধর্মীয় ও ভাষাগত মিল। তবে কিছুক্ষেত্রে আবার ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভিন্নতাও ছিল। তবে পুতিনের দাবী রাশিয়া ও ইউক্রেন ‘একই জনগোষ্ঠি’ এবং উভয়েই রাশিয়ান সভ্যতার অংশ। রুশ প্রেসিডেন্টের এই দাবী নাকচ করে আসছে জাতীয়তাবাদী ইউক্রেনিয়নগন। উল্লেখ্য, জার ও স্তালিনের শাসনামলে রুশদের ব্যাপারে ইউক্রেনিয়দের তিক্ততা সৃষ্টি হয়। পুতিনের আধিপত্যবাদী মনোভাব ইউক্রেনবাসীর মনে ফিরিয়ে আনছে বৃহৎ প্রতিবেশীর হাতে লাঞ্চনার পুরোনা সব স্মৃতি। রাশিয়া ও ইউক্রেনের বর্তমান রাজনৈতিক-সামরিক সংঘাত আসলে দেশ দুটির পুরনো সাংস্কৃতিক দ্বন্দের নতুন প্রকাশ মাত্র। স্থানীয় সমাজের গভীরে থাকা এই বিভক্তি রুশ ও ইউক্রেন ভাষার ঐতিহাসিক দ্বন্দ থেকে। গত দু-তিন দশকে এই দ্বন্দ ক্রমে রাজনৈতিক চেহারা নিচ্ছিল। সবশেষ তা সামরিক রূপ নিয়েছে।

ইউক্রেনিয় অধিবাসীদের বড় একটি অংশ রাশিয়াকে খুব নেতিবাচক প্রতিবেশী হিসেবে দেখে। দিন দিন এর সংখ্যা বৃদ্ধিই পাচ্ছে। রুশ প্রচার মাধ্যমে এখনো তুমুল জাতীয়তাবাদী বিকার চলছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে। রুশ জাতীয়তাবাদের এই ক্রদ্ধ চেহারা ইউক্রেনবাসীকে আমেরিকা ও ইউরোপের দিকে ফিরতে বাধ্য করেছে।

এখানে উল্লেখ্য ইউক্রেনের নেতৃবৃন্দ অনেক বিষয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি। দেশের সকল জাতীগত গোষ্ঠীকে আস্থায় নিয়ে একসাথে চলার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো উদার, বিচক্ষণ ও বাস্তবতাবাদী নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে ইউক্রেনে। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ইউক্রেনের ইতিহাস থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রুশ সংস্কৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে বিভিন্ন পার্ক আর যাদুঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন উপকরন। এই ধরনের অতি জাতীয়তাবাদী কর্মকান্ড রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরো নষ্ট করছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে অস্ট্রিয়া ও ফিনল্যান্ড নিজেদের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যত সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে ন্যাটোতে যোগ দেয়নি। তারা মনে করেছিল, এ জোটে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রোধে পড়তে হবে। আজ ইউক্রেনকেও সেই রকম বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে।

ইউক্রেন হলো রাশিয়া ও ইউরোপের ন্যাটোভূক্ত দেশসমুহের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র। তাই রাশিয়া চেয়েছে ইউক্রেনে মস্কো-ঘেঁষা সরকার ক্ষমতায় থাকুক। মূলত সমস্যা শুরু হলো ২০১৪ সালে। ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি বড় ধরনের বানিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। সাধারন ইউক্রেনিয়নগন খুশী হলেও প্রেসিডেন্ট পুতিন এতে বিচলিত হন। কারন এই চুক্তি হয়ে গেলে ইউক্রেনের ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের (ইউ) সদস্য হওয়া সহজ হবে। ইইউ এর সদস্য হলে ইউক্রেন আবার ন্যাটোরও সদস্য হয়ে যাবে।

