Logo

দেশে ‍স্যার বিভ্রাট ! কর্মকর্তাকে স্যার বললেন নাতো, মরলেন !!!

অনিন্দ্য বাংলা
সোমবার, মে ১০, ২০২১
  • শেয়ার করুন

দেশে ‍স্যার বিভ্রাট ! কর্মকর্তাকে স্যার বললেন নাতো, মরলেন !!!

মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু

দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের স্যার না বলায় লাঞ্চিত হয়েছেন এক ডজনেরও বেশী সাধারণ জনগণ, সাংবাদিক ও নানান পেশার মানুষ। গত দিনে এমন বেশ কিছু সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। শুধু স্যার বলে সম্বোধন না করার কারণে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী কতৃক লাঞ্চনার ঘটনা সুধি মহলে শুধু সমালোচনাই নয় পাশাপাশি উদ্বেগ ও আতংক তৈরী করেছে।
সরকারী কর্মকর্তাকে স্যার না ডাকায় যেসব লাঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে-
১. বিদ্যুতের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেনের হুংকার ‘আমাকে স্যার সম্বোধন করে কথা বলুন, আমি ডিসির সমমান’
‘আমার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন, আমি ডিসির সমমান পদমর্যাদায় আছি। আমি ২০তম বিসিএসে ক্যাডার হিসেবে যোগদান করার পর ৫ম গ্রেডে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছি। আমাকে আগে স্যার বলে সম্মোধন করে পরে কথা বলুন’ বলেই ফোন কেটে দেন ত্রিশাল বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন। দৈনিক সমকাল প্রতিনিধি মতিউর রহমান সেলিম নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেনকে ফোন দিলে তিনি এমন দাপুটে কথা বলেন। ২৯ অক্টোবর, ২০২০, দৈনিক কালের কন্ঠ
২. ম্যাডাম না বলায় উত্তেজিত উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম।
ম্যাডাম না বলায় স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর ওপর চটে গেলেন পাবনার বেড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম। উত্তেজিত হয়ে এ সময় সাংবাদিককে বলেন, আপনি কতদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। আপনি জানেন না একজন ইউএনওকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হয়। আমাদের চাকরিতে নিয়ম-কানুন আছে। অবশ্যই আমাকে স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতে হবে। অন্য কারোর সঙ্গে আমাকে বিবেচনা করা যাবে না।
এদিকে, বেড়ায় কর্মরত একাধিক সাংবাদিক জানান, সম্প্রতি জাতীয় দৈনিক বাংলা খবর প্রতিদিনের সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা খানমকে আপা বলায় চরম ক্ষিপ্ত হয়ে আশালীন আচরণ করেন। ১০ জানুয়ারি ২০১৮, জাগো নিউজ
৩. ‘দিদি’ ডাকায় লাথি দিয়ে দোকানির মাছ ড্রেনে ফেলে দিলেন এসিল্যান্ড
‘দিদি’ ডাকায় লাথি দিয়ে মাছ বিক্রেতার মাছ ড্রেনে ফেলে দিলেন সহকারি কমিশনার (ভূমি)। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ মে (রোববার) সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে। এসিল্যান্ডের এমন কাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে।
সূত্র জানায়, সকাল বেলা এসিল্যান্ড কার্যালয়ের গেটের পাশে বসে মাছ বিক্রি করছিলেন কয়েকজন মাছ বিক্রেতা। এ সময় গাড়ি নিয়ে অফিসে প্রবেশ করছিলেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকার।
অফিসের প্রবেশ পথে গাড়ি থামিয়ে দেন সঞ্চিতা কর্মকার। গাড়ির ভেতরে বসেই এক ব্যবসায়ীকে মাছের ঝুড়ি সরাতে বলেন। এ সময় লায়েক আহমেদ নামের এক মাছ ব্যবসায়ী বলেন, ‌‌দিদি সরিয়ে নিচ্ছি।
আর এ কথা শোনার পরেই ক্ষেপে যান এসিল্যান্ড সঞ্চিতা কর্মকার। গাড়ি থেকে নেমে বলেন, ‘আমি কিসের দিদি! এর পরই লাথি দিয়ে লায়েক আহমেদ ও তার সঙ্গী হাসান মিয়ার মাছের ঝুড়ি পাশের ড্রেনে ফেলে দেন।
সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন আচরণে লায়েক মিয়াসহ অন্যান্য মাছ ব্যবসায়ীরা হতভম্ব হয়ে যান।
এসিল্যান্ডের এমন আচরণে উপজেলাজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে লাথি দিয়ে মাছ বিক্রেতার মাছ ফেলে দেয়া স্বীকার করেছেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকার।
এরপর স্থানীয়দের তুমুল সমালোচনার পর সঞ্চিতা কর্মকার বলেন, ‘সেদিন কোনোভাবেই আমি তাদের সরাতে না পেরে বেশ রেগে গিয়েছিলাম। তখনই লাথি দিয়ে মাছ ফেলে দিই। ’
বিষয়টি ঠিক হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এজন্য আমি তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে রাজি আছি।
১৭ মে ২০১৯, দৈনিক যুগান্তর
৪. ম্যানেজারকে ‘স্যার’ না বলে ভাই বলায়, গ্রাহককে গলা ধাক্কা
ঢাকার ধামরাই বাজার শাখার কৃষি ব্যাংক কার্যালয়ে ম্যানেজারকে ‘স্যার’ না বলায় এক সেবা গ্রহীতার সাথে দুর্ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আজ রবিবার সকালে এ ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে ব্যাংকের অন্যান্য গ্রাহকরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ভুক্তভোগী গ্রাহক উপজেলার নান্নার গ্রামের ইছামুদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন বলেন, রবিবার সকালে ধামরাই বাজার কৃষি ব্যাংক শাখায় যান তিনি। তিনি ব্যাংক ম্যানেজার সোহরাব জাকিরের কক্ষে গিয়ে তার কাছে জানতে চান- একটি গবাদিপশুর খামারের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে কি কি কাগজপত্রাদি লাগবে। এ সময় জাকির হোসেন ব্যাংক ম্যানেজার সোহরাব জাকিরকে দুইবার ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। আর এতে সোহরাব জাকির ক্ষিপ্ত হয়ে জাকিরের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন। এতে ম্যানেজারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয় জাকিরের। এক পর্যায়ে জাকিরকে ব্যাংক থেকে বের করে দেন ম্যানেজার।
৫. টাঙ্গাইলের ঘাটাইালে ‘স্যার’ না বলায় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষেপে গেলেন চিকিৎসক
টাঙ্গাইলের ঘাটাইালে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় সংবাদকর্মীদের ওপর এক চিকিৎসক ক্ষিপ্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সোমবার ঘাটাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ ঘটনা ঘটে।
করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না, এ ধরনের অভিযোগসহ নানা অভিযোগ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে যান সংবাদকর্মীরা। এ সময় মেডিকেল অফিসার ডা. শুভময় পাল তার কক্ষে তাদের ডেকে নেন।
সংবাদকর্মীদের অভিযোগ, ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় ক্ষিপ্ত হন তিনি। এ সময় সাংবাদিকদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অশালীন মন্তব্যও করেন এই চিকিৎসক।
সংবাদকর্মী সৈয়দ মিঠুন বলেন, হাসপাতালে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছেনা- এমন খবর পেয়ে আমরা সংবাদ সংগ্রহ করতে যাই। এক পর্যায়ে আমাদের ডা.শুভময় পাল তার কক্ষে ডেকে নেন। কথা বলার সময় তাকে ভাই বলে সম্বোধন করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন ‘কিসের ভাই? আপনি আমাকে ভাই বলেন কেন? আমাকে স্যার বলতে হবে। প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় তা জানেন না? কত সাংবাদিক দেখলাম! যান যান এখান থেকে চলে যান।’ পরে অপমান করে তার কক্ষ থেকে বের করে দেন।
বিষয়টি নিয়ে ডা.শুভময় পালের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন, আমি একজন মেডিকেল অফিসার ডাক্তার, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, আমাকে কেন তারা ভাই বলবে? আমাকে স্যার বলতে হবে।
২৭ এপ্রিল ২০২১, সমকাল
৬. ‘ভাই’ সম্বোধনে সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপলেন দিরাই দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফি উল্লাহ।
একটি সংবাদের প্রয়োজনীয় তথ্য নেয়া শেষে কল কেটে দেয়ার সময় ‘স্যার’ না ডেকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় স্থানীয় এক সাংবাদিকের উপর বেজায় ক্ষেপেছেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের দায়িত্বরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফি উল্লাহ।
দিরাই উপজেলায় পরিবেশ ও হাওর ধ্বংসকারী প্লাস্টিকের ছাই দীর্ঘদিন ধরে অবাধে তৈরি করা হচ্ছে; এ বিষয়ে ইউএনও শফি উল্লাকে ফোন দেন স্থানীয় এক সাংবাদিক। পরিচয় দিয়ে বক্তব্য নিয়ে আসার পর ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ধন্যবাদ ভাই’ বলে সাংবাদিক ফোন রাখেন। পরে দু’মিনিটের মধ্যেই ৩টা ৪৮ মিনিটে (01730-331113) ফোন ব্যাক করে ইউএনও শফি উল্লাহ জিজ্ঞাসা করেন- ‘আপনি কোন পত্রিকায় কাজ করেন? ইউএনও-কে ভাই ডাকতেছেন কেন?’ পরবর্তীতে ক্ষেপে গিয়ে শফি উল্লা আবারও বলেন, ‘ইউএনওকে ভাই ডাকা যাবে না।’
তখন ওই প্রতিবেদক বলেন, ‘আমরা তো ডিসি সাহেবকেও শ্রদ্ধা রেখেই ভাই বলে সম্বোধন করি।’ তখন ইউএনও শফি উল্লা বলেন, ‘ডিসি সাহেবকে ডাকছেন- ডাকেন। কিন্তু আমাকে ভাই ডাকা যাবে না।’
এ ব্যাপারে ইউএনও শফি উল্লা’র সাথে রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি স্বীকার করে বলেন- ‘হয়তো এভাবে স্যার ডাকতে বলাটা ঠিক হয়নি। তবে তিনি (সাংবাদিক) তো আমার আত্মীয়ও না, পরিচিতও না। তাহলে ভাই ডাকবে কেন?’ এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আহাদ বলেন- এটা সম্পর্কের ব্যাপার। আমি তো সাংবাদিকদের সহকর্মীই মনে করি। আমরা তো কাউকে বলতে পারি না যে- আমাকে স্যার ডাকেন। এটা নিয়মের মধ্যেও পড়ে না। যাই হোক আমি বিষয়টা দেখছি’।
৭ অক্টোবর ২০২০, একুশে টেলিভিশন
৭. স্যার সম্বোধন না করায় সাংবাদিকের ৫ হাজার টাকা জরিমানা!
স্যার বলে সম্বোধন না করায় প্রতিদিনের সংবাদ-এর কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি আকিব হৃদয়কে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সোমবার দুপুরে কিশোরগঞ্জ সার্কিট হাউজের সামনে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা জুলহাস হোসেন সৌরভ। এসময় তার সাথে ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুর রহমান সাহেল, নেজারত ডেপুটি কালেক্টর মাহমুদুল হাসান, মো. ইব্রাহিম। এর আগে সাংবাদিক আকিব হৃদয়কে তারা আটক করে পুলিশের গাড়িতে করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে সেখানে একটি রুমে আবদ্ধ করা হয় এবং গালাগালি ও খারাপ আচরণ করা হয়।
এ বিষয়ে সাংবাদিক আকিব হৃদয় বলেন, আমাকে তারা থামার জন্য সিগন্যাল দিলে আমি থেমেছি এবং বলেছি ভাই, কেমন আছেন? আমি কেন ভাই বললাম তাই তারা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।
এসয় তারা আমাকে বলেন- আপনি সাংবাদিক তাই আপনাকে বেশি করলাম। ভবিষ্যতে আমাদেরকে স্যার বলবেন! এই বলে আমার হাতে সড়ক আইন-২০১৮ এর একটি ভাউচার ধরিয়ে দেয়া হয়।
এবিষয়ে জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা জুলহাস হোসেন সৌরভ বলেন, তার গাড়ির লাইসেন্স ছিল না, তাই সড়ক আইন-২০১৮ এর ৬৬ ধারায় ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০, দৈনিক সমসাময়িক
৮. ইউএনওকে ‘স্যার’ না বলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেন ওসি
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেছেন নেত্রকোনা জেলা কলমাকান্দা থানার অফিস ইনচার্জ মাজহারুল ইসলাম। তিনি এসময় ওই শিক্ষার্থীকে ‘ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট হলো মাইগ্যা ডিপার্টমেন্ট, এখানে তো মাইগ্যারা পড়ে’ বলে মন্তব্য করেন। বুধবার বিকালে কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরবাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, ভবানীপুর এলাকার দুই বাড়িতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকজন আসায় এলাকায় ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছিলো। এরপর এলাকা লকডাউন করার জন্য এলাকার লোকজন চেয়ারম্যানসহ নাজিরবাজার এলাকায় ইউএনও’র কাছে অনুরোধ করেন। এসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী ইউএনও-কে স্যার না বলায় তার উপর চড়াও হন কলমাকান্দা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম। তিনি এসময় ওই শিক্ষার্থীকে জেরা করেন। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীর বিভাগ ‘ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট হলো মাইগ্যা ডিপার্টমেন্ট, এখানে তো মাইগ্যারা পড়ে’ বলে মন্তব্য করেন।
এছাড়া অকথ্য ভাষায় ডিপার্টমেন্ট নিয়ে গালিগালাজ করে। ওসি আরও বলেন, আর বেডা একটা বিসিএস ক্যাডারের সাথে কেমনে কথা কইতে হয় জানস না?
১৬ এপ্রিল, ২০২০, দৈনিক কালের কন্ঠ
৮. ‘স্যার’ না বলায় ক্ষুব্ধ সিভিল সার্জন!
‘আমি আপনার ভাই হলাম কিভাবে? আমাকে ‘স্যার’ বলেন। ডিসি-এসপি’কে তো ঠিকিই স্যার বলেন, আমাকেও স্যার বলেন? আপনাকে তথ্য দিতে আমি বাধ্য নই। তথ্য দিব সরকারকে।’ -এই বলে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন পটুয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম।
দৈনিক মানবজমিনের বাউফল প্রতিনিধি তোফাজেল হোসেন সিভিল সার্জনের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেন। এ সময় ওই প্রতিনিধি তাকে ভাই বলে সম্বোধন করে পরিদর্শনের তথ্য জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ক্ষুব্ধ হন এবং ওই কথাগুলো বলেন। এমনকি তথ্য না দিয়ে কিছুক্ষণ পরে সিভিল সার্জন ওই প্রতিনিধিকে ফোন করে আরো বলেন, ‘আমাকে স্যার বলেন নি! আমি আপনার বিরুদ্ধে প্রেস ক্লাবে সভাপতির কাছে অভিযোগ দিব। ২৩ আগস্ট ২০২০, মানবজমিন
৯. ‘স্যার’ না বলায় তথ্য দেয়নি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা
‘আপনারা কী আমাদের স্যারদের ভাই বলা শুরু করে দিয়েছেন? ভাই, ভাই বলেন কেন। স্যার বলতে পারেন না? আপনারা এ অভ্যাস শুরু করেছেন কেন?’ তথ্য চাইতে গেলে ক্ষেপে গিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলেন ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতরের জেলা অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পাপিয়া খাতুন।
অভিযোগ রয়েছে, তথ্য চাইতে গেলে তিনি বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের হয়রানি করেন।
শনিবার (২৭ মার্চ) দুপুর ১২টার দিকে কৃষিবিষয়ক তথ্য নিতে ফোন করা হয় অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মোশাররফ হোসেনের কাছে। তিনি বলেন ‘আমি ঢাকায় আছি, অফিসে পাপিয়া নামের একজন রয়েছেন। তার সঙ্গে কথা বললে তথ্য পাবেন।’ তার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কল দেয়া হয় পাপিয়া খাতুনকে। তিনি ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলেন, ‘শনিবার ফোন দিয়েছেন কেন। এর প্রেক্ষিতে তাকে বলা হয় (মোশাররফ হোসেনের-কৃষি কর্মকর্তা) ভাই আপনাকে ফোন দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন আপনাকে ফোন দিলে তথ্যটি দেবেন।’
এ সময় পাপিয়া বলেন, ‘আপনারা আমার স্যারদের ভাই বলার অভ্যাস শুরু করে দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক আজগর আলী বলেন, বুঝতে পারছি না পাপিয়া ক্ষেপে গেল কেন। কেনই বা এমন কথার সৃষ্টি হলো। তার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি দেখছি।
শনি, ২৭ মার্চ ২১, বার্তাবাজার
১০. স্যার না বলায় চিকিৎসা দেয়নি,রোগীর মৃত্যু !
শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সরকারি হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসককে ‘স্যার’ না ডেকে ‘দাদা’ বলে ডাকায় ব্রেন স্ট্রোকের রোগীকে চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এরপর চিকিৎসার অভাবে রোগী মারা গেছেন বলে দাবি স্বজনদের।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের পূর্ব দূর্গাবাটি গ্রামের বিশ্বজিৎ মণ্ডল জানান, আমার বাবা নিরঞ্জন মণ্ডল (৭০) ব্রেন স্ট্রোক করায় এবং শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় রাত ১০টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসি। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার অমিতকে ‘দাদা’ সম্বোধন করে চিকিৎসার কথা বললে তিনি বলেন, ‘সবাই আমাকে স্যার বলে ডাকেন কিন্তু আপনি আমাকে দাদা বললেন কেন?’
তিনি আরও বলেন, ডাক্তারকে অনুরোধ করে একাধিকবার ডাকলেও তিনি আমার বাবাকে দেখেননি। এরপর সঠিক চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার সময় বাবা মারা যান।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা অজয় সাহা জানান, বিষয়টি দুঃখজনক এবং ব্যাপারটি অবশ্যই খতিয়ে দেখব।
রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, জাগো নিউজ
১১. সরকারি কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলায় সাংবাদিকদের বের করে দিলেন
যশোরের অভয়নগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তাকে স্যার না বলে ভাই বলে সম্বোধন করায় ৪ সাংবাদিককে অফিস থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। সোমবার সকালে উপজেলা কৃষি অফিসে এই ঘটনা ঘটে। ওই কর্মকর্তার নাম আব্দুস সোবহান। এ ঘটনায় অভয়নগরে সাংবাদিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক আতিয়ার রহমান জানান, অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাসহ অনেক কর্মকর্তা নিয়মিত অফিসে আসেন না। সোমবার সকাল ১০টায় অফিসে গিয়ে কৃষি কর্মকর্তাকে না পেয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আব্দুস সোবহানের কাছে যাই। গিয়ে দেখি তিনি কয়েকজনের সঙ্গে খোশগল্প করছেন। এ সময় আমি তাকে ভাই সম্বোধন করে কৃষি কর্মকর্তা কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমার দিকে তেড়ে আসেন। অফিসের পিওনকে ডাকাডাকি করে আমাকে বের করে দিতে বলেন। এ সময় পাশে থাকা সাংবাদিক রিপানুর ইসলাম এগিয়ে গেলে তাকেও লাঞ্চিত করে বের করে দেন।
তিনি জানান, এ ঘটনার পর দৈনিক জনতার অভয়নগর প্রতিনিধি কামরুল ইসলাম ও দৈনিক খুলনা টাইমসের অভয়নগর প্রতিনিধি শেখ জাকারিয়া রহমান বিষয়টি জানতে ওই কর্মকর্তার কাছে গিয়ে ভাই বলে সম্বোধন করায় তাদেরও অফিস থেকে বের দেন এবং বলেন ‘আমি একজন বিসিএস ক্যাডার, আমার সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানেন না?’
সাংবাদিক রিপানুর ইসলাম বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসে সোমবার আমিও সংবাদ সংগ্রহে গিয়েছিলাম। এ সময় আমার সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন ওই কর্মকর্তা।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মো. এমদাদ হোসেন শেখ বলেন, অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সামদানী ৩ দিনের ছুটিতে রয়েছেন। আপনারা একটু বিষয়টি মিমাংসা করে নেন।
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, দৈনিক সমকাল
১২. কক্সবাজারে এসিল্যান্ডকে ‘স্যার’ না বলায় ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা
স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় কক্সবাজার শহরের এক চাউল ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন সদরের এসিল্যান্ড মং। এ ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারী বেলা ৩টায় শহরের চাউলবাজার এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটে।
জানা গেছে,পাটের বস্তা ব্যবহার নিশ্চিত করতে গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার শহরের চাউলবাজারে অভিযানে নামে সদর এসিল্যান্ড নু-এমং মারমা মং এর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালত। এসময় এসিল্যান্ডকে একজন ব্যবসায়ী বলেন ‘দাদা আমি ছোট ব্যবসায়ী,জরিমানা একটু কম করলে উপকৃত হবো’। এসময় এসিল্যান্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলে আমি তোর কোন কালের দাদা ছিলাম, আমার বাবা এখানে আরেকটা বিয়ে করেছিল নাকি বলে ধমক দেয় এবং এর অপরাধে আরও ৫ হাজার টাকা মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে। শনিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, কক্সবাংলা
 
