Logo

আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হোন, মানসিক শক্তি বাড়ান: মনিরুল ইসলাম, CTTC প্রধান

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২০
  • শেয়ার করুন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর কিছু পড়াশুনা ও মুভি দেখার কারনে ‘হলোকাষ্ট’ ও জেনারেল আইখম্যানের ভূমিকা জানা থাকলেও তার পরিণতিটা জানতাম না। জেনোসাইড স্টাডিজে পোষ্ট-গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা করাকালীন জানতে পারি যে আইখম্যান হিটলারের পরাজয়ের পর জীবন বাঁচাতে জার্মানী থেকে পালিয়ে যায়। নাম ও পরিচয় গোপন করে সে আর্জেন্টিনাতে আশ্রয় নেয়। ‘রিকার্ডো ক্লেম্যান্ট’ নামের এই শ্রমিক যে আসলে আইখম্যান এটি ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ নিজস্ব তৎপরতায় ঠিকই জেনে যায়। বিপুল সংখ্যক ইহুদি হত্যার অন্যতম প্রধান কারিগর আইখম্যানের সাজা দিতে ইজরায়েলের দৃঢ সংকল্পের কারনে ‘মোসাদ’ তাকে খুঁজে বের করতে মরিয়া ছিল। সন্ধান পেলেও তার বিচার করাটা এতোটা সহজ ছিল না। কেননা, শুধু আইখম্যান একা নয়, আরও বেশ কিছু নাৎসি আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নিয়েছিল। আর্জেন্টিনা ঐ সময়ে নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশ হিসেবেই পরিচিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোন কোন খুনির মতই আইখম্যান নাৎসি সমর্থকদের কাছে দম্ভ ও আফসোস করতো যে কেন সে ইউরোপের সব ইহুদি হত্যা করে নাই। এই অবস্থায় তাকে বিচার করার একমাত্র উপায় ছিল তাকে ইজরায়েলে নিয়ে আসা। আর্জেন্টিনা কোন ভাবেই তাকে ইজরায়েলের কাছে হস্তান্তর করবে না এটা জেনেই ‘মোসাদ’ তাকে অপহরণ করে ইজরায়েলের নিয়ে আসার পরিকল্পনা করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে মোসাদের সদস্য ঠিকই তাকে অপহরণ করে ইজরায়েলে নিয়ে আসে। বিচারের মাধ্যমে ১৯৬১ খ্রিঃ ডিসেম্বরে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ‘Operation Finale’ সিনেমা দেখার পর আমার মনে হয়েছিল যে মোসাদের ব্যর্থতার ইতিহাস খুবই বিরল। Netflix এ “The Spy” সিরিজটি দেখার পর এই বিশ্বাস আরো দৃঢ হয়। কেজিবি, সিআইএ, সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (MI6), RAW কিংবা ISI এরও নানারকম সাফল্য নিয়ে প্রচুর লেখালেখি যেমন হয়েছে ঠিক তেমনি অসংখ্য সিনেমা, নাটক ও প্রামান্য চিত্র নির্মিত হয়েছে। এই সকল এজেন্সী স্ব স্ব পদ্ধতিতে শত্রুর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই, বিশ্লেষন এবং শত্রুকে মোকাবিলা করে কিংবা করার উপায় সম্পর্কে সরকারকে তথ্য সরবরাহ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর দুই পরাশক্তি পরস্পরকে শত্রু ধরে নিয়ে নিজ নিজ গোয়েন্দা সংস্হাকে নিয়োজিত করেছে। সমাজতন্ত্রের পতন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর ক্ষমতাধর দেশগুলোর শত্রুর সংজ্ঞা পাল্টে যায়। ফলে সমরাস্ত্র বানানোর গুরত্ব কিছুটা কমিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জোর দেয়। ফলে, ক্ষমতাধর দেশগুলো ক্ষেত্র বিশেষে সীমান্ত সমস্যার কারনে প্রতিবেশী তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকেই প্রধান শত্রু গন্য করতে থাকে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সেই অনুসারে নিয়োজিত করে।

এদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারনে World Economic Forum চতুর্থ শিল্প বিল্পব এবং তার কারনে সুফলের পাশাপাশি যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা নিয়ে রীতিমত গবেষনা করতে থাকে। আমি Kraus Schwab এর “Shaping the Future of the Fourth Industrial Revolution” বইটি পড়ার পর আশ্বস্ত হই যে, AI, IOT, Big Data Analysis, Cryptocurrency ইত্যাদির কারনে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে না খেয়ে মরবে না, বরং World Economic Forum মানবিক এক শিল্প বিল্পবের কথা ভাবছে যাতে করে সমগ্র মানব জাতির কল্যান হয়।

