Logo

আজান : বিশ্ববাসীর কাছে এক অমিয় সুধা

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, জুন ২৬, ২০২১
  • শেয়ার করুন

আজান। কল্যানের পথে আহবান। নাজাত, মুক্তির পথে আহবান। চির শান্তির ধর্ম ইসলামের অন্যতম বিধান সালাত তথা নামাজের জন্য জামাআতবদ্ধ হওয়ার ঘোষনা দেয়ার নামই আজান। আজানের আবেদন চিরকালীন-শাশ্বত। প্রতিদিন সময়ের ক্রমবিবর্তনে সকাল-সন্ধ্যা পৃথিবীর সর্বত্র সবসময় মসজিদের মিনারে মিনারে বাজে আজানের সুমধুর সুর। আরব আজমের সীমানা পেরিয়ে আজান ছড়িয়ে পড়ে মাশরিক-মাগরিবে। দেশ-মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর ভূখন্ডে ভূখন্ডে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় আজানের সুমধুর সুরমালা। এশিয়ার দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর ছাপিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার শেষ স্থলভূমিটি পর্যন্ত পৌঁছে যায় আজানের মায়াবি আহবান। আল্লাহু আকবার।
আজান বাঙালির চেতনা ও অনুভূতিতে অসামান্য অভিব্যক্তির স্ফুরণরূপে অন্তরের অতলান্ত গভীরে স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্যের নানা অঙ্গনে আজানের প্রাসঙ্গিক ব্যবহার সমুজ্জ্বল। আজানের মাহাত্ম্য, ফজিলত এবং গুরুত্ব বর্ণনায় আমাদের সামনে রয়েছে মহানবি হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুখ নিসৃত বানীসম্ভার। একটি হাদিসে এসেছে, ‘যত দূর আজানের শব্দ পৌঁছে, ততটুকু এলাকা ছেড়ে শয়তান দৌড়ে পালায়।’ প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও আজানের মধ্যে মানসিক প্রশান্তির ঠিকানা আবিষ্কার করেছেন—‘মসজিদে ঐ শোন রে আজান, চল নামাজে চল। দুঃখে পাবি সান্ত্বনা তুই বক্ষে পাবি বল।
‘কে ওই শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি,মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কী সুমধুর,আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী। কী মধুর আজানের ধ্বনি!’ -হ্যাঁ, প্রাণের কবি, মহাকবি কায়কোবাদের অমর কবিতা ‘আজান’ পাঠ করার পরে হৃদয়-মন আপ্লুত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ‘আজান’ মহাকবি কায়কোবাদের নিবেদনে বাঙালির হৃদয়ে এক অমীয় সুধা, অপূর্ব সুরধ্বনি।
 আজান নিয়ে যুগে যু্গে আরও কত কবি সাহিত্যিক রচনা করেছেন গান-গজল-কবিতা তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আযান এসেছে নানাসময়ে-নানাভাবে-নানা আঙ্গিকে। বাঙালি মননে সাহিত্যে-গানে-গজলে ইসলামী ঐতিহ্য এবং আবহ তিনিই জাগিয়েছেন।
মানবপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে তিনি ধারণ করেন ‘বাঁশের বাঁশরী’ ও ‘রণতূর্য’। তিনি সবার ও সারা বিশ্বের। কিন্তু তিনি ইসলাম ও মুসলমান—এই বৃত্তের বাইরের কেউ নন। তাই তো তাঁর অনুভবে আজান বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে—“আমার মনের মসজিদে দেয় আজান, হাজার মোয়াজ্জিন। প্রাণের ‘লওহে’ কোরআন লেখা,রুহ পড়ে তা রাত্রিদিন।”
কাজী নজরুলের বিবেচনায় আজানের শক্তি মানুষকে পৌঁছে দেয় এক অনন্য উচ্চতায়। তিনি আজানের মধ্যে শোনেন আত্মবিশ্লেষণের তাগিদ—‘ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর। তখনো জাগিনি যখন জোহর।হেলায়-ফেলায় কেটেছে আসর,মাগরেবের ঐ শুনি আজান….।’
ইসলামের পরিভাষায় বিশেষ শব্দমালায় উচ্চ স্বরে নামাজের জন্য আহ্বান ধ্বনি আজানের মধ্যেও কাজী নজরুল শোনেন অসাধারণ সুধাময় সুর মূর্ছনা—‘দূর আজানের মধুর ধ্বনি বাজে মসজিদেরই মিনারে।এ কী খুশির অধীর তরঙ্গ উঠল জেগে প্রাণের কিনারে।’