১৩. চিকিৎসককে ‘স্যার’ না বলায়…
নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর এক ডাক্তারকে স্যার না বলায় সাংবাদিকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বুধবার (২৮ নভেম্বর) বিকালে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর এর ডা. এ এস এম তানজিরুল ইসলাম রায়হানকে স্যার না বলায় দুর্গাপুর প্রেসক্লারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির ও সাংবাদিক সাহাদত হোসেন কাজলের সাথে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্গাপুর এলাকার অসহায় রিক্সা চালক তারা মিয়ার স্ত্রী নাজমাকে মুমুর্ষ অবস্থায় দুর্গাপুর হাসপাতালে নিয়ে আসে। এসময় কাজল ওই রোগী নিয়ে কর্তব্যরত ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলতে গেলে ‘ডাক্তারকে স্যার সম্বোধন না করায়’ ওই সাংবাদিকের সাথে রুঢ় আচরণ করে চিকিৎসা না দিয়ে হাসপাতাল থেকে রোগীকে বিদায় করে দেন।
নেত্রকোনা জেলা সিভিল সার্জন সাংবাদিকদের বলেন, এই ডাক্তার সম্পর্কে আমি আরো অভিযোগ পেয়েছি, এ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আমি এর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। বুধবার (২৮ নভেম্বর), সময় টিভি
১৪. ‘স্যার’ না বলায় সাংবাদিকের সঙ্গে ইউএনও’র অশালীন আচরণ
খুলনা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মল্লিক সুধাংশুর সঙ্গে তেরখাদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটন আলী অসৌজন্যমূলক ও অশালীন আচরণ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে খুলনার সাংবাদিক সমাজের মধ্যে ক্ষোভ ও তীব্র নিন্দার ঝড় উঠেছে। ইউএনওকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিকরা।
বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় মল্লিক সুধাংশুর সঙ্গে তিনি অশালীন আচরণ করেন। তিনি বলেন, তেরখাদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিটন আলী মোবাইল ফোনে কল করে আমাকে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। ফোনালাপের এক পর্যায়ে তাকে স্যার না বলে ভাই বলায় আমার সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন।
এ বিষয়ে তেরখাদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিটন আলী মোবাইল ফোনে বলেন, আমি সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশের লোকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। তিনি মনে করেছেন তার সঙ্গে আমি এমন ব্যবহার করেছি। খুলনার জেলা প্রশাসক মো. আমিন উল আহসান বলেন, আসলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। বিষয়টি আমি দেখছি।
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
 
১৬. দুর্গাপুরে রাকাবের ম্যানেজারকে স্যার না বলায় গ্রাহককে গালাগালি
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) এক শাখা ব্যবস্থাপককে স্যার সম্বোধন না করায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক কৃষককে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাকাবের দুর্গাপুর শাখায় এই ঘটনাটি ঘটেছে। তবে এ ঘটনাকে নিছক ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে দাবি করেছেন ওই ব্যাংক কর্মকর্তা।
জানা গেছে, বুধবার দুপুরে উপজেলার পানানগর ইউনিয়নের মহিপাড়া গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কৃষক শিলবানিউস মূরমু রাকাবের দুর্গাপুর শাখায় লোন নেয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে যান। এক পর্যায়ে শাখা ব্যবস্থাপক শামীম জামানের কাছে গিয়ে তার সামনের চেয়ারে বসেন। একই সময় অন্য কাজে তার সাথে ওই ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে যান উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে শাখা ব্যবস্থাপক শামীম জামানকে ভাই সম্বোধন করায় ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম জামান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে তাকে স্যার না ডেকে ভাই বলার কারণ জানতে চান। এমনকি স্যার সম্বোধন না করে কথা বললে লোন দেয়া তো দুরের কথা কোন তথ্যই দেয়া যাবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন।
এক পর্যায়ে উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকন ব্যাংক কর্মকর্তা শামীম জামানের কথার বিরোধিতা করে বলেন, স্যার সম্বোধন করতে হবে এটা কোথায় লেখা আছে? সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জনগণ স্যার-ম্যাডাম সম্বোধন করবে নাকি প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণকে (যারা সকল ক্ষমতার উৎস) প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ স্যার সম্বোধন করবে?
যদি স্যার ডাকতে হয় তবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাই ডাকবেন। এ বিষয়ে গত বছর একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীও কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন।
জানতে চাইলে রাকাবের দুর্গাপুর শাখার শাখা ব্যবস্থাপক শামীম জামান বলেন, তাকে নয়, তার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ভাই সম্বোধন করায় তিনি কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে ছিলেন। এটা নিছক ভুল বোঝাবুঝি হিসেবে তিনি দাবি করেন।
ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১, সময় নিউজ ২৪.কম
১৭. ‘স্যার’ না বলায় রোগী দেখলেন না ডাক্তার!
 সাতক্ষীরায় রোগীর স্বজনরা চিকিৎসককে ‘স্যার’ না বলায় রোগী না দেখার অভিযোগ উঠেছে ডা. অমিত নামে এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। তিনি শ্যামমগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার।
রোগীর স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিলেন নিরঞ্জন মণ্ডল (৭০) নামে এক রোগী। শুক্রবার রাত ১০ টার দিকে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে নিরঞ্জনের ছেলে বিশ্বজিৎ মণ্ডল কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. অমিতের শরণাপন্ন হন। এ সময় বিশ্বজিৎ ডাক্তারকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ডা. অমিত এবং রোগী দেখতে অস্বীকৃতি জানান। পরে স্বজনরা নিরঞ্জনকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ বিষয়ে ডাক্তার অমিতের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, “আমাদের প্রোটকলে আছে আমাদের স্যার বলতে হবে। সাধারণ মানুষকে আমাকে স্যার বলতে হবে।”
সাধারণ মানুষ স্যার বলতে হবে— এমন বিধি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের প্রশিক্ষণ থেকেই বলেছে, যে সাধারণ মানুষ আমাদের স্যার বলে ডাকবে।”
ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১, দৈনিক জাগরণ
স্যার না ডাকার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী কতৃক জনগণকে হয়রানী, লাঞ্চিত করার বিষয়টিকে কে কিভাবে দেখছেন এ সম্পর্কে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। সমীক্ষাতে বিভিন্ন জনমত তুলে ধরা হয়েছে।
স্যার আসলে কি ?
কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য বুঝাতে বঙ্গদেশে ‘SIR’ শব্দের প্রচলন শুরু হয় ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজরা আসার পর দিশি জনগণ কর্তৃক প্রশাসনিক কর্তাদের ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু হয় মূলত শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও প্রভুত্ব স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।

স্যার সম্বোধনে বিভ্রাট

শাকিল আহমেদ
সম্প্রতি বাংলাদেশে জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ‘স্যার’ সম্বোধন না করায় সাধারণ নাগরিক ও সাংবাদিক হেনস্তার শিকার হন। উপরোক্ত বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত সাথে লজ্জাজনকও বটে। কারণ স্বাধীনতার প্রায় ৪৯ বছরেও সোনার বাংলায় বৃটিশ মনোভাবের চর্চা চলছে।
প্রায় সতেরশো শতকের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে স্যার শব্দের প্রচলন হয়। তৎকালীন সময় বৃটিশরা এই শব্দটি ব্যবহার বেশি করতো। ইংরেজি শব্দ স্যার (sir) এর উৎপত্তি ফ্রেঞ্চ শব্দ স্যায়ার (sire) থেকে। বৃটিশরা উপমহাদেশ থেকে চলে গেছে প্রায় ৭০ বছর পূর্বে, কিন্তু আমাদের দেশে এখনো তাদের অত্যাচারী বৈশিষ্ট্য (যা তারা উপমহাদেশের সাধারণ মানুষদের উপর চালাতো) বা ঔপনিবেশিক মনোভাব পরিলক্ষিত হয় কিছু উর্ধতন কর্মকর্তার মাঝে।
মজার বিষয় হচ্ছে, তারা যে শব্দটা উপমহাদেশে প্রচলন করেছিলো সেটা তারা নিজেরাও ব্যবহার করে অনেক স্বল্প পরিসরে। বৃটিশরা কথা বলার সময় অপরিচিত কাউকে শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে স্যার বলে সম্বোধন করে থাকে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টকেও মি. প্রেসিডেন্ট সম্বোধন করা হয়। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সম্মানসূচক স্যার/ম্যাম বলে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু যদি কেউ না করে তাতে নিশ্চয়ই উক্ত শিক্ষকের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কথা না।
কথা বলার সময় ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করায় পুলিশ, ইউএনও কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চ বর্ণের লোকের দ্বারা প্রতিনিয়ত সাধারণ নাগরিক হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এই ধরনের ঘটনা বর্তমানে নিত্যদিনের সঙ্গী।
কোন ব্যক্তি অবশ্যই কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদে যোগদানের সুযোগ পান তাদের স্যার বলে সম্বোধন করাটা রুচিসম্মত। তবে এর মানে এই নয় যে, কথা বলার সময় অবশ্যই স্যার সম্বোধন করতে হবে। সাধারণ নাগরিক, সংবাদকর্মীরা বিভিন্ন সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন স্যার সম্বোধন না করায়। বলা হয় সরকারি আমলারা জনগনের সেবক। কিন্তু এ ধরনের কর্মকান্ড রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা করেন তবে তারা জনগণের সেবক হন কিভাবে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বক্তৃতায় সাধারণ নাগরিকদের সন্মান করতে বলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এর উল্টোটা হচ্ছে।
জনগণ হয়ে যাচ্ছে দাস আর উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিরা প্রভূ রুপে আবির্ভূত হচ্ছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজই হচ্ছে জনগণের সেবা করা। কিন্তু সেই সেবা সাধারণ জনগণ কতটুকু পাচ্ছে তা আমাদের অজানা। এখনই সময় পরিবর্তনের নচেৎ ‘স্যার’ শব্দটির অতিমাত্রায় ভক্তি সমাজে সৃষ্টি করতে পারে নানা সমস্যা। প্রত্যাশা একটাই চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস ও সভ্যতা ডিসিপ্লিন বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

অফিসিয়াল প্রটোকল ছাড়া কাউকেই স্যার বলা উচিত না !

