Logo

করোনায় নারীর ঘরের জ্বালা

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, মার্চ ৩১, ২০২০
  • শেয়ার করুন

অনিন্দ্যবাংলা ডেস্ক: করোনায় ঘরবন্দী জীবন নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ছবি: রয়টার্সবিশ্বের অনেক দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউন চলছে। সাধারণ মানুষের অবাধ বিচরণ গুটিয়ে গেছে ঘরে। ঘরবন্দী জীবন নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাঁদের নিয়ে সতর্কতা জারি করেছে জাতিসংঘ ও নারী নির্যাতন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো।

লকডাউন যে নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে, এর প্রমাণ পরিসংখ্যানে। যুক্তরাজ্যে সরকারি হটলাইনে নির্যাতনের শিকার নারীদের ফোন ৬৫ ভাগ বেড়েছে। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের গৃহনিপীড়ন–বিষয়ক কমিশনার এমন তথ্য দিয়েছেন। জাতিসংঘ বলছে, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ঘরে যাঁরা নিপীড়নের শিকার হন, তাঁদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নির্যাতনের শিকার এমন দুই নারীর কথা। লকডাউন তাঁদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ।

ভারতের এমন একজন নারী গীতা। করোনাভাইরাস রোধে ভারত সরকার ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণার আগের দিন বিবিসির সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

গীতা রোজ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। এ সময় তাঁর স্বামী পাশেই অঘোর ঘুমিয়ে থাকেন। প্রচণ্ড জোরে তাঁর নাকডাকা চলে। আগের রাতে মাতাল হয়ে ফেরেন স্বামী। করোনা কারণে খুব অল্প মানুষ গণপরিবহনে চড়ছেন। এ কারণে অটো বা রিকশাচালকদের দুরবস্থা চলছে। গীতার স্বামী বিজয় দিনে ১ হাজার ৫০০ রুপি আয় করতেন, তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৭০০ রুপিতে। এ কারণে তিনি বড়ই হতাশ। রাতে বাড়িতে ফিরেই বিজয় মদের বোতল ছুড়ে মারেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘এভাবে আর কত দিন?’

বাবার এই হিংস্র রূপ দেখে গীতার সন্তানেরা তাঁর পেছনে গিয়ে লুকায়। বিজয় এরপর মেঝেতে পেতে রাখা তোষকে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

বিবিসিকে গীতা বলেন, ‘সন্তানদের শান্ত করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগে। প্রায়ই তাঁদের বাবার এমন প্রচণ্ড রাগ দেখে থাকে। তবে গত কয়েক সপ্তাহে পরিস্থিতি বেশি খারাপ। সন্তানেরা দেখছে, বাবা সংসারের সব জিনিসপত্র ছুড়ে মেরে ভেঙে ফেলছে। চুলের মুঠি ধরে আমাকে মারছে।’

স্বামীর হাতে গীতার এমন মার খাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। সবটা এখন আর গীতার মনেও পড়ে না। প্রথম মার খেয়েছিলেন বাসররাতে। গীতা স্বামীকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী তাঁকে সন্তানদের নিতে দেয়নি।

গীতা ও তাঁর পরিবার গ্রামের দরিদ্র একটি এলাকায় বসবাস করেন। গরমের দিনে গীতা এক কিলোমিটার হেঁটে কুয়া থেকে পানি নিয়ে আসেন। পানি এনে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করেন গীতা। সবজি কেনার জন্য তাঁদের ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করেন। এরপর গীতা পরিবারের জন্য রান্না শুরু করেন। তাঁর স্বামী সকাল সাতটায় বেরিয়ে যান। দুপুরের খাওয়ার সময় বাড়িতে এসে বিশ্রাম নেন। দুই সন্তান স্কুল থেকে ফেরার পর আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ১৪ মার্চ স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায়। সন্তানেরা ঘুমানোর সময় বাবাকে বিরক্ত করতে থাকে। আর বিজয় রেগে গিয়ে সন্তানদের মারধর করতে থাকেন।

গীতা চুপিচুপি স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। যখন তাঁর স্বামী কাজে থাকেন, গীতা ঘরের কাজ শেষে কাছের একটি অফিসে যেতেন। সেখানে তিনি সেলাই ও লেখাপড়ার কাজ শিখতেন। গীতা স্বনির্ভর হতে চেয়েছিলেন। ওই ক্লাসেই তিনি কাউন্সিলরদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁরা গৃহে নির্যাতনের শিকারদের সাহায্য করতেন।

তবে লকডাউনের পর সবকিছু থমকে গেছে। ক্লাস বন্ধ। কমিউনিটি কাউন্সিলরদের কাছে আর যাওয়া যাচ্ছে না।

যোধপুরের সামবালি ট্রাস্টের স্বেচ্ছাসেবী বিমলেশ সোলাঙ্কি। এই ট্রাস্ট নারীদের সহায়তা দেয়। তাঁর মতে, করোনাভাইরাস নারীদের বিপদে ফেলেছে।

ভারতের গীতার পরে এবার আসা যাক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাসিন্দা কাইয়ের কথায়। দুই সপ্তাহ আগে কাই ভেবেছিলেন, করোনাভাইরাসের প্রকোপ অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। যে দোকানে তাঁর মা কাজ করতেন, সে দোকানের কর্মীরা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন।

নিউইয়র্কে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে শুনে সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। দোকানটি কিছুদিনের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কাইয়ের মায়ের চাকরি চলে যায়। তাঁকে কেবল পাঁচ দিনের স্বাস্থ্য ইনস্যুরেন্স দেওয়া হয়। কাইয়ের মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তিনি কাইকে তাঁর বাবার কাছে চলে যেতে বলেন। বাবার কাছে থাকার অভিজ্ঞতা কাইয়ের আছে। বছরের পর বছর বাবা তাঁকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করেছেন। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতি পার হয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার জন্য থেরাপি নিতে হচ্ছে কাইকে। কিন্তু আবার কি তাঁকে বাবার কাছেই ফিরতে হবে? থেরাপি নিয়ে কাই মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে থেরাপি কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের আর্থিক দৈন্যদশার কারণে কাইকে গত সপ্তাহে বাবার কাছে ফিরতে হয়।

বিবিসিকে কাই বলেন, যৌন নিপীড়নকারী বাবা তাঁর সঙ্গেই আছেন। রাতে কাই তাঁর বাবাকে পর্নো দেখতে দেখেছেন। কাই ভয়ে ঘুমাতে পারেননি। তিনি যে ঘরে আছেন, সে ঘরে দরজা বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থাও নেই। কাই যখনই বাবার অবাধ্য হন, তখনই তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এ কারণে কাই বেশির ভাগ সময় ঘরেই থাকেন। কাই বেশির ভাগ সময় অনলাইনে সময় কাটান। ইউটিউবে ভিডিও দেখেন। সিনেমা দেখেন। কাই আশা করেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে গেলে তাঁর মা এসে তাঁকে নিয়ে যাবেন।

জাতিসংঘের নারীবিষয়ক কর্মসূচির (ইউএন উইমেন) নির্বাহী পরিচালক ফুমজিলে মালামবো নাজকুকা বিবিসিকে বলেন, ‘নিপীড়িত ও ভাসমান নারীদের নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সুরক্ষা পোশাক দেওয়া খুবই জরুরি। মাঠকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাকের জন্য আমাদের তহবিল প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে হটলাইনে ফোন আসা বেড়ে গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। উদাহরণ হিসেবে তিনি ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় পশ্চিম আফ্রিকায় নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন।