সভ্যতার মহানায়ক মুহাম্মদ সা.
Anindabagla
প্রকাশের সময় : মে ৩০, ২০২২, ৭:০৩ অপরাহ্ণ
অনেক দিন আগের কথা, যেদিন অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন আমাদের মুফতী আব্দুল হান্নান সাহেব হুজুর। সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম আমরা সবাই।ক্লাসের পড়া নিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে সময়টা কাটছিলো আমাদের। কারণ হুজুরের নিয়ম হলো- তিনি প্রতিদিন ক্লাসে এসে পড়া ধরেন। ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় হঠাৎ ঘাড় মুড়াতেই দেখি হুজুর ক্লাসের দিকে দ্রুত বেগে আসছেন।
ক্লাসে বসেই হুজুর আজ নিয়মের বিপরীত কাজটা করে ফেললেন। পড়া জিজ্ঞেস না করেই বলতে আরম্ভ করলেন-
বাচ্চারা শোনো! তোমরা কি হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালো করে চেনো? তিনি কেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন?
তার বর্ণীল জীবনকীর্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত আছো কি ? আমরা ক্ষীণ আওয়াজে বললাম –
জ্বি না, অতটা অবগত নই!
হুজুর বললেন –
তবে আমি বলছি শোনো! হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)এমন সময় পৃথিবীতে আগমন করেন, যখন ধরণী জাহেলিয়্যাতের ঘোর আঁধারে আবদ্ধ ছিলো। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির চরম অবক্ষয়তা বিশ্বমানবতাকে পশুর কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো।
চরম অজ্ঞতা তাদের জীবন্ত কন্যা সন্তান হত্যা করাকেও বাধ্য করেছিল। তারা এমন অসভ্যতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলো যে, যৌবিক চাহিদা পূরণে মা-বোনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে অসভ্য জাতীতে পরিণত হয়েগিয়েছিলো।
মারামারি, খুনাখুনি, রাহাজানি, মদ্যপান নেশাশক্তি, অন্যায় অবৈধ কার্যকলাপ তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল।
সমাজের বিত্তশালীরা গরীব-দুঃখিদের ওপর নির্মমভাবে নির্যাতন করতে সামান্যতম দ্বিধা করতো না। গ্লানিময় অন্ধকারে গোটা পৃথিবীটা ছেয়ে গিয়েছিল ঘোরতর জঘন্যতায়। ঠিক তখনই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে সভ্যতার সুবাস ছড়াতে এবং বিশ্ববাসীকে সুন্দর আদর্শ উপহার দিতে আলোর প্রদীপ নিয়ে ধরাদমে আগমন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তাঁর আগমনের পরপরই পারস্যের শাহী প্রসাদে এমন ভূকম্পন সৃষ্টি হয়েছিলো যার দরুন চৌদ্দটি গম্বুজ অমনি ভেঙে পড়েছিলো।
সেই সাথে পারস্য উপসাগর নিমিষেই শুকিয়ে গিয়েছিলো। এবং পারস্যের সেই অগ্নিকুণ্ড যা এক হাজার বছর ধরে প্রজ্জ্বলিত ছিলো তা মুহূর্তেই নিভে গিয়েছিলো।
প্রকৃতপক্ষে এই মহা মানবের জন্মকালে এসকল আশ্চর্য ঘটনা ছিল, অগ্নিপূজা, মূর্তিপূজা, ও সব ধরনের গোমরাহীর পরিসমাপ্তির ঘোষণা।এবং পারস্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবহ।
এভাবে যতই দিন যেতে থাকে মহানবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাম থেকে একের পর- এক গুনকীর্তন বহিঃপ্রকাশ ঘটতেই থাকে। তার ন্যায় নিষ্ঠা, ধৈর্য্য, উত্তমাদর্শ, সৌদি আরবসহ বিশ্ব ব্যাপী সুখ্যাতি লাভ করতে থাকে।সাহাবায়ে কেরামগন সর্বক্ষন তার সোহবতে থাকার চেষ্টা করতেন, শুধু মাত্র খাটি মানুষে পরিনত হতে। আর এতে সফলও হয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
যার জলন্ত প্রমান হযরত জাফর ইবনে আবি তালেব (রাযিঃ), যার মনি মুক্তা খচিত সেই হদয়স্পর্শী কথাগুলো,এখনো ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষারে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তিনি বাদশাহ নাজ্জাশির সামনে অকপটে স্বীকার করেছিলেন, যে হে জাহাপনা! আমরা অতীতে অন্ধভক্তি, মূর্তি পূজা, মৃত জীব জন্তু বক্ষণ, আত্মীয় বিচ্ছিন্নতা, দুশ্চরিত্রতা, অশ্লীলতা ও অসম্ভতায়
আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। একমাত্র মহা নবী( সাঃ)-ই আমাদেরকে নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, সদা সত্য বলা, সৎ ব্যবহার করা, মারামারি- খুনাখুনি না করা, বেহায়া উলঙ্গ পনা ছেঁড়ে দিতে মধ্যপান না করতে এবং এতিমের মাল আত্মসাৎ না করতে, গরীব দুখিঃদের সাহায্য করতে নির্দেষ দিয়েছেন। এবং আমাদেরকে সোনার মানুষে তৈরি করেছেন।
প্রিয় ছাত্ররা! ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে হুজুর পাক (সাঃ) সুমধুর চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।
তাই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একজন নবী হয়েও এক বেদ্বীন বৃদ্ধা মহিলার বোঝা বহন করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
তদ্রূপ তার আমানতদারিতাও এমন ছিল যে মক্কার কাফেররা পর্যন্ত তার কাছে আমানত রাখতো। আল্লাহু আকবার।
মক্কার কাফেররা যখন হাজরে আসওয়াদ নিয়ে তুমুল ঝগরা ফাসাদের উপক্রম হলো, নবী করীম (সাঃ) তাদের মাঝে এমন সুন্দর ফায়সালা দিলেন, যার কারণে সকলে সন্তুষ্টিচিত্বে এক বাক্যে “আল আমিন” বলে উপাধি দিয়ে দিলো।
অতঃপর হুজুর বললেন হে বৎসরা শুনো!