মাসরুফ হোসেন
বাংলাদেশ পুলিশ এ কাজ করেন মারুফ হোসেন (2010-বর্তমান) তিনি বলেন,
অফিসিয়াল প্রটোকল ছাড়া কাউকেই স্যার বলা উচিত না। এই কলোনিয়াল ধ্যান ধারণা থেকে যত দ্রুত বের হওয়া যায় ততই মঙ্গল।
একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে ঘটনাগুলো দেখলাম এবং লজ্জায় মাটিতে মিশে গেলাম। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া কলোনিয়াল হ্যাংওভার যে আমাদের সরকারী কর্মকর্তাদের ভেতরে এখনো রয়ে গিয়েছে, একটা বড় অংশের সরকারী কর্মকর্তা যে নিজেদেরকে একালের জমিদার বলে মনে করেন- এগুলো হচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ।
না, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্বোধনে এখনো কোনও আইন নেই। তবে একটা প্রস্তাবিত আইন এমন হতে পারেঃ দেশের সকল ক্ষমতার অধিকারী জনগণকে সেই দেশের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই স্যার বলতে এবং স্যালুট দিতে বাধ্য থাকবে এভাবে।
আমি নিজে পুলিশই প্রটোকলের বাইরে কারো কাছে স্যার ডাক আশা করিনা, বরং বয়েসে বড় কোনও নাগরিক এলে তাঁকে স্যার সম্বোধন করি। মনে হয়না এতে আমার চাকুরীর কোনও ক্ষতি হয়েছে বা সম্মানহানি হয়েছে।

স্যার-ম্যাডাম-মাই লর্ড : সম্বোধনে ঔপনিবেশিকতা 

সাঈদ আহসান খালিদ
লেখক- সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সম্বোধনের এমন মাহাত্ম্য প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে পৃথিবীর অন্য কোথাও দৃশ্যমান হয় না। প্রজাতন্ত্রের সরকারি কর্মচারী কর্তৃক জনগণের মুখ দিয়ে ‘স্যার’, ‘মেম’, ‘সাহেব’ কিংবা বিচারালয়ে বিচারককে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধনে প্রকট হয়ে উঠে কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের উত্তর-উপনিবেশী আকাঙ্ক্ষা। বাংলাদেশের আইন-আচার ও বিচারে এসব সম্বোধন কীভাবে এবং কেন অনুষজ্ঞ হয়ে উঠলো- সেটির হদিস অনুসন্ধান জরুরি।
 
স্যার শব্দটি যেভাবে এলো:
‘স্যার’ (Sir) শব্দটি ইংরেজি হলেও এটির উৎপত্তি মধ্যযুগের ফরাসি দেশে ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘স্যায়ার’ (Sire) থেকে, সেখানে জমিদার বা সামন্ত প্রভুদের প্রজারা সম্বোধন করত ‘স্যায়ার’ বলে। Are We Still Slaves?– শিরোনামের এক নিবন্ধে ভারতীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক উদয়লাল পাই দাবি করেছেন, ফরাসি দেশে সামন্তযুগে SIR শব্দ দ্বারা বুঝানো হত- Slave I Remain, আর ইংল্যান্ডে রাজকীয় নাইট উপাধিপ্রাপ্তদের নামের আগে ব্যবহৃত SIR শব্দ দ্বারা নির্দেশ করে- Servant I Remain. SIR শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে ১২৯৭ সাল থেকে যখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্তদের নামের পূর্বে ‘স্যার’ যুক্ত করা শুরু হয়। কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য বুঝাতে বঙ্গদেশে SIR শব্দের প্রচলন শুরু হয় ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজরা আসার পর দিশি জনগণ কর্তৃক প্রশাসনিক কর্তাদের ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু হয় মূলত শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও প্রভুত্ব স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। ইংরেজ কর্তাকে দিশি প্রজা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলেও ইংরেজরা নিজেরা ঊর্ধ্বতন বাঙালিদেরকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করতে পছন্দ করতেন। বাঙালিরাও বাঙালিদের পরস্পরকে ‘বাবু’ই বলতেন।
বর্তমানে ‘স্যার’ শব্দের সবচেয়ে বহুল ব্যবহার দেখা যায় শিক্ষাঙ্গনে। সেখানে অবশ্য এখন এটি প্রভুত্ব বুঝানোর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সম্মানার্থে। বাংলায় স্যারের পরিবর্তে আগে শিক্ষক-কে সম্বোধনে ‘মাস্টারমশাই’, ‘পণ্ডিতমশাই’ প্রভৃতি সম্বোধন চালু ছিল যার ব্যবহার এখন প্রায় অচল। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় সম্বোধনের ক্ষেত্রে পুরুষ শিক্ষক-কে ‘স্যার’ এবং নারী শিক্ষক-কে ‘মিস’ (Miss) ডাকা বহুল প্রচলিত যেটি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় এদেশেও আত্মীকরণ হয়েছে। ফলে কোন স্কুলের প্রধান পুরুষ হলে ‘হেড-মাস্টার’ বা ‘হেড-স্যার’ এবং নারী প্রধান হলে তাঁকে ‘হেড-মিস্ট্রেস’ (Head- mistress) ডাকতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও আপত্তি রয়েছে। ইংরেজি Master শব্দ এক অর্থে প্রভু বুঝায় এবং Mistress শব্দ পৃথিবীর অনেক স্থানে উপ-পত্নী বা রক্ষিতাও বুঝিয়ে থাকে। আমেরিকা ও ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বর্তমানে শিক্ষককে ‘স্যার’, বা ‘মিস’ ডাকার পরিবর্তে ‘প্রফেসর’, ড. , কিংবা নাম ধরে ডাকার চল রয়েছে।
সাহেব/সায়েব:
সাহেব শব্দটি আরবি সাহাবী শব্দ থেকে এসেছে, একবচনে এটি সাহাবী এবং বহুবচন বুঝাতে সাহাব ও আসহাব শব্দ ব্যবহৃত হয়। আরবি ভাষার অর্থে এটি দ্বারা সঙ্গি, সাথী, সহচর কিংবা বন্ধুকে বুঝায়। ইসলামে সাহাবা শব্দ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মহান সঙ্গি-সাথীদেরকে বুঝানো হয়। ইরানিরা যখন এল ভারতে তখন নিয়ে এল সাহিব । ইংরেজরা এদেশে আসার পর সেই সাহিব হয়ে গেল সাহেব বা সায়েব এবং তখন তা সঙ্গি হিসেবে নয় ‘কর্তা’ হিসেবে ব্যবহৃত হতে লাগল। ব্রিটিশ ও শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় নারীরা হলেন মেমসাহেব, বাঙালি বিবাহিত মহিলারা পরিচিত হলেন- বেগম সাহেব শব্দে। মুনতাসীর মামুন তাঁর ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন (২০১৫)– গ্রন্থে লিখেছেন, এই সাহেব, মেমসাহেব বা বেগম সাহেব শব্দসমূহ ইংরেজ আমল হতে কর্তৃত্ব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে অথচ ১৮৬৯ সালের আগে কর্তৃত্বপ্রকাশক সম্বোধন অর্থে এই শব্দের ব্যবহার আমাদের দেশে ছিল না।
প্রশান্ত ত্রিপুরা তাঁর ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় বাংলাদেশ (২০২০) গ্রন্থে প্রশ্ন রেখেছেন-
ব্রিটিশরা বহু দশক ধরে এই উপমহাদেশে আর সশরীরে না থাকলেও তাঁদের বদলে এখন যাদের বেলায় ‘সাহেব’ সম্বোধন প্রয়োগ করা হয়, যাদের অনেকের পেশাগত পরিচয়েও ব্রিটিশদের বা ইংরেজি ভাষার ছায়া লেগে আছে- মাস্টার, ডাক্তার, হেডম্যান, চেয়ারম্যান, জজ, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিনিয়ার, ডিসি, ওসি, এমপি, প্রফেসর-তাদের চলন-বলন-মননেও কি ঔপনিবেশিক সাহেবিয়ানা দেখা যায় না? সেই সাহেবিয়ানার কতটা অসচেতনভাবে চলছে, আর কতটা চর্চিত হচ্ছে সচেতনভাবে?
ম্যাডাম/ মেম /মেমসাহেব:
ইংরেজি Madam শব্দটিও ফ্রেঞ্চ Madame থেকে এসেছে যেটির সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে মেম (Ma’am) শব্দও ব্যবহৃত হয়, ইংরেজিতে অর্থ- My Lady । ‘ম্যাডাম’ বা ‘মেম’ শব্দদুটি সাধারণত কোন ভদ্রমহিলাকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী বা সহকর্মী কর্তৃক কোন নারী শিক্ষক-কে সম্মানার্থ সম্বোধনের ক্ষেত্রেও এই দুই শব্দের প্রচলন বেশ জনপ্রিয়। কিন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ‘মেম’ শব্দ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার যেটি দিয়ে শ্বেতাঙ্গী, অভিজাত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় নারীদের বুঝানো হত। লেখক নিখিল সুর এর সায়েবমেম সমাচার (২০১৯) গ্রন্থ হতে জানা যায়, শ্বেতাঙ্গিনীদের ‘মেমসায়েব’ বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ ভারতীয়দের মধ্যে চালু থাকলেও, বস্তুত শ্বেতাঙ্গিনীরা শুধুই ‘মেম’। তাঁর মতে, পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ১৭৫৬ সালে সারা বাংলায় ‘মেম’ এর সংখ্যা ছিল ৮০ জন যদিও ভারতে ব্রিটিশ রানির শাসন কায়েম পরবর্তী সময়ে এদেশে মেমসায়েব আগমনের বান নেমেছিল। ভারতে আগত এই বিলেতি মেমদের অধিকাংশের জীবন ছিল ভোগ-বিলাস, আভিজাত্য, অহংকার, দিশি মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতি বিরক্তি এবং এদেশীয় গৃহভৃত্যদের প্রতি অবিচার ও শ্রেণিবিদ্বেষে পূর্ণ। ‘মেমসায়েব’ শব্দের মধ্যে লুকায়িত ছিল প্রভু আর ভৃত্যের সম্পর্কের স্বরূপ। আদনান সৈয়দ এর লেখা ঔপনিবেশিক ভারতের বিলাতি নারীরা (২০১৬)– বই থেকে ভারতে আগত বিলাতি নারীদের মেমসাহেবি জীবন যাপন, তাদের মানসিকতা, প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এবং সর্বোপরি তাদের গৃহস্থ জীবনের খুটিনাটি দিকসম্বন্ধে জানা যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছে কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও ঊর্ধ্বতন সরকারি নারী কর্মচারী কর্তৃক জনগণের মুখ হতে ম্যাডাম/মেম শুনার সংস্কৃতির অবসান হয়নি, ম্যাডাম/মেম না ডাকলে তাদের অনেকে রুষ্ট ও কুপিত হন, এমনকি শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন বলে প্রায়ই খবর পাওয়া যায়।
মাই লর্ড /মি লর্ড/ ইয়োর লর্ডশিপ:
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ তৈরির গোড়া থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সর্বত্রজুড়ে যে শব্দগুলো সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে মাই লর্ড একটি। প্রায় দুশো বছর ধরে উপনিবেশিত ভারতীয় প্রজারা মাই লর্ড বলে তারস্বরে ডেকেছেন প্রভু হয়ে জেঁকে বসা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের সম্বোধন করতে গিয়ে- প্রজার নিঃশর্ত আনুগত্য ও আত্মসমর্পন প্রকাশের চিহ্নস্বরূপ। Lord শব্দটি প্রাচীন ইংরেজি শব্দ Loaf-ward থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে যেখানে প্রাচীন সামন্তযুগে Loaf অর্থ রুটি এবং Ward শব্দটি রক্ষাকর্তা অর্থে ব্যবহৃত। এই Loaf-ward শব্দ আদতে জার্মানির আদিবাসী সমাজের এমন সামন্ত সর্দারকে বোঝাত যে তার দাস ও অনুচরদের রক্ষণাবেক্ষণ ও খাদ্য যোগান দিত। যুক্তরাজ্যে এলিট সমাজের সদস্য ‘ব্যারন (Barron)’কে সাধারণত Lord নামে ডাকা হয়। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ ‘হাউজ অব লর্ডস’ এর সদস্যরা ‘লর্ড’ নামে পরিচিত। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত হাউজ অব লর্ডস-এ যেসব বিচারক বসে বিচারকাজ করতেন তাদেরকে বলা হত- Law Lords. ইংল্যান্ডের কোর্ট অব আপিলের বিচারকবৃন্দ Lord Justice নামে সম্বোধিত হন। বিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ অব্দি ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টাররা ব্রিটিশ আদালতে বিচারকদেরকে Milord (মি লর্ড) নামে সম্বোধন করতেন তবে পরবর্তীতে ‘মি লর্ড’ এর বদলে ‘মাই লর্ড’ জায়গা করে নেয়।
বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সাথে সাথে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে এই ‘লর্ড’ শব্দও এখানে আমদানি হয় যেটি দিয়ে ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ প্রশাসককে সম্বোধন করা হত, পরবর্তীতে আদালতের শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ বিচারকেরাও সম্বোধনের ক্ষেত্রে মাই লর্ড, মি লর্ড বা ইয়ুর লর্ডশিপ সম্বোধনের আওতায় আসেন। আদালতের আচার ও আনুষ্ঠানিকতায় এই ‘লর্ড’ যুক্ত হওয়ার পেছনে বাংলার প্রজাদের উপর ব্রিটিশ শাসক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাই যে মূল উদ্দেশ্য ছিল- তা বলা বাহুল্য। বাংলাদেশের নিম্ন আদালতের বিচারকবৃন্দকে আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীরা এখন আর ‘মাই লর্ড’ ডাকেন না, সম্মানার্থে বিজ্ঞ আদালত, Your Honour, বা Sir নামে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দকে বাংলাদেশে এখনো মাই লর্ড, মি লর্ড বা ইয়ুর লর্ডশিপ সম্বোধনে ডাকা হয়। প্রশ্ন হতে পারে- বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকবৃন্দকে এরূপ সম্বোধন করা কি আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীর জন্য আইনগতভাবে বাধ্যকরী কোন বিধান কিনা?
বাংলাদেশের আইনজীবীদের পেশাগত শৃংখলা ও আচরন নিয়ন্ত্রণকারী আইন Bangladesh Legal Practitioners and Bar Council Order and Rules, 1972 এবং Canons of Professional Conduct and Etiquette এর কোথাও এমন কোন বিধান নেই। অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত আইন- The Civil Rules and Orders (CRO) এর ৮২৫ ও ৮২৬ বিধিতে আইনজীবীদের নির্দিষ্ট পোশাক-পরিচ্ছেদের জন্য আইনগত বাধ্যকরী নির্দেশনা থাকলেও সম্বোধনের ক্ষেত্রে My Lord, MiLord, বা Your Lordship বলার কোন আইনগত বিধান নেই। ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত আইন – The Supreme Court (High Court Division) Rules, 1973 সংশোধন করে এই আইনে Chapter XVIA সংযুক্ত করা হয়েছে যেটির ১(৩) বিধিতে আদালতে পালনীয় ডেকোরাম এর মধ্যে বিচারককে সম্বোধনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিধান অনুসরণের কথা লেখা আছে-
Advocates or any other person addressing the Court must do so with utmost respect to the Court and in a disciplined manner maintaining the tradition so long prevailing and mode of address to the judge shall be the same irrespective of gender of the Judge.
অর্থাৎ, এখানে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারকদেরকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের প্রচলিত ঐতিহ্য অনুসারে সম্মান প্রদর্শনমূলক সম্বোধনের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ‘মাই লর্ড’ বলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এখন, ‘প্রচলিত দীর্ঘ ঐতিহ্য’ বলতে কি পাকিস্তান যুগ অতিক্রম করে ব্রিটিশ উপনিবেশিত সমাজের প্রচলিত লর্ড ডাকা বুঝাবে কিনা সেটি স্পষ্ট করা হয়নি। ১৯৮৮ সালে প্রণীত The Supreme Court (Appellate Division) Rules ও এই বিষয়ে চুপ। মোটাদাগে, এটি বোধগম্য যে, কোন বিচারক-কে ‘মাই লর্ড’ সম্বোধন বাংলাদেশের প্রচলিত আইনানুসারে বাধ্যকরী কোন বিধান নয়, এটি স্রেফ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রথা, ব্রিটিশদের প্রভুত্ব ও বাঙালির দাসত্বের ধ্বংসাবশেষ চিহ্ন।
প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র- যার সাথে আমরা একত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশ এর অংশীদার ছিলাম, সেই ভারত কিন্তু বিচারকদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে এসব ‘মাই লর্ড’, ‘মি লর্ড’-কে ঔপনিবেশিক দাসত্বের চিহ্ন গণ্যপূর্বক আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার ক্রমাগত উদ্যোগ নিয়েছে, নিচ্ছে। ভারতের আইনজীবীদের প্রতিবাদ ও দাবির প্রেক্ষিতে প্রথম উদ্যোগটি আসে- ভারতের বার কাউন্সিলের হাত ধরে। ২০০৬ সালে এক ঐতিহাসিক রেজুলেশন (Res. No. 58/2006) এর মাধ্যমে ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৯৬১ – এর অধীনে Bar Council of India Rules সংশোধন করে সিদ্ধান্ত নেয়- এখন থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারকদেরকে আইনজীবীরা Your Honour বা Hon’ble Court বলে সম্বোধন করবে, আর অধস্তন আদালতের বিচারকদেরকে ‘স্যার’ অথবা সমজাতীয় আঞ্চলিক সম্মানসূচক সম্বোধন করা হবে। ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিলের এই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে কেরালা হাইকোর্ট অ্যাডভোকেট এসোসিয়েশন এবং ২০১১ সালে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট বার সমিতিও বিচারকদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে একই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০১৯ সালে ভারতের রাজস্থান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রবীন্দ্র ভট্টের নেতৃত্বে সর্বসম্মতিক্রমে এক আদেশে বিচারকদেরকে ‘মাই লর্ড’ ও ‘ইয়োর লর্ডশিপ’ সম্বোধন ‘ঔপনিবেশিক দাসত্বের স্মৃতি’ গণ্য করে এটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আদেশে বলা হয়েছে, বিচারকদের সম্মানসূচক অন্য যে কোন সম্বোধন যেমন- Sir বা Your Honour বলা যাবে। বিচারকদের নামের পূর্বে এসব ঔপনিবেশিক সম্বোধন নিরুৎসাহিত করার এমন বিচারিক সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত ভারতে এটিই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, বিচারপতিদের সম্মান জানানোটা জরুরি হলেও সেজন্য তাদের ‘মাই লর্ড’ বা ‘ইয়োর লর্ডশিপ’ বলে সম্বোধন করাটা বাধ্যতামূলক নয়। অন্যান্য দেশে বিচারক-কে সম্বোধনের ক্ষেত্রেও ও প্রায় একই রীতি। ইটালিতে বিচারককে সম্বোধন করা হয়- Mr President of the Court, স্পেনে ডাকা হয়-Your Honour, জার্মানিতে বলা হয়- Mister Chairman, নারী বিচারকদের ক্ষেত্রে Madam Chairwoman এবং যুক্তরাষ্ট্রে Justice অথবা Judge সম্বোধনের পর ব্যক্তির নাম যুক্ত হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত গিয়েছে ঢের আগে, পাকিস্তানের উপনিবেশিকতা থেকেও মুক্তি এসেছে- তাও প্রায় অর্ধ শতক তবু স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সত্ত্বা নিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ঔপনিবেশিক প্রেতাত্মা আজো ভর করে আছে, নানারূপে- সম্বোধন তার একটি।