এই চিন্তা থেকেই ইয়ানুকোভিচ-সরকারের উপর পুতিন এমন চাপ দিলেন যে, ইউক্রেন ইইউ এর সেই আলোচনা থেকে বেরিয়ে গেলো। এত বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ইয়ানুকোভিচ নষ্ট করলেন কেন? এ প্রশ্ন থেকেই ইউক্রেনবাসী বিক্ষোভ করলে ২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচ সরকারের পতন হয়।

এরপর ইউক্রেনের ভেতরে যেসব এলাকায় জাতিগতভাবে রুশ লোকের বসত, সেখানে রাশিয়া ইউক্রেনের সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ উসকে দেয়। রুশ ভাষা-ভাষী বিদ্রোহীরা ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুতিন এই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে যে সেনাবাহিনী পাঠান, তারা ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে এবং পুতিন ক্রিমিয়াকে নিজস্ব ভূখন্ড বলে ঘোষনা করেন।

এই অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্য ঠেকাতে ন্যাটো ধীরে ধীরে সেনা মোতায়েন বাড়াতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর একের পর এক প্রাক্তন সোভিয়েত রিপাবলিকগুলো ন্যাটোতে যোগদান করে। পুতিন চান ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য হতে পারবে না। তিনি পশ্চিমাদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এ নিশ্চিয়তা চেয়েছিলেন যে, ন্যাটো আর এ অঞ্চল থেকে নতুন করে আর কোন দেশকে সদস্য করবে না। কিন্তু পশ্চিমারা তাতে রাজি হয়নি। পুতিন মনে করেছেন, পশ্চিমারা ন্যাটো বাহিনী দিয়ে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে ব্লাকমেইল করতে চাইছে। এ কারনে তিনি পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

ইউক্রেন ঘিরে প্রস্তুতি জোরদার করছে রাশিয়া। রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে গত বছরের ডিসেম্বর থেকেই লক্ষাধিক সৈন্য মোতায়েন করেছে। প্রতিবেশী বেলারুশের সঙ্গে গত ১০ ফেব্রুয়ারী যৌথ সামরিক মহড়ায় হাজারো রুশ সেনা অংশ নিয়েছে। “এক্সারসাইজ এলায়েড রিজোলভ-২০২২” নামের ১০ দিনের ওই মহড়ার পাশাপাশি দেশটি দখলকৃত ক্রিমিয়া ও পশ্চিমাঞ্চলে অতিরিক্ত সামরিক যান ও সম্মুখযোদ্ধা পাঠিয়েছে। বাস্তবে রাশিয়া জলে-স্থলে তিন দিক থেকে ইউক্রেনকে ঘিরে ফেলেছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন নেতৃত্বে ইউক্রেন ও পাশ্ববর্তী ন্যাটো দেশসমুহে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি গ্রহন করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিককে ইউক্রেন ছাড়ার আহবান জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রি অ্যান্টনি ব্লিংকেন গত ১১ ফেব্রুয়ারী বলেছেন, “রাশিয়া যে কোন সময় ইউক্রেনে হামলা চালাতে পারে”।

ইউক্রেনের জনগনের যুদ্ধের বিভীষিকা, দূর্গতি ও দুঃখ যেন শেষ হচ্ছে না। অবস্থানগত কারনে বিশেষত বিদেশী বাহিনীর আক্রমনের পথে অবস্থান থাকায় (উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি) হাজার বছর ধরে দেশটি বিদেশী বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। কখনো নিষ্ঠুর মঙ্গল বাহিনী, তাতার বাহিনী, কসাক বাহিনী, পোলিশ বাহিনী, অটোমান বাহিনী, জার্মান বাহিনী এবং রুশ বাহিনী। মধ্যযুগে হাজার হাজার ইউক্রেনিয় নরনারী দাস ব্যবসার ভয়াবহ শিকার হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইউক্রেনে সবচেয়ে বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। স্তালিনের কঠোর শাসনামলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষেও (হলোদোমোর) কয়েক লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরন করে। উল্লেখ্য, গত কয়েকশো বছরে রাশিয়ার উপর বিদেশী আক্রমন হয়েছে ইউক্রেন, বেলারুশ ও পোল্যান্ডের ভেতর দিয়ে অর্থাৎ ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়েই।