আবার ‘উমর ফারুক’ কবিতার মাধ্যমে তিনি আমাদের শুনিয়েছেন এক মানবিক হাহাকারের চিরায়ত প্রতিধ্বনি ও পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির কান্না—‘তিমির রাত্রি এশার আজান শুনি দূর মসজিদে।প্রিয় হারা কার কান্নার মতো এ বুকে আসিয়ে বিঁধে।জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অন্তিম আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গনে তাঁর সমাধি হওয়ার মাধ্যমে। তাঁর আবেগঘন আকুতি মনে দাগ কাটে—‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই।যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’
আজানের প্রচলন ঘটে যেভাবে:
ইসলামের প্রাথমিক যুগে পবিত্র নগরী মক্কায় আজান ছাড়াই নামাজ পড়া হতো। প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় হিজরত করে মসজিদ নির্মাণ করলেন তখন মুসলমানদের নামাজে অংশগ্রহণের জন্য একত্রিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট সংকেত নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন এবং সাহাবাদের কাছে পরামর্শ চাইলেন।
সাহাবাদের পরামর্শ:
সাহাবায়েকেরাম নামাজে অংশগ্রহণ একত্রিত হওয়ার জন্য সংকেত ঠিক করতে পরামর্শ সভায় বসলেন। পরামর্শ সভায় ৪টি প্রস্তাব উপস্থাপন হয়:
এক. ঝাণ্ডা উড়ানো,
দুই. আগুন প্রজ্জ্বলন,
তিন. শিঙ্গা বাজানো,
চার. ঢোল বাজানো।
পরমার্শ সভার ৪টি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করা হয়। কারণ, প্রথমত: ঝাণ্ডা উড়ালে সব মানুষ তা তাদের বাড়ি হতে অথবা দূর থেকে দেখতে পাবে না। দ্বিতীয়ত: অগ্নি প্রজ্বলন করা হলে তা অগ্নি উপাসকদের কাজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে যায়। তৃতীয়ত: শিঙ্গা বাজানো খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীগনের কাজ। আর চতুর্থত: ঢোল বাজানো ইয়াহুদিদের কাজ। এ কারণে সেদিন সমাধান ছাড়াই পরামর্শ সভা মূলতবি করা হয়।
সাহাবায়েকেরামগণ এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে করতেই যার যার বাড়ি চলে গেলেন। ঐ রাতে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু স্বপ্নে দেখেন- ‘এক ব্যক্তি শিঙ্গা নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ঐ ব্যক্তিকে শিঙ্গাটি বিক্রি করতে বললেন। শিঙ্গাটি কেনার কারণ জানতে চাইলে আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু বললেন, ‘আমি শিঙ্গাটি দিয়ে মানুষকে নামাজে আসার জন্য আহ্বান করব।’
তখন শিঙ্গার মালিক ব্যক্তি বললেন, ‘আমি কি এটি হতে উত্তম একটি জিনিসের সংবাদ দিব না?’ এ বলে তিনি আজানের বাক্যগুলো তাঁকে শিখিয়ে দিলেন।
সকালে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়ে স্বপ্নের কথাগুলো জানালেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমার স্বপ্ন সত্য। তুমি বেলালকে আজানের বাক্যগুলো শিখিয়ে দাও। আজ থেকে বিলাল রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু আজান দেবে।’
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুর শেখানো বাক্যগুলো দিয়ে হজরত বিলাল রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু আজান দিলে, তা শুনে হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু প্রিয়নবির দরবারে দৌড়ে এসে বললেন-
‘হে আল্লাহর রাসুল! ঐ সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। অবশ্যই আমি অবিকল এ বাক্যগুলোই স্বপ্নে দেখেছি।’