স্যার সম্বোধন

মাইনুল এইচ সিরাজী
স্যার/ম্যাডাম না বললে ইউএনও ক্ষেপবেন―এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ আমরা এতেই অভ্যস্ত৷ এই পরিস্থিতি আমরাই তৈরি করেছি৷ পত্রিকার কলাম লেখককে আমরা স্যার বলি, কবি/সাহিত্যিককে আমরা স্যার বলি, মেয়র-কাউন্সিলর-ইউপি চেয়ারম্যানের মতো জনগণের সেবককে স্যার বলি, এমনকি ফেসবুক সেলিব্রেটিকেও স্যার বলে তৃপ্তি পাই৷
কোনো কবি-লেখক, কোনো শিল্পী, কোনো বুদ্ধিজীবী স্যার সম্বোধনের কখনো কি প্রতিবাদ করেছেন? রুচিশীল এই ব্যক্তিরা কখনো সেটা করেননি৷ কারণ ‘স্যার’কে সবাই উপভোগ করে৷
 
বহু আগে আনোয়ারা সৈয়দ হক ভোরের কাগজে তোয়ালে অফিসার শিরোনামে একটা কলাম লিখেছিলেন৷ কে কত বড় অফিসার―সেটা চেনা যায় তোয়ালে আর চেয়ার দেখে৷
 
আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে সে দেশের জনগণ মিস্টার প্রেসিডেন্ট সম্বোধন করে৷ আমি-আপনি এটা ভাবতে পারি? সিঙ্গাপুরে দেখেছি, সিনিয়র সিটিজেনরা সরকারি অফিসে পার্টটাইম চাকরি করছেন৷ আগে বড় অফিসার ছিলেন, এখন ক্লিনার৷ অফিসের প্রধান নির্বাহী থেকে ক্লিনার পর্যন্ত সবার নেমপ্লেটে লেখা―‘স্টাফ’৷ পদের ওজন কিংবা ওজনহীনতায় তাঁরা আক্রান্ত হন না৷ একজন কর্মীর জন্য এই সমান মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ কতটা প্রয়োজন―সে কথা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ভাবেন না৷ ফলে এক পদ ওপরে উঠে গেলে নিম্নপদস্থদের আমরা চাকর ভেবে বসে থাকি৷
 
সিঙ্গাপুরে ২১ দিনের ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের একাধিক মন্ত্রী গিয়েছিলেন পরিদর্শনে৷ সেশন চলাকালে গ্যালারির পেছনে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করে চলে গিয়েছেন৷ আমরা দেখিওনি৷ যেদিন আমাদের ক্লোজিং, সার্টিফিকেট দেবেন প্রধান নির্বাহী৷ তাঁর সঙ্গে আর কেউ নেই৷ একা এসে বসেছেন আমাদের সঙ্গে গ্যালারিতে৷ পরে সার্টিফিকেট দিয়ে, কয়েক মিনিট বক্তব্য দিয়ে একাই চলে গেছেন৷ কোনো প্রধান অতিথি নেই, সভাপতি নেই, পুষ্পস্তবক নেই, তা বটেই তো তা বটেই তো মার্কা তৈলাক্ত বক্তব্য নেই, কার আগে কে বক্তব্য দেবে―সেটা নিয়ে বিতর্ক নেই, মঞ্চে বসা নিয়ে ঠেলাঠেলি নেই৷ থাকবে কী করে? মঞ্চই তো নেই৷
 
আমরা আয়োজন করি, কাজ করি না৷ স্যার সাজি, ইজ্জত বুঝি না৷
কিন্তু খামাখা কথা বলে লাভ কী? এটা আমাদের কালচার৷ এটা আমাদের আইন৷ তোয়ালে, চেয়ার-টেবিল, স্যার―এসব বাদ দেন, আপনি তো বসের সঙ্গে সমান্তরালে হাঁটতেও পারবেন না৷ দুই কদম পেছনে হাঁটতে হবে৷ একসঙ্গে খেতে বসলে বস শেষ করার আগে আপনি উঠতে পারবেন না৷ আপনার কাজ থাকলেও না৷
 
সুতরাং উপনিবেশের মূল না কেটে হাহুতাশ করে লাভ নেই৷
পরিবর্তন অবশ্য হবে৷ আমাদের কর্পোরেট অফিসগুলোতে অনেকটা হয়েছে৷ সবার একই রকম চেয়ার, ডেস্ক৷ প্রথম আলোর মতিউর রহমানকে সবাই মতি ভাই বলেই ডাকে শুনেছি৷ কালের কণ্ঠের সবাই ডাকে মিলন ভাই৷
কাপ্তাইয়ে থাকতে নৌবাহিনী স্কুলের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম৷ মঞ্চে শুধু সঞ্চালক৷ দর্শক সারি থেকে উঠে এসে একেক জন অতিথি বক্তব্য দিয়ে আবার নেমে যাচ্ছেন৷ অনুষ্ঠান শেষে আপ্যায়নের ব্যবস্থা৷ নেভির সিইও নিজ হাতে সবাইকে খাবার তুলে দিচ্ছেন৷ সবাই যে তাঁর অতিথি৷ আমার বস আর আমি পাশাপাশি৷ দাঁড়িয়ে খাচ্ছি৷ বসার ব্যবস্থা নেই৷ বস ফিসফিস করে বললেন, দেখেছেন? আমি বললাম, কী স্যার? বস বললেন, চমৎকার সিস্টেম৷
সত্যিই চমৎকার৷ আমাদের দেশেই তো হচ্ছে৷ সুতরাং আলো আসবেই৷

“স্যার” শব্দ’টি নিয়ে আমার আপত্তি আছে

আমিনুল ইসলাম 
 
“স্যার” শব্দ’টি নিয়ে আমার আপত্তি আছে। লোকজন আমাকে “স্যার” বলে ডাকে, এটা আমি মোটেই পছন্দ করি না। এমনকি আমি আমার এখানকার বাংলাদেশি ছাত্রদের অনেকবার বলেছি- আমকে তোমরা “স্যার” বলে ডেকো না। আমার একটা নাম আছে।
 
“স্যার” শব্দটির মাঝে এক ধরনের উপনিবেশিক ব্যাপার আছে। যদিও আমেরিকায় বাবা কিংবা শ্বশুর গোত্রীয় মানুষজনদের “স্যার” বলে ডাকার একটা প্রচলন আছে। তবে সেটা ভিন্ন বিষয়। মুলত ব্রিটিশরা তাদের “স্যার” শব্দটি আমাদের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।
উপরের লেভেলের কেউ’কে স্যার বলতেই হবে। নইলে আবার তিনি কি মনে করে বসেন ঠিক নেই! তবে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে সেই অর্থে “স্যার” বলার প্রচলন একদম নেই বললেই চলে। এখানে সবাই সবার নাম ধরে ডাকে।
 
বড় প্রফেসর’কেও আমরা নাম ধরে ডাকি। আমার বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা যখন রাস্তা ঘাটে কিংবা দোকানে দেখা হলে আমাকে “স্যার” বলে ডাকে; আমি রীতিমত বিব্রত হই। কারন আমি বুঝতে পারি, আশপাশের মানুষজন অবাক হয়ে তাকাচ্ছে! কারন কেউ একজন আরেক জনকে “স্যার” বলে ডাকছে, এতে তারা অভস্ত না।
আমি তাই আমার ছাত্রদের বলেছি- আমাকে স্যার বলে না ডাকতে। কিন্তু কে শুনে কার কথা! উপনেবেসিক মন মানসিকতা বলে কথা। এতো সহজে কি আর যায়। শিক্ষক’কে নাম ধরে ডাকা, এটা আসলে আমাদের বাংলাদেশের মতো সমাজ থেকে উঠে আসা যে কারো জন্য প্রায় অসম্ভব’ই। তাই এরা মনের আনন্দে আমাকে “স্যার” বলেই সম্বোধন করে যাচ্ছে। যদিও আমি এটা মোটেই এনজয় করি না।
 
আবার ধরুন বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে আসে, তাদের যদি সাদা চামড়ার কোন বন্ধু-বান্ধব থাকে, তাহলে সে তার বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে আলাদা একটা দাম পায়। সাদা চামড়ার বন্ধু-বান্ধবী আছে বিশাল ব্যাপার সেপার! অথচ এটা তো হবার কথা না। এর কারনও সেই উপনিবেশিক মন মানসিকতা। কারন আমদের মনের মাঝে গেঁথে গেছে- সাদা চামড়া মানে বিশাল কিছু! আমি যখন আমাদের বাংলাদেশিদের মাঝে এই নিয়ে কথা বলতে শুনি, আমার নিজেরই হাসি পায়!
এর কারন আর কিছু না। আমাদের উপনেবেসিক মন মানসিকতা! ব্রিটিশরা চলে গেছে, কিন্তু আমাদের উপনিবেশিক মানসিকতা আসলে এখনো যায়নি।
তো শুনলাম এক বিসিএক ক্যাডার ভদ্রমহিলা নাকি তাকে “ম্যাডাম” বলে সম্বোধন না করায় বিশেষ ভাবে মাইন্ড খেয়েছেন। তাকে কেন আপা ডাকা হলো এই নিয়ে নাকি তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করেছেন। তো, এই ভদ্রমহিলা তো আর আকাশ থেকে উঠে আসেননি; তিনি আমদের সমাজ থেকেই উঠে এসছেন। সুতরাং তার মাঝেও এই ধরনের উপনিবেশিক মানসিকতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
যারা বিসিএস ক্যাডার হতে চায়, তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করুন
-আপনি কেন বিএসএস ক্যাডার হতে চান?
তখনই বুঝতে পারবেন; সমস্যাটা কোথায়। কারন তারা বিসিএস ক্যাডার হতে চায়, লোকজন তাদের “স্যার” সম্বোধন করবে, তাদের ভয় পাবে, তাদের হাতে ক্ষমতা থাকবে, সেই সঙ্গে থাকবে অর্থ!
ইউরোপ-আমেরিকায় যারা সরকারী চাকরী করে তাদেরকে ধরে নেয়া হয় জনগনের সেবক। মানুষজনও ঠিক তেমনটাই ভাবে। কারন মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন দেয়া হয়। তাই এরা সব সময় খুব বিনয়ী হয়। এটাই তো হবার কথা ছিল আমাদের দেশেও! অথচ আমরা কিনা “স্যার”, “ম্যাডাম” কেন ডাকা হচ্ছে না, এই নিয়ে ব্যস্ত!

কে কাকে স্যার বলবেন?