সম্ভাব্য রুশ আক্রমনের/আগ্রাসনের আলোকে ইউক্রেনীয় জনগন বিশেষত তরুণ সমাজ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশরক্ষায় অস্ত্র ধরছে সাধারণ মানুষ। হাজার হাজার সাধারন ইউুক্রেনিয় প্রশিক্ষন নিচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

নতুন স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের সংঘাতময় পরিস্থিতি বিশ্বকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত স্বার্থের যুদ্ধ ময়দানে পরিনত হয়েছে ইউক্রেন। গনমাধ্যমের প্রচার দেখে মনে হচ্ছে, এটা বুঝি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ। অথচ যুদ্ধের নির্মম স্বীকার হচ্ছে দেশটির সাধারন জনগন। রাশিয়া সহজে ইউক্রেন দখল করলে তার অর্থ হবে, এর প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্র আর নিরাপদ থাকবে না। আর সেটা বিশ্বব্যবস্থার জন্য কোন অবস্থাতেই শুভ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃহৎ শক্তি বা আঞ্চলিক শক্তি কতৃক প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ভৌগলিক অখন্ডতা ও স্বাধীনতা ব্যাপক হুমকিতে পড়বে। এমন ঘটনায় দক্ষিন এশিয়ার ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তা ও হুমকির মুখে পড়তে পারে। বিশেষত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশের সরকারের উচিত ইউক্রেন সংকটের গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করা, বিশ্লেষন করা। ইউক্রেনিয় সংকট থেকে শিক্ষাগ্রহন করতে পারে বাংলাদেশ।

বিশ্ব ব্যবস্থায় একটা নীতি আছে। কোন দেশের আরেক দেশে আগ্রাসন চালানোর অনুমতি নেই। জোর কের সীমানা বদলেরও সুযোগ নেই। ন্যায্যতার প্রশ্নের চেয়েও বড় এই নীতি।

রাশিয়া বা রাশিয়ান ফেডারেশন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অসাধারন ভূমিকা পালন করেছিল। এজন্য বাংলাদেশ রাশিয়ার কাছে কৃতজ্ঞ। ১৯৭২ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের ভেতর দিয়ে সোভিয়েতি ইউনিয়ন-বাংলাদেশ সম্পর্ক শীর্ষে পৌছেছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর বাংলাদেশ রাশিয়ান ফেডারেশনকে এর উত্তরসূরি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখে।

পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকে, পশ্চিমা পুজিবাদী শক্তিসমুহের বিপরিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তৃতীয় বিশ্বের অনেক মানুষের আদর্শিক দেশ, বিপ্লবের দেশ, বিশেষত সমাজতন্ত্রীদের কাছে স্বপ্নের দেশ। গত ২৫ জানুয়ারী ছিল রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ তম বার্ষিকী। ঐ দিনটিই ছিল ইউক্রেন সীমান্তে সবচেয়ে উত্তেজনাময় একটি দিন। এক সময়ের বিপ্লবের দেশ, স্বপ্নের দেশ রাশিয়া এখন ইউক্রেনবাসীদের কাছে রীতিমত আগ্রাসী শক্তিতে পরিনত হয়েছে। রুশ আক্রমন ঠেকাতে ইউক্রেনের সাধারন নাগরিকগনও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতা এভাবেই পরিবর্তিত হয়ে যায়।

ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন ইস্যুতে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে কাউকে সমর্থন দিতে চায় না বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন “আমরা যে কোন সংঘাতের বিরোধী। আমরা চাই না আমাদের এমন একটি অবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হোক, যেখানে বন্ধুদের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে”।