উল্লেখ্য যে, ঐ রাতে একই স্বপ্ন সাহাবিদের মধ্য থেকে ১৪ জনই দেখেন। তখন (হিজরি দ্বিতীয় সন) থেকে নির্দিষ্ট বাক্যাবলীর মাধ্যমে নিয়মিত হজরত বিলাল রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু নামাজের জন্য আজান দিতেন।
আজান ও ইক্বামাতের জবাবে ফজিলত:
হজরত উমার রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুয়াজ্জিন বলবে, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার তখন তোমাদের কেউ যদি বলে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার; এরপর যখন মুয়াজ্জিন বলে আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (শ্রবণকারী) বলে আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ; এরপর যখন মুয়াজ্জিন বলে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুলল্লাহ্ (শ্রবণকারী) বলে আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুলল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), পরে মুয়াজ্জিন যখন বলে হাইয়্যা আলাস্ সালাহ্ (শ্রবণকারী) বলে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ,পরে মুয়াজ্জিন যখন বলে হাইয়্যা আলাল ফালাহ, (শ্রবণকারী) বলে লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ; এরপর মুয়াজ্জিন যখন বলে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার (শ্রবণকারী) বলে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, পরে মুয়াজ্জিন যখন বলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (শ্রবণকারী) তখন বলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ -এ বাক্যগুলো (আজানের উত্তর) যদি অন্তর থেকে বলে তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসলিম, আবু দাউদ)
হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু ইকামত দিচ্ছিলেন। যখন তিনি ‘ক্বাদ ক্বামাতিস্ সালাহ’ বললেন, তখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আকামাহাল্লাহু ওয়া আদামাহা’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ তাআ’লা তা প্রতিষ্ঠিত রাখুন এবং তা চিরস্থায়ী করুন।’ (আবু দাউদ) বর্ণনাকারী আরো বলেন, রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইকামাতের অন্যান্য শব্দের বেলায় (হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত) আজানের হাদিসের অনুরূপ বলেছেন।
সর্বোপরি কথা হচ্ছে- আজান ও ইক্বামাতের জবাবের মনস্তাত্বিক লাভ হচ্ছে, মানুষ যখন এর জবাব দেন তখন শয়তান অন্তর থেকে দূর হয়ে যায়। বিনা অসওয়াসায় মানুষ নামাজের দিকে ধাবিত হতে পারে এবং একনিষ্ঠতার সাথে নামাজ আদায় করতে পারে। মানুষ যতক্ষণ নামাজে ও মসজিদে থাকে, অন্তত: ততক্ষণ যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে। এর ধারা অব্যাহত থাকলে সমাজের নানবিধ খারাপ কাজ কমে আসবে। শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
অত্র হাদিসদ্বয় থেকে শিক্ষনীয়:
হাদিসদ্বয় থেকে প্রমাণিত যে, আজানের ন্যায় ইক্বামাতেরও জবাব দিতে হবে। আর যে ব্যক্তি আজান ও ইক্বামাতের জবাব দিবেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাঅা’লা আমাদেরকে আজানের ডাকে সাড়া দেওয়ার এবং  আজান ও ইক্বামাতের জবাব দেয়ার তাওফিক দান করুন।আমীন।
মুহাঃ নেয়ামতুল্লাহ রশিদী 
ছাত্রঃ জামিয়া দারুল উলূম নূরিয়া মাদরাসা
মধ্যবাড্ডা, গুলশান ঢাকা ১২১২
ক্লাসঃ দাওরায়ে হাদিস ( মাস্টার্স)
ফোনঃ ০১৯৬৩-৯৫১১৩১