আমীন আল রশীদ
সভ্য দেশের গণকর্মচারীরা অর্থাৎ জনগণের করের পয়সা যাদের বেতন হয়, তারাই জনগণকে বা সেবাগ্রহীতাকেই ‘স্যার’ বলেন। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টা উল্টো। এখানে সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি তো বটেই, দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীরাও প্রত্যাশা করেন বা মনে করেন যে, সেবাগ্রহীতারাই তাদেরকে ‘স্যার’ বলবেন। শুধু সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষই নন, তথ্যগ্রহীতা সংবাদিকরাও তাদের স্যার বলবেন—অনেকে এটিও প্রত্যাশা করেন। যে কারণে অনেক সময়ই সাংবাদিকরা তাদের ‘স্যার’ না বললে ক্ষেপে যান। যার সবশেষ ঘটনাটি ঘটেছে সুনামগঞ্জে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, স্যার না ডেকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করায় এক সাংবাদিকের উপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফি উল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়ে চলে যাওয়ার পরে ওই সাংবাদিককে ইউএনও শফি উল্লাহ ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কেন ইউএনওকে ভাই বলে সম্বোধন করেছেন? তিনি স্পষ্ট বলে দেন, ইউএনওকে ভাই ডাকা যাবে না। পরে এ বিষয়ে অন্য সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে শফি উল্লাহ বলেন, ‘সাংবাদিক তো আমার আত্মীয় নন, পরিচিতও নন। তাহলে ভাই ডাকবেন কেন?’ শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে নিউজ করা ঠিক হচ্ছে কি না—সে প্রশ্নও তোলেন ওই ইউএনও।
এর আগেও নানা সময়ে ‘স্যার’ না বলায় সরকারি কর্মচারিদের ক্ষুব্ধ বা রুষ্ট হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। গত এপ্রিল মাসেও এরকম একটি ঘটনা ঘটে নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলায়। গণমাধ্যমের খবর বলছে, ইউএনওকে স্যার না বলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর উপরে ক্ষেপে যান স্থানীয় থানার ওসি। শুধু তাই নয়, ওই শিক্ষার্থী ইসলামিক স্টাডিজে পড়েন জানতে পেরে ওসি এমন মন্তব্যও করেন যে, ‘ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট হলো মাইগ্যা ডিপার্টমেন্ট, এখানে তো মাইগ্যারা পড়ে’। প্রশ্ন হলো, একজন পুলিশ অফিসার এ জাতীয় মন্তব্যের সাহস কোথায় পান? তিনি নিজে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন? যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও থাকেন, তাহলে এটি প্রমাণিত যে, তিনি আসলে কিছুই পড়েননি বা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে কিছুই শেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে ব্যর্থতার দায়ভার তাকে যারা পড়িয়েছেন, সেই ‘স্যার’দেরও।
এর আগে যশোরের অভয়নগরের একজন সাংবাদিক ‘ভাই’ সম্বোধন করায় তার দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে আসেন একজন কৃষি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমি একজন বিসিএস ক্যাডার, আমার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানেন না?’ একইরকম ঘটনা ঘটে পাবনার বেড়া উপজেলায়। সেখানেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা খানমকে ‘ম্যাডাম না বলে আপা বলায় স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর উপর ক্ষেপে যান তিনি।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যেসব সরকারি কর্মচারি স্যার সম্বোধন না করলে ক্ষেপে যান, তাদের একটি বড় অংশই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। স্যার না বলায় কোনো জেলা প্রশাসক ক্ষেপে গিয়েছেন, এরকম সংবাদ সাধারণত চোখে পড়ে না। প্রশ্ন হলো, ইউএনওরা কেন ‘স্যার’ না বললে ক্ষেপে যান? তারা কি নিজেদেরকে উপজেলার রাজাবাদশা মনে করেন? তারা কি উপজেলার মানুষকে প্রজা ভাবেন? নাকি সরকারি চাকরিতে যোগদানের পরে ইউএনও হওয়ার পরেই তাদের মনে হয় যে এইবার সত্যিকারের ক্ষমতাবান হয়েছেন অতএব একটু ক্ষমতার চর্চা করা যাক?
প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারিতে এক অনুষ্ঠানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছিলেন, দুদক চায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবেন। তিনি বলেন, এটা খুবই প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক একটি ব্যাপার ছিল। কিন্তু ‘কলোনিয়াল লিগ্যাসির’ ধারাবাহিকতায় আমরা একে অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার করে তুলেছি। ঔপনিবেশিক কায়দায় এ বঙ্গে উল্টো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘স্যার’ বলে সেবাপ্রার্থীর জান জেরবার হয়ে যায়। দুদক চেয়ারম্যান মনে করেন, সরকারি কর্মচারিরা জনগণের কাছ থেকে যে ‘স্যার’ সম্বোধন পেতে চান, এটি একধরনের হীনমন্যতাবোধ। ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটি। সরকারি কর্মচারিদের প্রতি তার প্রশ্ন, আপনাকে যদি অসম্মান না করে কেউ নাম ধরে ডাকেন, তাতে আপনার সমস্যা কী? আপনি তো প্রভু নন। সেবাপ্রার্থী জনগণ আপনার দাস নন।
অস্বীকার করা যাবে না, কিছু মানুষকে সবাই স্বপ্রণোদিত হয়েই ‘স্যার’ সম্বোধন করেন। বিশেষত শিক্ষকদের। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন ইউএনও বা ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা পুলিশ অফিসার যদি মনে করেন যে জনগণ তাদের স্যার বলবে বা বলতে বাধ্য—সেটি ওই কলোনিয়াল মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। তবে সাধারণ মানুষ যদি একজন ইউএনওকে স্যার বলে সম্বোধন করেন, তাতেও দোষের কিছু নেই। এটা মানুষে মানুষে ভিন্ন হতে পারে। কেউ হয়তো স্যার বলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কেউ হয়তো সম্মানার্থেই স্যার বলেন। কিন্তু কোনো পাবলিক সার্ভেন্ট (গণকর্মচারি) যদি নিজেকে ‘কর্মকর্তা’ বা জনগণের প্রভূ ভাবা শুরু করেন এবং তিনি যদি মনে করেন যে, তাকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতে হবে—তাহলে এটি তার মানসিকতার সমস্যা। তিনি আদৌ এই পদের যোগ্য কি না, সেই প্রশ্নটিই বরং তোলা দরকার।
আমাদের দেশের সরকারি কর্মচারী, বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে কর্মকর্তা ও ভিআইপি ভাবতে পছন্দ করেন, তারা যেরকম দাপট ও ক্ষমতা ভোগ করেন, তা বিশ্বের বহু দেশেই অকল্পনীয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি বিষয় এই কল্পনাতীত ক্ষমতাবানরাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করেন। যে কারণে প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে তারা নিজেদের ও নিজেদের পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সরকারে চাকরিজীবীদের সবাই ‘কর্মচারী’। কোথাও ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি নেই। কিন্তু একজন জেলা প্রশাসককে ‘কর্মচারী’ বললে তিনি নিশ্চয়ই চটে যাবেন। এমনকি দ্বিতীয় শ্রেণির কোনও কর্মচারীও নিজেকে কর্মকর্তা বলেন। ২০১৮ সালে যে সরকারি চাকরি আইন করা হয়, সেখানেও লেখা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারী’। অর্থাৎ ‘কর্মকর্তা’ বলে কোনও শব্দ নেই। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের এই কর্মচারীরা কখন থেকে কর্মকর্তা হলেন?
সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব সময়ে জনগণের সেবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। এই বিধানের আলোকে ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী আইনটি করা হয়, যার প্রথম অধ্যায়ের ১৬ ধারায়ও ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ লেখা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি।
সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ—যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা রয়েছে, সেখানেও ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ লেখা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদিযুক্ত পদে অধিষ্ঠিত বা কর্মরত কোনো ব্যক্তি’। এখানেও ‘কর্মকর্তা’ শব্দটি নেই। সংবিধান ও আইনের কোথাও যেখানে কর্মকর্তা বলে কোনো শব্দে নেই, সেখানে সরকারের কর্মচারীরা কীভাবে এবং কোন এখতিয়ারে নিজেদের ‘কর্মকর্তা’ বলে দাবি করেন এবং উল্লেখ করেন—সেই প্রশ্নটিই এখন তোলা দরকার।
সরকারি কর্মচারিদের কাজের ফিরিস্তি নচিকেতা অনেক আগেই গানে গানে দিয়ে গেছেন। নিশ্চয়ই অনেকে গানটি শুনেছেন। যারা শোনেননি তারা ইউটিউবে সার্চ দিয়ে আমি সরকারি কর্মচারি গানটি শুনতে পারেন।
২.
গণকর্মচারি বা পাবলিক সার্ভেন্ট মানে হলো তারা জনগণের সেবক। কিন্তু এই কাজটিকে তাদের কতজন সেবা হিসেবে নিয়েছেন, আর কতজন এই কাজটিকে পয়সা কামানো এবং ক্ষমতা দেখানোর মেশিন হিসেবে বিবেচনা করেন—সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সরকারি কর্মচারিরা যতক্ষণ অফিসে থাকেন, তার মধ্যে সামান্য সময়েই তারা রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বাকি সময় তারা উপরি আয় (ঘুষ), বিদেশ ভ্রমণ, ভালো জায়গায় বদলি এবং নিজেকে সরকারের (সরকারি দলের) লোক হিসেবে প্রমাণের চেষ্টায় (ধান্দায়) থাকেন।
এর একটি বড় কারণ সরকারি কর্মচারিদের জবাবদিহিতার চেয়ে তাদের সুরক্ষায় আইনি কাঠামো অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রতিটি আইনের শেষে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে একটি বিষয় যুক্ত থাকে, যেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, কোনো সরকারি কর্মচারি যদি সরল বিশ্বাসে কোনো অপরাধ করেন তাহলে সেটি অপরাধ বলে বিবেচ্য হবে না। কিন্তু কোন অপরাধটি সরল বিশ্বাসে কৃত আর কোনটি সচেতনভাবে—সেটি কে প্রমাণ করবেন? তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত করেন তাদের সহকর্মীরাই। কালেভদ্রে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়। ফলে খুব বড় বা চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা এবং যেটি নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয় না—এরকম কোনো ঘটনা ছাড়া সরকারি কর্মচারিদের বিরুদ্ধে শাস্তির নজির কম। এর বড় কারণ তাদের বিরুদ্ধে আনীত বা উত্থাপিত অভিযোগের প্রমাণ। বিশেষ করে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করা বেশ কঠিন। এর একটি বড় কারণ, প্রভাবশালীরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও অবৈধ সুবিধা নেয়া বা দ্রুত কাজ করিয়ে নেয়ার স্বার্থে সচেতনভাবে ঘুষ দেন। সুতরাং যিনি ঘুষ দিয়েছেন, কাজ হাসিলের পরে তিনি কখনোই এটি স্বীকার করবেন না বা বলে বেড়াবেন না কিংবা অভিযোগ করবেন না যে, অমুক কর্মচারি তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। বরং ঘুষ নিয়েও যদি কেউ কাজ না করেন বা মোটা অংকের ঘুষ না দিলে কাজ করবেন না বলে জানিয়ে দেন; যদি টালবাহানা বেশি করেন এবং যার সাথে ঘটনাটি ঘটছে তিনি যদি ঘুষ দিতে না চান, সেসব ক্ষেত্রে দুয়েকটি ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিদিন সরকারি অফিসগুলোয় কত শত কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়—তার সত্যিকারের অংকটি জানা গেলে নিশ্চয়ই এটি সারা বিশ্বের জন্যই একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি হবে।
সুতরাং সরকারি কর্মচারিরা নিজেদেরকে স্যার না বললে যে মাইন্ড করেন বা রিঅ্যাক্ট করেন, তার পেছনে জনগণেরও দায় আছে। জনগণের একটি বিরাট অংশই অবৈধ সুবিধা নেয়ার জন্য সরকারি কর্মচারিদের ঘুষ গ্রহণে উসকানি দেন। বিষয়টা এখন দ্বিমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ঘুষ না দিলে সরকারি কর্মচারিরা জনগণকে সেবা দেবেন না এবং জনগণেরও একটি বড় অংশ অন্যের চেয়ে আগে সেবাটি পাওয়ার জন্য এবং অবৈধ সুবিধা নেয়ার জন্য ঘুষ দেন। অর্থাৎ বিষয়টা ‘গিভ এন্ড টেইক’। যে কারণে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ আর ঘুষ শব্দটি বলতে চান না। এটাকে বলেন ‘স্পিডমানি’। অর্থাৎ টাকা দিয়ে দ্রুত কাজ করিয়ে নেয়ার কৌশল। সুতরাং সরকারি অফিসগুলোয় এই যে একটি বিরাট দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে, সেখানে রাষ্ট্রেরও দায় কম নয়। কোনো সরকারই সরকারি অফিসগুলোকে ঘুষমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কালেভদ্রে দুর্নীতি দমন কমিশন দুয়েকটা অভিযান চালালেও এই সংস্থারও বহু লোক দুর্নীতির সাথে জড়িত—এমন অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি অনেক ঘটনা জানাজানিও হয়েছে। সুতরাং শর্ষের ভেতরে ভুত থাকলে ভুত তাড়ানো অসম্ভব। অতএব কে কাকে স্যার বলবেন সেই তর্কের চেয়েও বড় প্রশ্ন, আমরা আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে দেখতে চাই?

ইয়েস স্যার !

মিনা ফারাহ
আমার অভিজ্ঞতায় ‘স্যার’ শব্দটি যতখানি সম্মানের, তার চেয়ে বেশি আত্মঘাতী। প্রথমে ‘স্যার’ শব্দটির ভালো দিক নিয়েই আলোচনা।
স্কুলজীবনে একমাত্র শিক্ষকদেরই ‘স্যার’ বলতাম। ‘স্যার’ মানে সামান্য বেতনে জ্ঞান বিতরণ। সেই সময়ের কথাই বলছি, যখন বেশির ভাগের পরনে ছিল মলিন শার্ট, ধুতি ও পায়জামা। তিনি যা বলবেন, সবাই ‘ইয়েস স্যার’। আজ মনে পড়ছে একজন স্যারের কথা, ডাক্তার না হলেও তার নাম কাননবালা ডাক্তার। রূপের দেবী কাননবালাকে বিয়ে না করার দুঃখে চিরকুমার। অঙ্কে পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও কেন শিক্ষক হননি, জানি না। তবে বিপদ হলো আমার। এমনিতেই সকালে-বিকেলে প্রাইভেট মাস্টার। তার ওপর অতিরিক্ত আপদ ‘কাননবালা স্যার’। জোর করেই বিনা বেতনে অঙ্ক শেখাবেন। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গোপনে অনেক গালিগালাজ করতাম। এখন মনে হয়, স্যার বেঁচে থাকলে তার পা দুটো মাথায় রাখতাম। কারণ, যা কিছু শিখেছি তাদের কাছ থেকেই। তার মতো অনেক স্যারের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
পরবর্তীকালে যাদের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলাম, বাইরের ‘স্যার’দের সঙ্গে ক্লাসরুমের স্যারদের আকাশ-পাতাল তফাত। ৯৯ ভাগই দাম্ভিক, অসৎ, বদমেজাজী, বৈষম্যবাদী, সুবিধাভোগী, ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, নারীবাজ… এদের সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত। ‘স্যার’ শব্দের বাইরে অন্য কোনো সম্বোধনকে তারা সহ্য করে না। দারোয়ান, বুয়া, চাকর, ড্রাইভার, কেরানি, হেলপার… নাতির বয়সী হলেও বলতে হবে ‘স্যার’। বাপের বয়সী দারোয়ানের মুখেও ‘স্যার’। দাঁড়াতে হবে স্যারকে দেখামাত্রই। বাবা না ছেলের বয়সী- সেসব বিবেচ্য নয়। পরবর্তীকালে ‘স্যার কালচারের’ সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলাম। অফিস-আদালতে ‘নো স্যার’ বলে কোনো শব্দ নেই। আমার কাছে যার এক পয়সাও মূল্য নেই, কাজ আদায়ে তাকেও বলতে হতো- ‘ইয়েস স্যার’। বসেরও বস আছে। দেখামাত্র স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে বলতে হয়- জি স্যার, ইয়েস স্যার।
রাজনীতিবিদ ‘স্যার’দের উচ্চতা আরো ভয়ানক। পদ-পদবিতে বিরাট হলে হিমালয়ের উচ্চতাকেও ছাড়িয়ে যায়। আবার আছে রাজনৈতিক-সাংবাদিক। তাদের কথা কত লিখব! ওমুক ভবনের ইয়েস স্যার প্রেস কনফারেন্স দেখতে থাকুন। হাত কচলাতে কচলাতে পারলে ইয়েস স্যারের সামনে মাটিতেই গড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ইতোমধ্যে গোপাল ভাঁড়ের শূন্যস্থান পূরণ করেছেন।
স্যার মানসিকতার আরো নমুনা। ভাবুন, বসের স্ত্রীকে দারোয়ান বলছে- হ্যালো, মিসেস আমেনা। গুডমর্নিং। কেমন আছেন? নাশতা নিয়ে বসের স্ত্রী এবং বাড়ির বুয়া এক টেবিলে। আপনার ড্রাইভার নবাবের মতো সিটে বসে আছে, আর আপনি নিজেই দরজা খুলে গাড়িতে উঠছেন! এরপর ভাবুন, রেস্টুরেন্টের পার্কিংলটগুলোতে গাড়ি রেখে প্রত্যেকের ড্রাইভারই স্যারের পরিবারের সঙ্গে চাইনিজ বা পিজা রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে খাচ্ছে। ম্যাডামের হাত-পা, কোমর মালিশের বদলে, বন্ধুর মতো গল্প করছে। জানি, এসব কল্পনা। তবে গাড়ির পেছনে বসে যখন ঢেঁকুর তোলেন বস, ‘ইয়েস স্যার’ ড্রাইভাররা ফ্রাইড চিকেনের গন্ধ ঠিকই পায়।
১৯৮০ সালে আমেরিকায় আসার পরই দেখলাম, ‘স্যার’ বলে কোনো শব্দ নেই; বরং ইয়েস স্যার বলাই বিপজ্জনক। প্রমাণ হলে জেল-জরিমানা পর্যন্ত গড়ায়। অর্থাৎ, ইয়েস স্যারের শূন্যস্থান পূরণ করেছে আইনের শাসন। সে জন্য রয়েছে শতভাগ নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ। ঘুষ দেয়া-নেয়ার প্রমাণ পেলে, কত বড় ইয়েস স্যার, আদালতের কাছে তা বিবেচ্য নয়; বরং ইয়েস স্যারের তলে যে অপরাধ, সেটাই বিবেচ্য। গত সপ্তাহে সাবেক নিউ ইয়র্ক অ্যাটর্নি জেনারেলের শাস্তি হলো ১০ বছরের জেল। অপরাধ, তিন লাখ ডলার ঘুষ গ্রহণ। একসময় ‘স্যার’ কালচারটি এখানেও ছিল।
বলছি, বিলুপ্ত স্যার বনাম দাসপ্রথা। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের নিষ্ঠুরতার ওপর অনেক ছবি করেছে হলিউড। আফ্রিকা থেকে শিকল পরিয়ে জাহাজে করে এনে পশ্চিমের খোলাবাজারে গরু-ছাগলের মতো বেচাকেনা। বিনা বেতনে ২০ ঘণ্টাই গরুর মতো খাটানো হতো। পালিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখালে ফাঁসিতে লটকানোর আগে ওই এলাকার সব স্লেইভমাস্টারকে খবর দেয়া হতো। তারাও তাদের ক্রীতদাসদের এনে শাস্তি দেখিয়ে ভয় দেখাত। মেয়েদের যত খুশি ধর্ষণ করত। কাজে যেতে না চাইলে সাঁড়াশি দিয়ে টেনে দাঁত তুলে ফেলত। তখন ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার বলে চিৎকার করলেও রক্ষা পাওয়া সম্ভব হতো না। ড. মার্টিন লুথার কিং-সহ অ্যাক্টিভিস্টদের প্রতিবাদের কারণেই স্যার প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত হয়েছে। পরবর্তীকালে ‘সিভিল রাইটস অ্যাক্ট’ আইন পাস হয়েছে।
অবস্থান, পদ-পদবি, সাদা-কালো, মিলিয়নিয়ার, নি¤œবিত্ত… ‘স্যার’ শব্দটি এ দেশে কতটা অপ্রয়োজনীয়, বিএনপি-আওয়ামী লীগ যাই হোক, প্রত্যেক প্রবাসী বাংলাদেশীরই তা জানা। বড়জোর মিস্টার ওমুক, মিসেস তমুক। অনেকেই বসকে নাম ধরে ডাকে। বস ও কর্মচারী এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খায়। এক লাইনে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করে। প্রেসিডেন্টের নামের সঙ্গে বিশেষণ অনুপস্থিত। জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের নাম সারা বছরে একবারও উচ্চারণ করা হয় কি না সন্দেহ। বেশির ভাগ লোকই বলেন মি. প্রেসিডেন্ট! অনেকেই নাম ধরে উল্লেখ করেন। যেমনÑ মি. বুশ একজন ওয়ার ক্রিমিনাল। কিংবা ট্রাম্প একটা পাগল, ইডিয়ট, সন্ত্রাসী। পূজনীয়, মাননীয়, দেশবরেণ্য, দেশনেতা, ফাদার অব ডেমোক্র্যাসি প্রভৃতি বিশেষণ যুক্ত না করায় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির প্রেসিডেন্টের সম্মান কমে কি না, বলবে একমাত্র বাংলাদেশীরাই। কারণ, তারাই এখন পর্যন্ত ব্রিটিশের পয়দা করা কলোনিয়াল মানসিকতাকে জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে আছে। ষাটের দশকে খান সাহেবদের মুখের ওপর ‘না’ বলা জাতি যেভাবে মাত্র ১০ বছরে একটি পরিপূর্ণ ‘ইয়েস স্যারের’ জাতিতে রূপান্তরিত হলো, সেটাই আজকের বিষয়।
কাউকে স্যার বলার মানে, তিনি উঁচু- অন্যজন নিচু। তিনি মুনিব- অন্যজন ভৃত্য। কলোনিয়াল মানসিতার ডিকশনারিতে ব্যাখ্যা এটাই। অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশের আনা দাসপ্রথায়, মুনিব-চাকরের কৃত্রিম পার্থক্য, ভারতীয়দের মনোজগতের ব্লুপ্রিন্ট পাল্টে দিয়েছে। পরবর্তীকালে ‘স্যার’ শব্দটি সমাজ ও রাজনীতিকে আরো বেশি শৃঙ্খলিত করেছে। পরবর্তীকালে ‘কমনওয়েলথ’ নামের সার্কাস সৃষ্টি করে দেশে দেশে অদৃশ্য দাসত্ববাদ টিকিয়ে রেখেছে ব্রিটিশরা। এ কারণে ব্রিটিশশাসিত দেশগুলোতে ‘নো স্যার’ শব্দটি বিরল।
পৃথিবীতে কেউ কারো দাস বা প্রভু নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শুরু থেকেই প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর মাধ্যমে ক্ষুদ্রতার প্রমাণ দিয়ে গেছে। অসীম ক্ষমতাধরদের অন্যতম ইরানের শাহ, ফিলিপাইনের মার্কোস, হাইতির পাপাডক- প্রত্যেকেই চুরির টাকায় সুইস ব্যাংক ভরে ফেললেও শূন্য হাতেই গেছেন। এখনো যারা চুরির টাকায় অফশোর ব্যাংক ভরে ফেলছেন, তালিকার প্রত্যেকেই শূন্য হাতেই যাবেন। ইরানের শাহ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, ফিলিপাইনের মার্কোস… স্ট্যাচুগুলো কোথায়?
ব্রিটেনের রানী প্রতি বছর কিছু গুণীজনকে কেন ‘স্যার’ উপাধি দেন, বোধগম্য নয়। যারাই স্যার রিচার্ড ব্রানসনের মতো সাকসেসফুল, বড়জোর দু-চার প্রজন্ম মনে রাখবে। তাদের স্টিভ জবের মতো যারাই যুগের ব্লুপ্রিন্ট পাল্টে দিয়েছেন, অনেক প্রজন্ম মনে রাখবে। কিন্তু জীবনের শক্তি দিয়ে যারাই প্রকৃত মানুষ হওয়ার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, অনন্তকাল তারাই থাকবেন। তাদের ‘স্যার’ বলি না, বলি মহামানব। মহামানবদের বেশির ভাগেরই স্ট্যাচু নেই। যাদের আছে, ভক্তরা স্ট্যাচু দিয়ে রাস্তাঘাট দখল করে না। আইন বানিয়ে গুরুর ছবি ঝোলাতে বাধ্য করে না। ভগবানের ছবি ব্যাগে ভরে বিদেশে নিয়ে প্রচার করে না; বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ধর্মাঙ্গনে গিয়ে যিশুর স্ট্যাচুকে সম্মান দেখায় খ্রিষ্টানরা। এতে ভক্তরাও খুশি। বলছি, স্ট্যাচুর সামনে দিনরাত ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার চিৎকারের কালচারÑ টোটাল রাবিশ। এ ধরনের মানসিকতা নিতান্তই স্থূলবুদ্ধির পরিচায়ক।
২০০ বছরের ‘ইয়েস স্যার’ এপিডেমিক থেকে গত ১০ বছরে সুপার এপিডেমিক। উদাহরণস্বরূপ, বস হুকুম করলেন, লগি-বৈঠা-গানপাউডার নিয়ে রাস্তায় নামতে হবেÑ এ রকম অমানবিক উদাহরণগুলো গত ১০ বছরে রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেও ইয়েস স্যারদের ভয়ে সবার জিহ্বায় তালা। অন্যায় হতে দেখেও ছাত্র থেকে শিক্ষক, সবাই ইয়েস স্যার, জি স্যার। সর্বশেষ, সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে রক্তাক্ত করা দেখেও ইয়েস স্যার লীগ এবং তার অভিভাবক চুপ। এ বিষয়ে একজন রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীর ইয়েস স্যার ভিডিওটি ভাইরাল। বিষয়টি এমন পর্যায়ে, বস যদি বলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক আমি, উত্তরে বলবেÑ ইয়েস স্যার।
দীর্ঘ দিন ধরে ব্রিটিশের ‘ইয়েস স্যার’ মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি। বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গন এবং যুবসমাজের মনোজগতের ওপর রাজনীতিবিদদের সর্বোচ্চ হামলার প্রতিবাদ করেই চলেছি। ‘আমিত্বহীন আমিত্ববাদীরা’ কখনোই মানুষ তৈরি করতে পারবে না। কারণ, তাদের ভেতরে আমির বদলে অমানুষের জায়গাই বড়। আমি হতে চাইলে আমিত্ব থাকতে হবে।
অস্ত্র নয়, এই হামলা কলোনিয়াল মানসিকতা দিয়ে মস্তকের ঘিলুকে পোঁচ বানিয়ে ফেলা। ঘিলু থাকলেও মাথা নষ্ট। খালি কলস বাজে বেশি। এ কারণে দেশটি নাৎসি জার্মানির মতো দ্বিখণ্ডিত। এত বড় হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস বোধহয় এই শতাব্দীতে একটাই। কারণ, এই ক্রাইসিসের ভুক্তভোগী ১৭০ মিলিয়ন মানুষ। ইয়েস স্যারের অভিশাপে অভিশপ্ত আমরা, হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে’, নয় ‘রাজাকার’। মাহমুদুর রহমানকে রক্তাক্ত করার কারণ সেটাই। অন্যথায়, আদালতের ভেতরে কেউ কি রক্তাক্ত হয়? তাকে ঘিরে থাকা পুলিশের নীরব দর্শকের ভূমিকাও ইয়েস স্যারের অভিশাপে অভিশপ্ত।
ই-মেইল : farahmina@gmail.com ফেসবুক : minafarahfacebook ওয়েবসাইট : www.minafarah.com
 