এই ফুলের মত স্বচ্ছ উত্তম চরিত্রের অধিকারী মহানবী (সাঃ) এর ওপর-ও মক্কার কাফেররা বিভিন্ন ধরণের অমানবিক নির্যাতন শুরু করা থেকে থেমে থাকিনি বরং প্রিয়তম হাবিব রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে এক বুড়ি কাঁটা বিছিয়ে রাখতো।
অপরদিকে নামাজ পড়তে গেলে নিষ্ঠুর আবু জাহেলের দলেরা তার পবিত্র গায়ে উটের ভুরি চাপিয়ে দিতো।
এবং পথে-ঘাটে তাকে নিয়ে নানাবিধ হাসি তামাশা ও গালমন্দ করতো।
প্রিয় তালাবারা শুনো!
মহা নবী (সাঃ) এর দাদা আবদুল মুত্তালিব মৃত্যুর পর অতিরঞ্জিত আক্রমনের শিকার হচ্ছিলেন। তখন মনে মনে এই ধারণা পোষণ করেছিলেন,যে হয়তোবা তায়েফে গেলে অনেকটা নিরাপদে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া যাবে। এবং মানুষ ইসলাম ধর্মে পদার্পণ করবে।
কিন্তু বিষয়টি হয়ে গেলো একেবারে উল্টো, যে তিনি খুব আশা নিয়ে এক মাস “দশ” দিন তাদের সকলের দরজায় করাঘাত করেছেন। এবং সুমিষ্ট ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। তবুও তারা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় দীক্ষিত হয়নি।
বরং তারাও প্রিয়তম হবীবকে চিনতে না পেরে একের পর এক অনবরত পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করে দিলো। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল নবীজির “পা” মোবারক। কষ্টের পাহাড় ঝেঁকে বসে গেলো হৃদয়ের মণিকোঠায়। তারপরও প্রিয়তম নবী তাদের জন্য “বদ” দোয়া করেননি। আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদই করেছিলেন,যে হে আল্লাহ আমার কওম না জেনে, না বুঝে এমন করেছে, মা‘বুদ তুমি তাদের হিদায়ত নসিব করো। সুবহানাল্লাহ। কি আখলাক! কি সুন্দর মাধুরি!! এই স্থানে আমরা হলে তাদের শান্তি ও হিদায়াতের দোয়া করার দূরের কথা, উল্টো জাহান্নামে পাঠানোর জন্য উদগ্রীব থাকতাম। এই হচ্ছে প্রিয় নবীর ও আমাদের মাঝে পার্থক্য।
প্রিয় বন্ধুরা!
ঠিক সেই মুহূর্তে হুজুরের কাঁদো কাঁদো ভঙ্গির কথাগুলো খুব হৃদয়স্পর্শী হচ্ছিল। যার দরুন প্রচন্ড ভাববেগে আর্দ্র হয়ে গিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে কোনভাবেই চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি।
মনে হচ্ছিল যেন আমরা মরুভূমির বালুকারাশিতে উদ্ভ্রান্তের নেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। শুধুমাত্র এই প্রিয়তম হাবিবকে এক নজর দেখার জন্য। কারণ প্রিয়তমার ছবি মনের ভিতর কতো যে অংকন করেছি।তবে ভালোবাসার লোকটির সাথে আমার এই ছবি আদৌ মিলবে কি?
হে প্রিয় নবী! যতই তোমার ইতিহাস পড়ছি ততই তোমার প্রেমে, প্রেমেকাসক্ত হয়ে যাচ্ছি তবে হবে কি অধমের তোমার দীদার নসীব?
হে প্রিয় নবী!
আমি যে তোমার প্রেম সাগরে ডুব দিয়েছি। একটু সুধা কি দিবে এই অধমকে?
ওগো নবী! তুমি না বলেছিলে যে যাকে ভালোবাসে তার সাথে তার স্থান হবে।আমি তো তোমাকেই বেশি ভালো বাসি।
নবী গো! তোমার দরবারে নাজরানা দিতে মনটা একেবারে ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছে। কারন হৃদয় মাঝে যে শুধুই তুমি।
সর্বোপরি আল্লাহর কাছে একটিই আরজি। তিনি যেন আমাকে তাঁর ঘর বাইতুল্লাহ ও প্রিয়তম হাবিবের দরবারে দু‘ ফোঁটা অশ্রু ফেলার তৌফিক দান করেন। আমিন ।
মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ রশিদী
ছাত্র: মারকাযে ইমাম বুখারি (রহঃ)
উত্তর বাড্ডা ঢাকা ১২১২
ক্লাস: দারুল ইফতা
( ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ)
মতামত লিখুন :