এখানে উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দখল এবং ক্রিমিয়ার সংযুক্তিকে অবৈধ ঘোষনা করা হয় এবং জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নিন্দিত হয়। মাত্র ১১টি দেশ ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত ছিল।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেনবাসীর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মায়াকান্না এবং দরদ মুলত রাশিয়াকে রুখতে। এর আগে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাতে আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়া আক্রমনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি চরমভাবে কলঙ্কিত হয়েছে । ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করার অতি উৎসাহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষত মিনস্ক চুক্তি না মানতে ওয়াশিংটনের উস্কানি আছে বলে অভিযোগও আছে। তাই বর্তমান ইউক্রেন পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দায়ও কম নয়।

ইউক্রেন নিয়ে নয়া বিশ্বযুদ্ধের ঝুকিঁও আছে। ইউক্রেন এখন রুশ আগ্রাসনের মুখে। অথচ আশ্চর্য বিষয় হলো দেশে বিদেশে নাগরিক সমাজ এই বিষয়ে নির্লিপ্ত। কোথাও নেই যুদ্ধের প্রতিবাদ। অন্যের বিপদে সরব না হলে নিজের বিপদেও কিন্তু কেউ এগিয়ে আসবে না। অবশ্য এমন আলোচনাও আছে যে, পশ্চিমা গনমাধ্যম ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে অতিপ্রচার চালাচ্ছে।

২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। সেটা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো তখন নিন্দা জানানো এবং অবরোধের বেশী কিছু করেনি। বিনা বাঁধায় ক্রিমিয়া দখল করে ফেলতে পারা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে আরও আগ্রাসী করে তুলেছে। এটাই হওয়ার কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেও ঠিক একই পরিস্থিতি ছিল। ইতিহাস বলে, অনেক জার্মান ভাষাভাষী আছে, এই মুক্তিতে, হিটলার চেকস্লোভাকিয়ার একটা অংশ দখল করে। এরপর পুরো চোকোস্লাভাকিয়া। তারপর পোল্যান্ড।
বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো পুতিন কি সত্যিই ইউক্রেন আক্রমন করবেন? ১৯৯০ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। সে সময় ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত সংলগ্ন ইরাকের দক্ষিন সীমান্তে বড় আকারের সামরিক সমাবেশ করেছিলো। এখনকার মতো সে সময়েও সাদ্দাম হোসেনের উদ্দেশ্য কি ছিল তা নিয়ে ধোঁয়াসা তৈরী হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এখন ইউক্রেন আক্রমনের দিনক্ষন নির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে। রাশিয়া অবশ্য আক্রমনের কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যে, রাশিয়া সর্বাত্বক আক্রমনের পরিবর্তে ছোট পরিসরে আগ্রাসন বা ছোট খাট আক্রমন পরিচালনা করতে পারে। তবে এই প্রশ্নের উত্তর বিশ্বের একজনই জানেন- প্রেসিডেন্ট পুতিন।

ইউক্রেন আক্রান্ত হলে শুধু ইউক্রেনই ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। খোদ রাশিয়ার পরিনতিও ভয়ংকর হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ বিশেষতে আন্তর্জাতিক আর্থিক বার্তা লেনদেন সার্ভিস সুইফট থেকে রাশিয়াকে দুরে রাখলে দেশটির অর্থনীতি চরম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। রাশিয়ার যুদ্ধ প্রবীন (ভ্যাটরান) একজন জেনারেল পুতিনকে স্মরন করিয়ে দিয়েছেন- “সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার অন্যতম কারন ছিল আফগানিস্তানের যুদ্ধ”। ইউক্রেনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ জড়ালে, পুনরায় শক্তিশালী অবস্থানে আসা বর্তমান রাশিয়া বিপর্যয় এড়াতে পারবে না। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের পরিনামে সুপার পাওয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি এখন ভাঁটার টানে প্রবাহিত দিকে। ইউক্রেনের যুদ্ধের ঢেউ নিপার আর ভলগা নদীতেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে না। একসময় পদ্মা, মেঘনা, মধুমতীতেও সেই ঢেউ এসে পড়বে।