কে কাকে স্যার বলবে?

‘ম্যাডাম না বলে আপা বলায়’ সম্প্রতি স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর উপর ক্ষিপ্ত হন পাবনার বেড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা খানম। তখন ইউএনও সাংবাদিককে বলেছিলেন, আপনি কতদিন ধরে সাংবাদিকতা করেন। আপনি জানেন না একজন ইউএনওকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কে কাকে স্যার বলবে?’ শিরোনামে ফেসবুকে লিখেছেন সাংবাদিক জিয়া হাসান। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন,
“একটি পোস্টে দেখলাম এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ম্যাডাম সম্বোধন না করায় এক সংবাদ কর্মী বাজে আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন। ব্যাপারটি দুঃখজনক এবং আরও দুঃখজনক হল এমন ঘটনা প্রায়ই পত্রিকায় আসে। এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা দরকার সরকারের পক্ষ থেকে। আমাদের রাষ্ট্রটি গণপ্রজাতন্ত্রী। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জনগণ স্যার-ম্যাডাম সম্বোধন করবে নাকি প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণকে (যারা সকল ক্ষমতার উৎস) প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীগন স্যার সম্বোধন করবে? নাকি উভয় উভয়কে করবে?
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা যার বয়স পঞ্চাশের কোঠায় তাকে স্যার/ম্যাডাম সম্বোধন করা যেতেই পারে, তার বয়সের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং এটা দুপক্ষের বেলাতেই প্রযোজ্য। আমরা রাস্তা ঘাটে বয়স্ক কাউকে দেখলে সালাম দেই, মুরুব্বি কিম্বা চাচা সম্বোধন করি, এটা তারই প্রতিফলন। কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক কিছু নয়, সৌজন্যতা এবং আদব-কায়দার অংশ। উন্নত বিশ্বে এটার প্রচলন সবচেয়ে বেশি।
মাঝ বয়সী থেকে সিনিয়র সিটিজেনদের পুলিশ থেকে শুরু করে অফিস আদালত, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট সর্বত্র সাধারণত স্যার সম্বোধন করা হয়, তাদের বয়সের প্রতি সম্মান জানিয়ে। পঞ্চাশের খুব কাছে চলে আসায় আমারও এই অভিজ্ঞতাটি হয় কানাডাতে। বাংলাদেশে দু-একজন সরকারি কর্মকর্তার ভাব দেখলে মনে হয়, এরা লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন পরিবার থেকে এসেছে। গরিব দেশে অন্যতম সেরা চাকরী বিসিএস অফিসার হয়ে গেলে একশ জনের মধ্যে একজনের এই ভাব হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর জন্য দায়ী নৈতিকতা সমৃদ্ধ প্রকৃত শিক্ষা এবং উপযুক্ত পারিবারিক শিক্ষার অভাব।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো এখন শিক্ষার্থী নয়, পরীক্ষার্থী নিয়ে ব্যস্ত। তাদের এ+ পাওয়াতে হবে। সন্তানকে নিয়ে সন্ধ্যা কাটান, পড়ালেখার খোজ নেয়া, একসাথে খাওয়া এবং গল্প করা এই বাবা-মাদের সংখ্যা ক্রমেই ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। পারিবারিক মূল্যবোধ, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সন্তান। এর প্রতিফলন ঘটছে পরবর্তীতে। তবে এই ভাবটা অন্য অংশের বেলাতেও প্রযোজ্য। জনসাধারণের একটী অংশ যখন দুর্নীতি করে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হয়, তখন তারাও রায় বাহাদুর চৌধুরীর হাব-ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং ধরা কে সরা জ্ঞান করে। আদব- কায়দা, সম্মান, পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মীতা ইত্যাদি শেখার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হল বাড়ি তথা পরিবার। আপনি যখন অন্যকে সম্মানিত করছেন তখন আপনি আসলে নিজেকেই সম্মানিত করছেন ।
একবার টাঙ্গাইলে এসপি সাহেবের অফিসে বসে তাঁর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় একজন দিনমজুর ভাই রুমে প্রবেশ করে সালাম দিলেন, এসপি সাহেব উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই,আপনি খালি পায়ে ঢুকলেন কেন? আমিও তখন লক্ষ্য করলাম লোকটি খালি পায়ে। স্যার, এমনিতেই।
কেউ আপনাকে খালি পায়ে ঢুকতে বলেছে?
না, স্যার।
যান, জুতো পড়ে আবার আসেন।
লোকটি পুনরায় প্রবেশ করলে, এসপি সাহেব সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “এখানে বসেন, এবং বলেন আপনার কি সমস্যা।”
এই নিরীহ লোকটিকে সম্মানিত করে এসপি সাহেব কি নিজেকেই সম্মানিত করলেন না? এই লোকটি যতদিন বেঁচে থাকবে, শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা নিয়ে এই পুলিশ সুপারকে মনে রাখবে।

ঊর্ধ্বতন নারী সহকর্মীকে “স্যার” বলার সংস্কৃতি!!!

ড. মুন্সী মুর্তজা আলী
নিম্নপদের নারী ও পুরুষ সকল সহকর্মী নির্বিশেষে তাদের ঊর্ধ্বতন নারী সহকর্মীকে “স্যার” বলে সম্বোধন করার সংস্কৃতি আগে কখনো চালু ছিল না। কিন্তু ইদানীং বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি চালু হয়েছে। “স্যার” একটি পুরুষ লিঙ্গবাচক শব্দ। যার বাংলা অর্থ জনাব বা মহাশয়। স্যার এর স্ত্রীলিঙ্গ করলে অর্থ দাঁড়ায়, “মিস” বা “ম্যাডাম”। মিস ও ম্যাডাম দুটোই ইংরেজী শব্দ। অথচ আমাদের মানসিক ধারণা এমন হয়ে গিয়েছে যে, আপা বলার পরিবর্তে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করলে অধিকাংশ মহিলারা গর্ববোধ করেন। মিস ও ম্যাডামের অর্থের মধ্যেও ভিন্ন অর্থ লুকানো আছে। মিস মানে কুমারী। যদিও উন্নত দেশে অফিসিয়ালী ও আনঅফিসিয়ালীভাবে বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলাদেরকেও মিস বলে সম্বোধন করে থাকে। আর আমাদের দেশে ম্যাডাম বলতে আগে বিবাহিত মহিলাদেরকে বোঝাতো।
এখন সেখান থেকে মনেহয় আমরা একটু সরে এসেছি। মূলত ম্যাডাম অর্থ সম্ভ্রান্ত রমণীকে ভদ্রতাসূচক সম্বোধন, যাকে বাংলায় বলে ভদ্রমহিলা। সম্ভারন্ত রমণীকে তো আর “ভদ্রমহিলা” বলে ডাকলে শ্রুতিমধুর শোনা যায় না। তাই সম্ভ্রান্ত রমণীকে কিংবা উচ্চস্তরের চাকুরীজীবী মহিলাকে ম্যাডাম বলে ডাকায় অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করা হয়। যদিও আপা বলেও সম্বোধন করলেও শ্রেয় হয় এবং অনেকে তা করেও।
আমাদের বাংলাদেশের কালচারটা হলো এরকম। স্কুলের শিক্ষিকাকে আমরা আপা বলে ডাকি। আর কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাকে ম্যাডাম বলে ডাকি। এখন অবশ্য বেশীরভাগ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা মহিলা শিক্ষিকাদের ম্যাডাম বলার পাশাপাশি ম্যাম বলেও ডাকে। এখন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্র বা ছাত্রী যদি তার শিক্ষিকাকে ম্যাডাম বা ম্যাম না বলে স্যার বলে সম্বোধন করে, তাহলে আমি শতভাগ নিশ্চিত যে সেই শিক্ষিকা বির্বত বোধ করবেন। কারণ, মহিলা শিক্ষিকরা এখনো সৃষ্টিশীল বাঙালি ঐতিহ্য ধারণ করে আছেন।
এখানে আপা থেকে ম্যাডাম কথাটি যেন আমরা বেশী প্রেস্টিজিয়াস মনে করছি। কারণ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদেরকে আমরা বেশী শিক্ষিত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বলে মনে করছি। যেহেতু তাঁরা মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। অবশ্য সাম্প্রতিককালে অনেক প্রাইমারী ও হাইস্কুলের বেশীরভাগ শিক্ষক শিক্ষিকাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। শিক্ষক শিক্ষকই। সে যে কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বা শিক্ষিকাই হোক না কেন। সকল শিক্ষকের মর্যাদা সমান। কারণ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সে তার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষককে সবসময়ই মর্যাদা প্রদান করে থাকে। অথচ বেশীরভাগ মানুষের ভাবনা এরকম তা হলো, প্রতিষ্ঠানভেদে শিক্ষকদের মর্যাদা ভিন্ন ভিন্নভাবে ভাবা। এটা একটা আমলাতন্ত্রিক মানসিকতা ছাড়া কিছুই নয়।
এদিকে আমাদের দেশের সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে ঊর্ধ্বতন মহিলা কর্মকর্তাকে (মহিলা কর্মকর্ত্রী) তাদের অধঃস্তন কর্মকর্তারা বা কর্মচারীরা স্যার বলে সম্বোধন করেন। শুধু তাই নয়, মাঠ পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত মহিলা কর্মকর্তাদেরকে নাকি এলাকার লোকজন যেয়ে স্যার বলে সম্বোধন করেন। তা না করলে নাকি অনেক মহিলা কর্মকর্তা মন খারাপ করেন অর্থাৎ বিব্রতবোধ করেন। এমনকি রাগও করেন। এখন নাকি রেওয়াজ হয়ে গেছে সকল মহিলা কর্মকর্তাদেরকে স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। আমার কাছে বিষয়টি একটু চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁয়িয়েছে। আমার মনে হয়, একজন মহিলা কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন করলে তো সেই মহিলা কর্মকর্তারই বিব্রতবোধ করা উচিত। অথচ সে বিব্রতবোধ না করে তুষ্ট হচ্ছেন। সব মহিলা কর্মকর্তারাই কি তুষ্ট হন? আর সব মহিলা কর্মকর্তারাই কি বিব্রত হন? এ নিয়ে আমার মনে দ্বীধা আছে। আমার ধারনা এতে সবাই তুষ্ট হন না। হয়তো কেউ কেউ বিব্রতও হন।
মহিলা কর্মকর্তাকে স্যার বলে সম্বোধন করে প্রকারান্তরে মহিলাদেরকে সম্মান করার বদলে শুধু অসম্মান করাই নয় তাদেরকে অপমান করা হচ্ছে বলেই আমার মতামত। নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক পুরুষ ও
নারীরই স্বাত্যন্ত্রবোধ আছে। কিন্তু যখন কোন নারী কর্মকর্তাকে ম্যাডাম না বলে স্যার বলা হয়, তখন এটা পুরো চাকুরীজীবী নারী সমাজের জন্য বিব্রতকর বিষয় হওয়া উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি। নারী কর্মকর্তাকে স্যার বলার মাধ্যমে নারীকে তার প্রাপ্য “নারী অধিকার” থেকে বঞ্চিত করার পুরুষ শাসিত সমাজের আরেকটি কৌশল বলেই আমি মনে করি। এতে নারী কর্মকর্তাদের তুষ্ট হওয়া বাতুলতা মাত্র। আশাকরি আমাদের বোধোদয় হবে।
পরিশেষে শরৎ চন্দ্রের একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। সোনাকে রুপা মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দিলে, সোনা কখনো রুপা হয়ে যায় না। আর রুপাকে সোনা মনে করে সিন্দুকে তুলে রাখলেও রুপা কখনো সোনা হয়ে যায় না। আমাদের তথাকথিত নারীবাদী পুরুষেরা নারীকে রুপা মনে করে সোনার সিন্দুকে আটকে রেখে নারীকে মিছে নারী অধিকারের গোলক ধাঁধায় ফেলতে চায়। নারীদেরকে “স্যার” বলে ডাকার রেওয়াজ সৃষ্টি নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির পরিবর্তে নারীর মর্যাদা হানি ও অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই না।
ড. মুন্সী মুর্তজা আলী, অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
 

