Logo

আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ হওয়া চাই কল্যাণমুখী

অনিন্দ্য বাংলা
শুক্রবার, মার্চ ৪, ২০২২
  • শেয়ার করুন

আইনের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ হওয়া চাই কল্যাণমুখী
পরিবর্তন হবে মানুষের বহুশতাব্দীর পুরনো বদ্ধমূল ধারণা!!
———————————————————————-
আমাদের দেশে গণমানুষের মধ্যে ‘আইনের ফাঁকফোকর’ বলে  একটি বহুল আলোচিত প্রবাদ আছে৷ আইনের ফাঁক গলিয়ে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যায়!  এরকম মুখরোচক জনশ্রুতি আছে৷ সাধারণত প্রত্যাশিত অপ্রত্যাশিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে দেখে মানুষের মধ্যে এই ধরনের জনশ্রুতিগুলো বদ্ধমূল ধারণায় রূপান্তরিত হয়ে থাকে।
আমাদের বিচার ব্যবস্থায় দু’ধরনের আইন অনুসরণ করা হয়ে।  ফৌজদারি আইনের মামলায় বাদি আসামির শাস্তি দাবি করেন৷ অন্যদিকে দেওয়ানি আইনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়৷ সাধারণভাবে হত্যা, সন্ত্রাস, হত্যাচেষ্টা, মাদক,ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধের মামলা হয় ফৌজদারি আইনে৷ আর প্রধানত জমি জমা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের মামলা হয় দেওয়ানি আইনে৷ এই দু’ধরনের আইনের মামলা তদন্ত, পরিচালনা আর বিচারের জন্য আছে আরো আইন৷ সিভিল প্রসিডিউর কোড এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড ছাড়াও সাক্ষ্য আইন এখানে মূল ভূমিকা পালন করে৷
ফৌজদারি আইনের দর্শন হলো এই আইনের অধীনে কোনো মামলা হলে তা সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শতভাগ প্রমাণ করতে হয়৷ কোনো সন্দেহ রেখে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না৷ আসামিরা সব সময়ই ‘বেনিফিট অফ ডাউট’-এর সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ কারণ এই আইনের বিচারে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে৷ তাই ন্যূনতম সন্দেহ রেখেও কাউকে মুত্যুদণ্ড দেয়া যায় না৷ এখানে অপরাধ প্রমাণ মানে শতভাগ প্রমাণ৷ অন্যদিকে দেওয়ানি মামলায় যেহেতু শাস্তি নয় অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়, তাই কোনো পক্ষ তার দাবি শতকরা ৫০ ভাগের বেশি প্রমাণ করতে পারলেই তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
 ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের, তদন্ত, বিচার এবং রায় কার্যকর পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে৷ মামলা দায়ের, তদন্ত এবং অভিযোগপত্র এই তিনটি স্তর সঠিকভাবে সম্পন্ন হলেই কেবল পরবর্তীতে বিচার প্রক্রিয়ার সুচনা ঘটে৷ ন্যায়বিচার শুধু মামলার বাদির একার নয়, ন্যায়বিচার আসামির জন্যও প্রযোজ্য৷ তাই আইন-আদালতের সাথে তদন্তকারী সংস্থাও পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত৷ আইন প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায়ই আসলে আইনের চরিত্রকে জনসমক্ষে প্রকাশ করে।
আইন যাঁরা প্রয়োগ করেন তাদের নৈতিকতার ওপরই আইনের যথার্থতা ও গ্রহনযোগ্যতা নির্ভর করে৷ আইনের উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা৷ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য হিসেবে আমি আইনে ফাঁক ফোকর কথাটির সাথে একমত পোষণ করতে পারি না৷
বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় চারটি পক্ষ কাজ করে৷ পুলিশ, রাষ্ট্রপক্ষ, আদালত এবং কারাকর্তৃপক্ষ৷ এখন যে কোনো এক পক্ষের অদক্ষতা কারণে আইনের ভুল বা অপপ্রয়োগ হতে পারে৷ অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাতে পারে৷ আবার নিরপরাধ কেউ শাস্তি পেয়ে কারাগারে যেতে পারে৷ নিম্ন আদালতের মামলা পর্যালেচনা করে দেখা গেছে যে সর্বোচ্চ ১৫-২০ ভাগ মামলায় আসামিদের শাস্তি পেয়ে থাকে ৷ ৮০ ভাগ মামলায়ই আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷ আর এর পিছনেও পৌরাণিক আইনের প্রায়োগিক দক্ষতা এবং পরিচর্যার কারণ আছে৷
আইনের সময় অনুপযোগীতা বা দুর্বলতা থাকা অসম্ভব কিছু নয়।অপরাধ অভিযোগ এবং দাবি প্রমানের মূল হাতিয়ার সাক্ষ্য আইনেও অভাব রয়েছে  আধুনিকতার ৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ আর সংঘবদ্ধ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এ আইনে শাস্তি দিতে হলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে হয়৷ প্রয়োজন হয় চিকিৎসা সংক্রান্ত সনদসহ অন্যান্য দালিলিক সাক্ষ্য৷ সঠিক সময় ডাক্তারি পরীক্ষা করা না হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না৷ এছাড়া আদালতে ধর্ষণের শিকার নারীকেই ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ করতে হয়, যা একটি কঠিন এবং জটিল প্রক্রিয়া৷ ফলে ধর্ষণের শাস্তি অনেকক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা যায় না৷ সাক্ষ্য আইনের সুনির্দিষ্টতার অভাবে কোনো হত্যাকাণ্ড বা নেপথ্যে ইন্ধনদাতার অপরাধ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব৷ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়ও নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় আনা যায়নি এখনো। এটি দিনে দিনে গণমানুষের কাছে প্রবলভাবে প্রয়োজন অনুভূত হতে শুরু করেছে।
 অস্ত্র এবং মাদক আইনের মামলায় অপরাধ প্রমাণ করতে হলে কোনো ব্যক্তির দখল ও অবগতিতে ( Knowledge & position) অস্ত্র বা মাদক পাওয়া জরুরি৷ কেউ ওই অপরাধে জড়িত হওয়ার পরও তাদের কাছে বা দখলে না পাওয়া গেলে জ্ঞাতসারের বিষয় প্রমান দুরূহ হওয়ায় তারা আইনে সুবিধা পান এবং অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়৷
আইনের বেসিক প্রিন্সিপাল হলো উভয় পক্ষের মধ্যে একটা ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভারসাম্য বা সমঝোতা রক্ষা করা৷ পাবলিক পারসেপশন থেকে আইনের ফাঁকফোকর কথাটি জনশ্রুতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সাধারন মানুষ মনে করে সমাজের অগ্রসরমান মানুষদের জন্য আইনে কোথাও কোন ফাঁকফোঁকর আছে৷ আসলে এটা আইনের প্রয়োগগত সমস্যা৷ ব্রিটিশরা এই আইন যখন করে তখন চুরির শাস্তি দেয়ার চেয়ে উপমহাদেশের শোষিত মানুষদের চোর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণাত ছিল বেশি৷ এজন্যই প্রতিনিয়ত আইনের আধুনিকায়নের কাজটি চলমান।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ব্রিটিশ আইনকে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মীকরণ করেছি৷ সেই আইন দিয়ে আজকের সময়ের মানুষের মর্যাদা, মনন, নিরাপত্তা, অধিকার রক্ষা করা কঠিন হলেও সংশোধন সংযোজন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে সরকার ও রাষ্ট্র । দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের পরিক্রমায় অপরাধ, অপরাধী, অধিকার এবং চাহিদায় যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি আইন সংশোধন ও প্রণয়নের মাধ্যমে এ-ই প্রক্রিয়া টিকে সময়োপযোগী করণের কাজ চলছে । সভ্যতার বহমান গতি অটুট রাখতে নিজেকে পরিবর্তন করার বিকল্প নেই। চলুন সবাই আগামির পথে এগিয়ে চলি, বদলে যাই, বদলে দিই।
মোঃ সফিকুল ইসলাম 
অফিসার ইনচার্জ, জেলা গোয়েন্দা শাখা, ময়মনসিংহ