সাম্প্রতিককালের ইউক্রেনের যুদ্ধের ঘটনায়, সামরিক ইতিহাসের ছাত্রদের ইউক্রেন, ক্রিমিয়া নিয়ে আলোচিত যুদ্ধগুলোর কথা আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বিখ্যাত ক্রিমিয়া সমরাভিয়ানে (১৮৫৪-৫৫) রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে (বালাক্লাভা যুদ্ধ) যুদ্ধরত একটি বৃটিশ বাহিনীর আক্রমনের উপর ভিত্তি করে কবি আলফ্রেড লর্ড টেনিসন লিখেছিলেন তার অমর কবিতা- “দি চার্জ অব লাইট বিগ্রেড”। ক্রিমিয়া সমরাভিযানে সেভাস্তোপল যুদ্ধে (সেভাস্তোপল অবরোধ) অন্য পক্ষ অর্থাৎ রুশ সেনাবাহিনীতে তরুন গোলন্দাজ অফিসার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাসিক লিও টলস্টয়। যুদ্ধের ভয়াবহতা, রক্তপাত, নৃশংসতা ও অসারতা ফুটে উঠেছে তার অনবদ্য গ্রন্থ ‘সেভাস্তোপল স্বেচেস’ এ।

২০১৮ সালের গ্রীস্মে, ভিয়েনা থেকে ঝর্টিকা সফরে এসেছিলাম ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দেশ স্লোভাকিয়ার রাজধানী বাতাস্লাভায়। দানিয়ুব নদীর তীরে সেই নগরীর এক কফি শপে একদল ইউক্রেনীয় তরুন তরুনীর সঙ্গে অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ ঘটেছিলো। তাদের সঙ্গে স্বল্পকালীন আড্ডায় মনে হয়েছিল- পশ্চিম-মুগ্ধ জাতীয়তাবাদী এই তরুণরা রুশ আধিপত্যের বাইরে এক উন্নত ইউক্রেনের স্বপ্ন দেখে। বাসে ভিয়েনা ফেরার পথে, মোৎজার্ট এর সুরে মগ্ন আমি, কিছুক্ষন আগে দেখা হওয়া ইউক্রেনীয় তরুনদের স্বপ্নের কথা ভাবতে থাকি …..। ইউক্রেনের সামনে এখন এক মহা বিপদ। তিন দিকে লক্ষাধিক রুশ সৈন্য ঘিরে ফেলায়, কি মারাত্বক উৎকন্ঠার ও দুঃশ্চিন্তার মধ্যেই না তারা দিন কাটাচ্ছে। সেই তরুনদের অনেকেই হয়তো দেশরক্ষায় হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এই যুদ্ধ কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।রাশিয়ার পরিবারগুলো নিশ্চিত, তাদের সৈন্যদের কামানের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইউক্রেন সমস্যার সমাধান সম্ভব। “ন্যাটোকে ইউক্রেনের সদস্যপদ দেওযার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখতে হবে। যে কোন আগ্রাসী সিদ্ধান্ত থেকে রাশিয়াকে সরে আসতে হবে। বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার নীতির আলোকে ইউক্রেনকে মুক্তভাবে বানিজ্য করার সুযোগ দিতে হবে। একে অন্যের বৈধ নিরাপত্তার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে”। এমন সমাধানের কথা বলেছেন অধ্যাপক জেফরি ডি স্যাক্স।

ইউক্রেন সংকট সমাধানে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এই তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার কথা বলছে ইউক্রেন। তারা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দেশটির সঙ্গে আলোচনাও চেয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে না জড়াতে প্রয়োজনে ন্যাটোয় যোগদান থেকে বিরত থাকবে ইউক্রেন। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ভাদিম প্রিস্তাইকো এ কথা বলেছেন। যুদ্ধ নয় আলোচনার মাধ্যমেই দুই “স্লাভিক ব্রাদারের” সমস্যার সমাধান হোক। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। প্রচন্ড শীত আর করোনা মহামারীকালে শান্তি নামুক ইউক্রেন সীমান্তে।

লেখক: গবেষক, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ।
bayezidsarwar792@gmail.com