আপনি তাদের চাকর নন, তারাই বরং আপনাদের চাকর

ফরিদ কবির
আমি সম্ভবত কিছুটা আজন্ম বেয়াদব। এ জীবনে খুব কম মানুষকেই আমি ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছি। খুব অল্প বয়সে, এমনকি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ‘স্যার’ সম্বোধন করতাম না। যেমন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কায়সার হক-তাদেরকে ‘ভাই’ বলেই সম্বোধন করতাম। নিজের বিভাগের শিক্ষকদেরকে আর অন্য বিভাগের খুব সিনিয়র শিক্ষকদেরকেই কেবল ‘স্যার’ বলতাম। যেমন, কবীর চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করতাম। আবার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে অনেকে ‘স্যার’ ডাকলেও আমি ‘সায়ীদ ভাই’ বলেই ডাকতাম।
সে সময় সরকারি যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে মিশেছি, তাদের অনেকে সচিব পদমর্যাদার হলেও (যেমন, মনযুর-উল করিম, মোফাজ্জল করিম, এটিএম গিয়াসউদ্দিন, এজেডএম শামসুল আলম) তাদেরকে তখন ‘ভাই’ বলেই সম্বোধন করতাম। কখনো পুলিশ বা আমলাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করিনি। এখনো তাই করি।
কেবল আমার অফিসে আমাদের সভাপতি ও মহাসচিবকে ‘স্যার’ সম্বোধন করি। এছাড়া আরও দু’-একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ বলি। আমার এক সিনিয়র সহকর্মী তাদেরকে এভাবে সম্বোধন করতেন বলেই আমিও করতে বাধ্য হয়েছি, বলা যায়। নইলে অন্য অনেকের মতো তাদেরকেও ‘ভাই’ বলেই সম্বোধন করতাম। অল্প বয়সেই সম্ভবত আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সকলকে ‘স্যার’ সম্বোধন করা যায় না। করা ঠিকও না।
আমাদের দেশে ক্ষমতাশালী হলে, বিশেষ করে, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদেরকে অনেকেই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। পুলিশ হলে তো কথাই নেই। সাধারণ এসআই-দেরকেও অনেকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। এই সম্বোধন পেতে পেতে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশরা ধরেই নেন তারা সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি কিছু। কেউ কেউ হয়তো মনে করেন, তারাই জনগণের মালিক!
করোনাভাইরাসের কারণে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছেন। জরুরি অবস্থা নয়। যে কোনো জরুরি দরকারে মানুষ রাস্তায় বেরোবে। কেউ দুটো পয়সা কামানোর জন্য, কেউ জরুরি পণ্য কেনার জন্য। কোনো পুলিশ, কোনো সেনা সদস্য, কোনো সরকারি কর্মকর্তারই অধিকার নেই রাস্তায় কোনো মানুষকে অযথা হেনস্তা করার। অকারণে একাধিক লোক বাইরে যাতে আড্ডা না দেয়, জমায়েত না হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করাই তাদের কাজ।
কিন্তু তারা তো নিজেদেরকে ‘স্যার’ অথবা ‘ম্যাডাম’ ভেবে বসে আছেন! এই সম্বোধনের কারণে তারা নিজেদেরকে ‘বিশেষ কিছু’ মনে করে বসেন। এই মানসিকতাটাই সমস্যার।
এই যে একটা পুঁচকে মেয়ে, সহকারী কমিশনার হয়েই নিজেকে জনগণের মালিক ভাবতে পারছে, সেটার জন্য দায়ী এই সম্বোধন। আর আমাদের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা। অভাব প্রকৃত শিক্ষারও।
আপনি থানায় গিয়ে একজন পুলিশকে ‘স্যার’ বললে এক ধরনের আচরণ পাবেন। আর না বললে আরেক রকমের আচরণ পাবেন। আমলা বলেন, আর পুলিশ বলেন এরা সকলেই শক্তের ভক্ত, নরমের যম। একজন দরিদ্র মানুষের সঙ্গে তারা যে আচরণ করে তা কিন্তু একজন ভালো জামাকাপড় পরা আমার মতো উদ্ধত মানুষের সঙ্গে করবে না। আপনাকে নরম পেলেই আপনার ওপর তারা সওয়ার হবে। এ সুযোগ কখনোই তাদেরকে দেয়া উচিত নয়। আমি অন্তত দিই না।
আপনারাও দেবেন না। বয়সে ছোট হলে তাদেরকে সোজা নাম ধরে ডাকবেন। বয়সে বড় হলে বড়জোর ‘ভাই’ বলতে পারেন। অথবা নামের সঙ্গে যোগ করতে পারেন ‘সাহেব’! নো ‘স্যার’!
নিজের শিক্ষক বা শিক্ষকতুল্য মানুষকে এই মর্যাদা দেবেন। আর, বড় জোর, নিজের প্রতিষ্ঠানের বসকে। (এটা আমাদের দেশের করপোরেট সংস্কৃতির অংশ। চাইলেও বাদ দিতে পারবেন না)। এর বাইরে আর কাউকে ‘স্যার’ ডাকা একেবারেই উচিত না।
আর, আমলা বা পুলিশদের তো নয়ই। আপনি তার অধীনে চাকরি না করলে কেন তাকে খামোখা ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ ডাকতে যাবেন? আপনি তাদের চাকর নন। সংবিধান অনুযায়ী তারাই বরং আপনাদের চাকর। কেউ আপনার ওপর আঙুল বা লাঠি তুললে তার আঙুল ভেঙে দিন। লাঠিটাও। আপনার কোনো অন্যায় হলে তার শাস্তি আদালত নির্ধারণ করে দেবে। কোনো শারীরিক নির্যাতন করার অধিকার পুলিশ বা আমলাদের নেই। নেই কোনো রকম অমর্যাদা করার অধিকারও।
রাস্তায় বা অন্য কোথাও সাধারণ মানুষের ওপর কোনো অন্যায় আচরণ ঘটতে দেখলে প্রতিবাদ করুন। না পারলে সেটার ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করুন। ছড়িয়ে দিন সর্বত্র। আজ যে সহকারী কমিশনারের শাস্তি হলো, সেটা কিন্তু ফেসবুকে ব্যাপক প্রতিবাদের কারণেই।
লেখক: সাংবাদিক বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন
 

গণকর্মচারীরা কেন গণমানুষের বিরুদ্ধে?

আমীন আল রশীদ
 
‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক।’
যারা প্রজাতন্ত্রের চাকরি করেন, অর্থাৎ জনগণের করের পয়সায় যাদের বেতন হয়; এই আমলে যারা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তারা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি হয় শোনেননি অথবা পড়েননি, কিংবা পড়লেও এর অর্থ বোঝেননি। বুঝলে নিয়মিত বিরতিতে এই গণকর্মচারীদের গণবিরোধী কর্মকাণ্ড সংবাদ শিরোনাম হতো না। বুঝলে এই গণকর্মচারীদের একটি অংশের কর্মকাণ্ড তাদেরকে ক্রমশই গণশত্রুতে পরিণত করত না।
কুড়িগ্রামের একজন জেলা প্রশাসকের ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের খবরের রেশ না কাটতেই এবার একইভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় তুললেন যশোরের মনিরামপুর উপজেলার একজন সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড)। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যখন সারা দেশে লকডাউন চলছে, তখন রাস্তায় বের হবার ‘অপরাধে’ বাবার বয়সী লোকদের প্রকাশ্যে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন সাইয়েমা হাসান নামে ওই এসি ল্যান্ড। সংবিধান (অনুচ্ছেদ ২১, ১২০, ১৩৪, ১৫২) অনুযায়ী তিনি ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি’ (কর্মকর্তা নন)। এবং আইনের (সরকারি চাকরি আইন ২০১৮) ভাষায় ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’। কিন্তু সংবিধানের ক্ষমতাবলে প্রজাতন্ত্রের মালিক যে জনগণ, যাদের করের পয়সায় তার বেতন হয়, সেই জনগণের একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশের সঙ্গে তিনি যে আচরণ করলেন, সেটি স্পষ্টত সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন তো বটেই; মানবাধিকারেরও লঙ্ঘন। এরইমধ্যে ওই কর্মচারীকে প্রত্যাহারের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু, এটি কোনো শাস্তি কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
নাগরিকদের কান ধরিয়ে ওঠবস করানোর ঘটনা এটিই প্রথম নয়। সবচেয়ে বেশি সমালোচনার ঝড় তুলেছিল নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তর ঘটনাটি। স্বয়ং একজন সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে ঘটনাটি ঘটেছিল। ওই ঘটনায় কোনো বিচার তো দূরে থাক, উল্টো শিক্ষক শ্যামল কান্তির জীবনই বিপন্ন হয়েছিল। এরপরে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুলিশও সাধারণ মানুষকে কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়েছিল। সেজন্য ওই মন্ত্রী বা পুলিশ ক্ষমা চাননি। ফলে আজকে সাইয়েমা হাসান যা করলেন, তা অতীতের ওইসব ঘটনারই লিগেসি।
সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে: ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ এই বিধান অনুযায়ী, মনিরামপুরের এসি ল্যান্ড সাইয়েমা স্পষ্টভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন এবং এ কারণে এটি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮’রও লঙ্ঘন। তৃতীয়ত, তিনি নিজে একটি ভয়াবহ অপরাধ করে সেই ঘটনার ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছেন এবং সেই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেছে। ফলে এটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধান মতেও অপরাধ। যদিও এই আইনটি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে এবং বলা হয়, এই আইনটি করা হয়েছে নাগরিকদের হয়রানি করতে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো, এই আইনে প্রথম শাস্তি পেয়েছেন একজন সরকারি কর্মচারীই। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের জবানবন্দি রেকর্ড করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়ে আট বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে।
আশার সংবাদ হলো, সাইয়েমা হাসানের ঘটনায় সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ প্রশ্ন বহুবার উঠেছে যে, প্রত্যাহার বা ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা ওই অর্থে কোনো শাস্তি কি না? কারণ এই প্রত্যাহারকালীন কিংবা ওএসডির সময়কালে কারো বেতন বন্ধ হয় না। পুলিশের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। কারো বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলেও তাকে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু, তিনি বেতন পেতে থাকেন।
ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম কিংবা কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীন অথবা সবশেষ মনিরামপুরের এসি ল্যান্ড সাইয়েমা হাসানের দুর্ভাগ্য বলতে হবে এ কারণে যে, তারা যেসব অপরাধ করেছেন, তা তাদের আরও অনেক সহকর্মী নিয়মিতই করে থাকেন। কিন্তু, যেহেতু সব ঘটনার ছবি থাকে না, ফলে তাদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা হয় না। এখন অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোনো অপরাধের ছবি না থাকলে তার বিচার হবে না। সিলেটেরে শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ছিল, অতএব দেশের ইতিহাসে দ্রুততম সময়ের (১৭ কার্যদিবস) মধ্যে সেই ঘটনার বিচার হয়েছে। একই কারণে সিলেটে খাদিজা আক্তার নামে এক কলেজছাত্রীকে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টা মামলারও বিচার হয়েছে। কিন্তু, কুমিল্লায় সেনানিবাসের ভেতরে কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যা কিংবা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার যেহেতু কোনো স্থির বা ভিডিওচিত্র নেই, অতএব এগুলোর বিচারও নেই।
কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনে বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়েছে দুটি কারণে: ১. তার নির্দেশে একজন সাংবাদিকের বাসায় গিয়ে প্রশাসনের কিছু ‘ক্যাডার’ মধ্যরাতে কথিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কথিত মাদক রাখার দায়ে শাস্তি দিয়েছেন এবং এর বিরুদ্ধে তিনি যে সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই তার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল; ২. এ ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছিল। এই একই ঘটনা যদি স্বল্প পরিচিত কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে ঘটত এবং তার প্রতিষ্ঠান যদি শুরু থেকেই তার পক্ষে শক্ত অবস্থান না নিত এবং সেটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় না হতো, তাহলে ডিসি সুলতানা তার সালতানাতে এখনও বহাল তবিয়তেই থাকতেন। উপরন্তু, কুড়িগ্রামের সাংবাদিকদের একটি সুবিধাভোগী/সুবিধাবাদী অংশ হয়তো ‘ডিসি স্যারের’ রুমে গিয়ে ওই নির্যাতিত সাংবাদিকের গুষ্ঠিই উদ্ধার করতেন। কিন্তু, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়া এখন অনেক কিছু কঠিন করে দিয়েছে। কে কখন কী ক্যামেরাবন্দি করে ফেলে, তা বোঝা ‍মুশকিল।
সুতরাং, মনিরামপুরের ঘটনার ছবি না থাকলে এবং এই ছবি ফেসবুকে ভাইরাল না হলে সাইয়েমা হাসান এখনও সেখানে বহাল তবিয়তে থাকতেন এবং আজকেও হয়তো ‘ব্লাডি সিভিলিয়ানদের’ শায়েস্তা করতে তিনি তার সরকারি ক্ষমতাবলে বাবার বয়সী আরও কিছু লোককে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। বরং, এই দৃশ্য যারা দেখেতেন তারা যদি বিষয়টা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনাও করতেন, তাতেও তার কিছু হতো না। এমনকি তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও তিনি সহকর্মীদের সহায়তায় পার পেয়ে যেতেন (অতীতে তাই হয়েছে)। এখানে ‘বিপত্তিটা’ বাঁধিয়েছে ফেসবুক।
বিপত্তি যাই হোক, জনপ্রশাসনে এইসব কর্মচারীদের ক্ষমতা ও সমস্যার উৎস চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সমস্যা কি তাদের প্রশিক্ষণে? বিসিএস এর মতো অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাস করে যারা প্রশাসনের কর্মচারী হন, তাদের অ্যাকডেমিক যোগ্যতা নিয়ে নিশ্চয়ই কারও প্রশ্ন নেই। তারা প্রচলিত অর্থে মেধাবীও। কিন্তু, মেধাবী হলেই যে তিনি মানবিক, সংবেদনশীল আর ভদ্র হবেন, এমনটি নাও হতে পারে। সমস্যা যদি তাদের প্রশিক্ষণে হয়, তাহলে সব কর্মচারীর একই হওয়ার কথা। তা তো হয় না।
মনিরামপুরের এই ঘটনার পরদিনই রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের একটি ছবি ফেসবুকে এসেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি বয়স্ক মানুষদের কীভাবে সম্মান দিচ্ছেন এবং এই লকডাউনকালে গরিব মানুষের পাশে গিয়ে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। তার মানে সমস্যাটা প্রশিক্ষণে নয়। বরং, কে কীভাবে বেড়ে উঠেছেন, পরিবারে কী শিখেছেন— এসবের উপরেও অনেকটা নির্ভর করে।
তবে, আমাদের প্রশাসনে যেহেতু ব্রিটিশ আমলের তথা কলোনিয়াল একটা লিগেসি আছে, ফলে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নিজেদের জমিদার ভাবার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এটা প্রশাসনের কাঠামোগত সমস্যা। কিন্তু, এই কাঠামো পরিবর্তনের খুব একটা চেষ্টা হয়েছে বলে মনে হয় না। আর এই কাঠামোর কারণেই বোধ হয় তারা যে জনগণের কর্মচারী বা সেবক, সেই বোধটি তাদের ভেতরে জাগ্রত হয় না।
অনেক সময় সরকারের আচরণেও মনে হয়, তারা বুঝি গণকর্মচারীদের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে প্রতি বছর যখন ডিসি সম্মেলন হয়, তখন সেখানে ডিসিরা যেসব দাবি দাওয়া তোলেন (এমনকি তারা বিচারিক ক্ষমতাও চান) তাতে মনে হয়, রাজনীতিবিদরা নন, বরং দেশটা আমলারাই চালান। বাস্তবতা হয়তো সেরকমই। কিন্তু, এখানে পলিটিক্যাল লিডারশিপের দায়িত্ব অনেক। তাদের শরীরি ভাষা আর আচার-আচরণে যদি প্রশাসনের লোকেরা ভয় না পায়, যদি কর্মচারীরা মনে করে যে সরকার তাদের ক্ষমতায় ভর করে টিকে আছে, তাহলে প্রশাসনের শৃঙ্খলা বজায় রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আমাদের প্রশাসনের কাঠামোগত সমস্যার একটা বড় জায়গা ক্ষমতা-সংস্কৃতির চক্র। কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনও চাকরির শুরুতে এসি ল্যান্ড ছিলেন। উপরমহলের নজর বা মনোযোগ পেতে হয়তো তাকেও নানারকম বীরত্ব দেখাতে হয়েছে। ধীরে ধীরে তিনি শক্ত অফিসার হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। মনিরামপুরের সাইয়েমাও চাকরিতে যোগদানের পরে বোধ হয় এই পদ্ধতিটা বুঝে গেছেন। নিজের বীরত্ব জাহির করতে গিয়ে প্রবীণদের প্রকাশ্যে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন যাতে মানুষ তাকে ‘কড়া অফিসার’ বলে খেতাব দেয়। এভাবে হয়তো তিনি দায়িত্ব ‘কঠোরভাবে’ পালনের পুরস্কার হিসেবে একসময় ডিসি হয়ে যেতেন।
আমাদের প্রশাসনের কাঠামোগত সমস্যার আরেকটি প্রবণতা ‘কর্মকর্তা’ ও ‘স্যার’। সরকারিগণ কর্মচারীগণ নিজেদেরকে ‘কর্মকর্তা’ ভাবতে পছন্দ করেন এবং প্রত্যাশা করেন, যে জনগণের করের পয়সায় তাদের বেতন হয়, সেই জনগণ তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবে। ‘স্যার’ না বললে তারা ‘মাইন্ড’ করেন এবং সেবা দিতে বিরত থাকেন— এমন ঘটনাও গণমাধ্যমে এসেছে। ২০১৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল: ‘ইউএনওকে স্যার না বলায় অশালীন আচরণ’। ওই বছরই পাবনার একজন সাংবাদিক বেড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে ‘আপা’ বলে সম্বোধন করায় রোষানলে পড়েন (চ্যানেল আইন অনলাইন, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮)। এসব কারণে সাধারণ মানুষ সেবা নিতে গিয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মচারী তো বটেই, অনেক সময় পিয়নদেরও স্যার বলে সম্বোধন করে।
কিন্তু, এখন আইন সংশোধনের সময় এসেছে যে, গণকর্মচারীরা জনগণকে কী বলে সম্বোধন করবেন। উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীরা সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। বাংলাদেশেও এখন সরকারি কর্মচারী আইন সংশোধন করে সেখানে ‘সম্বোধন’ নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করা দরকার, যেখানে স্পষ্ট বলা থাকবে, ‘সেবাগ্রহীতাদের সংশ্লিষ্ট অফিসার/কর্মচারী স্যার বলে সম্বোধন করিবেন’। এই আইন করা হলে গণকর্মচারীদের অহঙ্কার কমবে।
একজন জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা এসি ল্যান্ডও যখন সেবা নিতে যাওয়া পানের দোকানদার বা রিকশাচালককে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করবেন, তখন ওই অফিসার/কর্মচারী নিজেকে জনগণের প্রভু বা জমিদার ভাববেন না। তিনি সবসময় নিজেকে জনগণের সেবক হিসেবেই ভাববেন। তিনি গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস পাবেন না। তিনি মনে করবেন যে, এই সাধারণ মানুষের করের পয়সায়ই তার বেতন হয়। অতএব, তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। তাদের ইজ্জত করে কথা বলতে হবে। কারণ তারাই মালিক।
সাংবাদিক মশিউল আলম ফেসবুকে লিখেছেন: ‘জনপ্রশাসন ইতরমুক্ত ঘোষণা করুন।’ এখন এটাই কাজ। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের এই সময়ে প্রশাসনের লোকজনের বিরুদ্ধে যাতে সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে না হয়, সেজন্য সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ইতর কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের গুডবাই বলতে হবে। একইসঙ্গে পরিস্থিতি উন্নতি হলে সংসদের আগামী অধিবেশনেই সরকার গণকর্মচারী আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
আমীন আল রশীদ, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন। (২৯ মার্চ, ২০২০,দৈনিক সাতক্ষিরায় প্রকাশিত)