ভূমিকার পরে এবার আসল কথায় আসি। ২০১৯ খ্রিঃ শেষের দিকে যখন উহানে নভেল করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে এবং হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে তখন ও ক্ষমতাধর দেশগুলোর দক্ষ এজেন্সীগুলো মনে হয় শত্রুদের নিয়ে তাদের ধারনা পাল্টায় নাই। ২০২০ খ্রিঃ শুরুতে দেখা গেল বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন সংখ্যা। দেখা গেল কোন গোয়েন্দা সংস্থাই তাদের আসল শত্রুকে চিনতে পারে নি, এটি শতাব্দীর সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা। মোসাদ, সিআইএ, এমআই৬ সকলেই ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিচক্ষণ দেশের নীতি নির্ধারকেরা ও। World Economic Forum-এর চিন্তায় অবশ্য বিষয়টি আসার কথা নয়, তাই তাদের ব্যর্থতা নিয়ে কিছু বলার নাই। বিগত বছরগুলোতে শত্রুর মোকাবিলায় মারনাস্ত্র তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসল শত্রু না চেনার কারনে তার বিরুদ্ধে কোনরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি একেবারেই। ফলে ঢাল তলোয়ার বিহীন মানুষ শত্রুর মোকাবিলায় প্রতিদিনই মার খাচ্ছে অসহায় ভাবে, আসল শত্রু করোনা বিনা বাধায় একের পর এক দেশ ও অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে। ধনী, গরীব, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষ, শিশু-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, সাদা-কালো-বাদামী, হিন্দু-মুসলামান -খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-ইহুদি-নাস্তিক- সবার সামনে এখন একটাই শত্রু, তাহ’লো করোনা।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই বাংলাদেশের ও এই মূহূর্তে প্রধান প্রতিপক্ষ, শত্রু করোনা ভাইরাস। এই শত্রু একেবারে অজানা না হলেও অদৃশ্য, তবে একেবারেই অদৃশ্য তা কিন্তু বলা ঠিক হবে না। কেননা, আমরা জানি যে কি করলে কার্যকরভাবেই এই শত্রুকে এড়িয়ে চলা সম্ভব। যেহেতু, হাতের কাছে করোনা শত্রু সামনাসামনি মোকাবিলার কোন কার্যকর অস্ত্র (ভ্যাকসিন কিংবা সুনির্দিষ্ট ওষুধ) নাই, সেহেতু, আপাততঃ শত্রুর মুখোমুখি না হয়ে এড়িয়ে চলার মাধ্যমেই নিজেদের সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। তবে কতদিন এড়িয়ে চলবো সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমি বলি বেশীদিন নয়, বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা নিরলস পরিশ্রম করছেন। কয়েকটি দেশেই যুগপৎ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা চলছে, খুব বেশী হলে ছ’মাস, আমি বিশ্বাস করি এর বেশী সময় লাগবে না। তবে আমি এও বিশ্বাস করি, সুনির্দিষ্ট ওষুধ তার আগেই বাজারে আসবে, তখন করোনা ঠান্ডা জ্বরের চেয়ে বেশী কিছু মনে হবে না। কিন্তু তার আগে এই শত্রুকে এড়িয়ে চলার জন্য যে কাজগুলো করতে পারেন তা হ’লোঃ

### ঘরে থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন;
### আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হোন, মানসিক শক্তি বাড়ান;
### করোনা মানেই নিশ্চিত মৃত্যু নয়, করোনা হলে আপনি বেঁচে গেলেও আপনার পরিবারের বয়স্ক কিংবা ক্রনিক রোগেভোগা সদস্য কিন্তু মারা যেতে পারেন, সেটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে;
### ধর্মপালনে যার মানসিক প্রশান্তি আসে তিনি ঘরে বসেই নিজ ধর্ম বেশী বেশী করে পালন করুন, ছবি এঁকে, গান শুনে বা গেয়ে কিংবা মুভি দেখে যার ভাল লাগে তিনি ঘরে বসে তাই-ই করুন;
### যাচাই, বাছাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেওয়া তথ্য বিশ্বাস করবেন না। বরং মূল ধারার গনমাধ্যমের তথ্যে বিশ্বাস রাখুন, এই যুগে কোন তথ্য গোপন রাখা যেমন প্রায় অসম্ভব ঠিক তেমনি করোনা সম্পর্কে কোন তথ্য গোপন করার কোন কারন ও নাই;
### বিষোদগার কিংবা ঘৃনা বিদ্বেষ না ছড়িয়ে বরং করোনা মোকাবিলায় যারা ফ্রন্টলাইনে আছেন তাদের সমর্থন করুন, সহায়তা করুন;
### ইতোমধ্যেই, যারা ফ্রন্টলাইনে লড়াই করছেন যেমন, চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাসদস্য, সাংবাদিক-আপনাদের ভাই, আপনাদেরই আত্মীয় কিংবা বন্ধু-তাদের সহায়তা করুন, তাদের পাশে দাঁড়ান;
### আপনি যদি চিকিৎসাকর্মী, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, সংবাদকর্মী কিংবা আপনার স্ত্রী, সন্তান, মাতাপিতা, ভাইবোন, বন্ধু বা পাড়াপ্রতিবেশীকে সহায়তা করতে চান, তা’হলে ঘরেই থাকুন;
### জরুরী প্রয়োজনে বাইরে গেলেও স্বাস্থবিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলুন।

করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইটা একেবারেই সাময়িক এবং সহজ ও বটে। WHO এবং IEDCR-এর পরামর্শ মেনে চলার মাধ্যমেই করোনাকে পরাজিত করা সম্ভব।

বিশ্বাস রাখুন, “আমরা করবো জয় একদিন।”