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করুক

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক
দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন দুদক চায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করুক।
এটা খুবই প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক একটি ব্যাপার ছিল। কিন্তু ‘কলোনিয়াল লিগ্যাসির’ ধারাবাহিকতায় আমরা একে অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার করে তুলেছি। ঔপনিবেশিক কায়দায় এ বঙ্গে উল্টো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘স্যার’ বলে সেবাপ্রার্থীর জান জেরবার হয়ে যায়। যাই হোক, আমি একবার ভর্তি সংক্রান্ত কাজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার বিল্ডিংয়ে গেলাম। দেখি এক কর্মকর্তার টেবিলের উপর নেমপ্লেটে লেখা “ভাই, মামা বা আঙ্কেল” ডাকবেন না। স্যার বলে সম্বোধন করুন। মি. হাসমত আলী (ছদ্মনাম) বিএ, এমএ।
দুদকের চেয়ারম্যান বলেছেন দুদক চায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করুক।কিন্তু আমলাতন্ত্রে সিনিয়র কাউকে ভাই, বোন বা আপা ডাকলে তারা দেখি খুব গোস্বা করে বসেন। কষ্ট পান। নাম ধরে ডাকার তো প্রশ্নই ওঠে না (বলবেন এটা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। ‘স্যার’ ডাক কী এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিতে ছিল?)।
হাসমত আলী বিএর নেমপ্লেট দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ। কোনোমতে মুখ চেপে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় পৌঁছে প্রাণখুলে এক চোট হাসলাম। এটা এক ধরণের হীনমন্যতাবোধ। ইনফেরিওর কমপ্লেক্সিটি। হীনমন্যতাবোধ থেকে এই সংকটের জন্ম। কৃষিসমাজ থেকে উঠে আসা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মন! আপনাকে যদি অসম্মান না করে কেউ নাম ধরে ডাকে তাতে আপনার সমস্যা কী? আপনি তো প্রভু না। সেবাপ্রার্থী জনগণ আপনার দাস না। নানাসময় বিদেশীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ। পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তারা আমাকে নাম ধরে ডাকত। আমিও তাদের নাম ধরে ডাকতাম।
এমনকি এ মুহূর্তেও একজন ইটালিয়ান ও ব্রিটিশ নাগরিকের সঙ্গে একটা গবেষণা কাজে সহযোগিতা করছি। দুজনেই বিশেষজ্ঞ। দুই নাম্বার বা ভুয়া পিএইচডি না, বিলেতে এবং ইতালির নামকরা প্রতিষ্ঠানের পিএইচডি। মজার ব্যাপার হলো তারা যখন কাউকে নিজের পরিচয় দেয় বলে না যে আমি ড. এক্স, ওয়াই, জেড। সাদামাটাভাবে শুধু নিজের নামটুকু বলে। তাদেরও ড. যোগ করে সম্বোধন করতে হয় না। অথচ আমাদের কোনো পিএইচডিকে যদি ড. না বলে সম্বোধন করেন, স্যার না বলেন— উনি রীতিমতো ঘোরতর মাইন্ড করে বসবেন। দেশে পিএইচডি নাই এমন একজন রাজনীতিবিদও আছেন যিনি চান সবাই তাঁকে ‘স্যার’ বলে ডাকুক। অথচ উনার অনেক সিনিয়র নেতাকে সবাই অনায়াসে তোফায়েল ভাই বলে ডাকে। বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রনেতারা মুজিব ভাই বলেই ডাকত। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের প্রধানকেও সবাই আপা বলে ডাকে। এসব আমাদের বড় বড় কর্তারা যে জানেন না এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তারা পড়াশোনা করেন। হরহামেশা সুযোগ পেলেই বিদেশ যান। এমনকি পুকুর খনন দেখতেও। শাহী কায়দায় পুকুর খনন দেখে বউ-শ্যালিকার জন্য জমিয়ে শপিং করেও নিয়ে আসেন। শুধু নিয়ে আসেন না বা শিখে আসেন না তাদের ভালো কালচারটুকু। আন্তরিক সেবার মানসিকতাটুকু।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে সবাই স্বতঃস্ফূর্ত ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে অফিসের সবাই মতি ভাই বলে ডাকে। উনি চাইলে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে সবাই সানন্দে ‘স্যার’ বলেই ডাকত। মানবজমিনের মতিউর রহমান চৌধুরীকেও আমরা মতি ভাই বলে ডাকতাম। দেশের সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানকেও অনায়াসে আমরা পীর ভাই বলেই ডাকি। কিন্তু আমলাতন্ত্রে সিনিয়র কাউকে ভাই, বোন বা আপা ডাকলে তারা দেখি খুব গোস্বা করে বসেন। কষ্ট পান। নাম ধরে ডাকার তো প্রশ্নই ওঠে না (বলবেন এটা আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। ‘স্যার’ ডাক কী এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিতে ছিল?)।
 

স্যার, দয়া করে ‘স্যার’ উপাধি ব্যবহার করবেন না

ব্র্যাক চেয়ারম্যান ফজলে হাসান আবেদ আমাদের গর্ব নিঃস্বন্দেহে। তবে নামের আগে স্যার উপাধী কতটা সন্মানজনক তা ভাববার বিষয়। যেখানে তিনি এই উপাধী কোন ভাবেই ব্যাবহার করতে পারেন না। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু এবং অসম্মানজনক। কারণ যতবার ব্রিটিশরা এই ধরনের খবর দেখছে ততবার আমাদের নিয়ে উপহাস করছে। মনে মনে হলেও।
আসুন জানি স্যার উপাধী কিভাবে পায় আর এর ব্যবহার কিভাবে বা কারা করতে পারেন। ব্রিটিশ সরকার ১৩৪৮ সাল থেকে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য নাইট উপাধি ঘোষণা করে। প্রথমে সেনাবহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ক্রমে এই উপাধী অন্যান্য সাধারণ মানুষের মাঝেও বিতরণ শুরু হয়। পাঁচটি ভিন্ন রকমের নিতে উপাধীর মাধ্যমে স্যার শব্দটার ব্যাবহার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। অর্থাৎ আপনি যদি নাইট উপাধী পান তবে আপনার নামের আগে স্যার শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন। তবে এর জন্য আপনাকে ব্রিটিশ নাগরিক হতে হবে। আপনি যদি অন্য কোন দেশের নাগরিক হন এবং নাইট উপাধিতে ভূষিত হন তবে আপনি স্যার শব্দটি নামের আগে ব্যাবহার করতে পারবেন না। তবে চাইলে আপনি কে বি ই ইংরেজির এই তিনটি শব্দ ব্যবহার করতে পারেন।
 

সরকারি কর্মকর্তাদের কী বলে সম্বোধন করবেন জানতে চেয়ে আবেদন

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্বোধনে কোনো আইন বা বিধি রয়েছে কি না তা জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেছেন এক উন্নয়নকর্মী।
গত ২০ মে দুপুরে তথ্য অধিকার বিধিমালার বিধি-৩ এর নির্ধারিত ফরম ‘ক’ পূরণ করে এই তথ্য জানতে চান তিনি।
এমন আবেদনকারীর নাম সালেহীন চৌধুরী শুভ। তিনি সুনামগঞ্জ শহরের ষোলঘর ওয়াপদা রোডের বাসিন্দা।
আবেদনে তিনি জানতে চেয়েছেন, সুনামগঞ্জ কালেক্টরেটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাগরিকরা কী বলে ডাকবেন?
সালেহীন চৌধুরী বলেন, সম্বোধন নিয়ে দেশের সাধারণ জনগণ প্রায়ই সরকারি দফতরগুলোতে দুর্ব্যবহারের শিকার হন। ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে বিরক্তি ভাব দেখান কর্মকর্তারা। তারা বুঝতে চান না যে, তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী।
এ বিষয়ে অনেক সাধারণ মানুষেরও তেমন একটা জানা নেই বলে মনে করেন সালেহীন।
সে জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্বোধনে কোনো আইন বা বিধি আছে কি না তা তথ্য অধিকার আইনে জানতে চেয়েছেন।
আবেদনটি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় (ডকেটে) জমা দিয়ে রিসিভড কপিও এনেছেন বলে জানান সালেহীন চৌধুরী।
ইতিমধ্যে সালেহীন তার এই আবেদনের কপি নিজের ফেসবুক ওয়ালে আপলোড করেছেন। তার এমন আবেদনকে দারুন একটি কাজ বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। অনেকেই তথ্যটি দেশের সবারই জানা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন। আফরোজ রায়হান নামের একজন লিখেছেন, আধুনিক, সময়োপযোগী, বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী উদ্যোগ। অসম মানবিক বাস্তবতার চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভবিষ্যতের সুসম পথ দেখাবে আশা করি।
মাফ করবেন, কেউ যদি কাউকে সম্মান করে স্যার ডাকেন, ভালোবেসে স্যার ডাকেন সেটা একান্তই আলাদা এবং ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু কেউ যদি কাউকে স্যার না ডাকেন, তাকে ভৎসনা করা, কটুক্তি করা, চাপ প্রয়োগ করা, তার সাথে অসদাচরণ করা একেবারেই কাম্য নয়। স্যার ডাকা না ডাকা কোন কার্টেসি নয়, নর্মস নয় এমনকি ভদ্রতাও নয়। পৃথিবীর বড় বড় এনজিওগুলোতে স্যার ডাকার প্রতি নিষেধাজ্ঞা রযেছে। তবে আপনাকে যদি কেউ স্যার ডাকে তাকে বিনয়ের সাথে বলুন, দয়া করে আমাকে স্যার না ডাকলে খুশী হবো। হয় ভাই ডাকুন অথবা নামধরে ডাকুন। আমার নাম অমুক।
এরপরও যারা স্যার না বললে রাগ করবেন, তাদের জন্য তাদের পরিবারের সবাইকে আগে তাকে স্যার বলাটা রপ্ত করানো উচিত।  পাশাপাশি নিজেকে আয়নার সামনে দাড়িয়ে একটা লম্বা স্যালুট টুকে দিয়ে বলুন, ইয়েস স্যার, আই এম স্যার !