Logo

আদিবাসী সংস্কৃতির ধারক-বাহক; বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি

অনিন্দ্য বাংলা
বৃহস্পতিবার, মার্চ ৩১, ২০২২
  • শেয়ার করুন

তোবারক হোসেন খোকন, দুর্গাপুর (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি: বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠির নান্দনিক ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত সংস্কৃতি জাতীয় সংস্কৃত যোগ করেছে এক অনন্য বৈচিত্র। আর সে সব নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মুল্যবান ও আকর্ষনীয় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই দুর্গাপুর উপজেলার আদিবাসী এলাকা মেঘালয় কন্যা সোমেশ্বরী নদীর পাদদেশে, বিরিশিরিতে ১৯৭৭ সালে গড়ে ওঠে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি।

প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষনে এক উল্লেখ্যযোগ্য ভুমিকা পালন করে আসছে এই একাডেমি। এর মুল লক্ষ্য হচ্ছে আদিবাসীদের মধ্যে ঐতিহ্য-সচেতনতা সৃষ্টি এবং নিজস্ব সংস্কৃতির গুরুত্ব উপলব্ধিতে জাতীগত বৃহত্তর জনগোষ্টির মধ্যে পারস্পারিক সম্পৃতি, সৌহার্দ্য ও সু-ভাতৃবোধ জাগ্রত করা। বাংলাদেশের অন্যতম সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালু সম্প্রদায় বৃহত্তর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর গড় অঞ্চল, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোণার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী সহ সুনামগঞ্জ ও মৌলভী বাজার জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা গুলোতে এদের বসবাস। এ জনগোষ্টি শত প্রতিকুলতার মধ্য থেকে তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখে চলেছে। সময়ের আবর্তে তাদের সাংস্কৃতিক জগতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও এখনও সম্বৃদ্ধ ও বৈচিত্রময় রয়ে গেছে। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে, অতিথি আপ্যায়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পিছিয়ে নেই আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের সমাজে এখনও যে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয় তা বেশ সমৃদ্ধ ও মনোমুগ্ধকর। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই এগুলো ধরে রেখেছে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক আদিবাসী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ওয়ানগালা ও আদিবাসী সমাবেশ, যেখানে মিলন মেলায় পরিনত হয় বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের।

গারো-হাজংদের কৃষ্টি সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে বাঁিচয়ে রাখার প্রয়াসে সর্ব প্রথম এগিয়ে আসেন দুর্গাপুরের আদিবাসী এলাকা বিরিশিরির এক উচ্চ শিক্ষিত নারী প্রয়াত বিভা সাংমা। তাঁর জীবনের শেষ সময় টুকুও বিলিয়ে দিয়েছেন এই কালচারাল একাডেমির জন্য। পরবর্তিতে বিশিষ্ট কবি রফিক আজাদ ১৯৯৬ সালে অত্র একাডেমিতে পরিচালক হিসাবে যোগদান করে বাংলা গান, বাউল, পালাগান, বিচার পালা, সহ কবিগানের মত উপজাতীয় কিছু রেঁ রেঁ গানের স্তবক উদ্ধার করেন। বর্তমান পরিচালক বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার সুজন হাজং ২০২১ সনের ২৫ ফেব্রুয়ারীতে যোগাদনের পর থেকে গারো, হাজং, কোচ, বানাই ও ডালু সম্প্রদায়ের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। আদিবাসী শিল্পীদের গহনাগাঁটি, অত্যাধুনিক বাদ্যযন্ত্র, ব্যবহৃত অস্ত্র, বস্ত্র-পরিচ্ছদ সহ কুটির শিল্পের প্রচুর আসবাবপত্র সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ করেন আদিবাসী যাদুঘর। সেইসাথে গবেষনা ও সাংস্কৃতিক শাখাকে উন্নত করে বাংলা সংস্কৃতিতে এনেছেন নান্দনিকতা। জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে গান লিখে বেশ সারা পেয়েছেন গীতিকার সুজন হাজং। আদিবাসীদের নৃত্য কলা, সংগীত, অভিনয় সহ আদিবাসীদের নৃত্যগীত ও অভিনয়ের জন্য শিল্পীদের প্রশিক্ষণ, মিউজিকের উপর প্রশিক্ষণ, বাংলা সাধারন ও লোকনৃত্য সহ নজরুল ও রবীন্দ্র সংগীত এবং আধুনিক গানের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে আদিবাসী সংস্কৃতি তথা বাংলা সংস্কৃতিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন তিনি।

অত্র একাডেমি‘র গবেষনা শাখাকে আরো সম্বৃদ্ধ করতে আদিবাসীদের উপর লিখিত পুস্তকসহ সাধারণ জ্ঞানের উপর প্রায় ৫ হাজার মুল্যবান পুস্তক সংগ্রহ করা হয়েছে। জ্ঞান পিপাসুরা এই লাইব্রেরীতে এসে লেখাপড়া ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন প্রতিনিয়ত। এছাড়া সু-সজ্জিত করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কর্নারকে। বর্তমান পরিচালক সুজন হাজং একজন সংস্কৃতিসেবী হওয়ায় আগের তুলনায় এখন প্রতিটি সাংস্কৃতিক পর্বই পালন করা হয়ে থাকে। সেইসাথে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে একাডেমির রেষ্ট হাউজ, অডিটরিয়াম, আদিবাসী শিল্পীদের পোষাকসহ আশ-পাশের খালি জায়গাতে রোপনকৃত ফুল বাগান।

গীতিকার ও কবি সুজন হাজং এ প্রতিনিধি কে বলেন, প্রতিটি জাতীরই রয়েছে নিজ নিজ সংস্কৃতি। আর ওই সংস্কৃতির মাঝেই খুঁজে যাওয়া যায় তাদের ঐতিহ্য। আমি অত্র একাডেমিতে যোগদানের পর থেকে অত্র এলাকার আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমি সংস্কৃতি মন্ত্রনালয় কে ধন্যবাদ জানাই, আমাকে অত্র একাডেমি‘র পরিচালকের দায়িত্ব দেয়ার জন্য। আমি আমার দায়িত্ববোধ থেকে অত্র অঞ্চলে বসবাসকারী সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি উদ্ধারে এলাকার প্রবীণ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সহায়তা নিয়ে কাজ করছি। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন সহ তাদের সংস্কৃতি রক্ষা ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে আধুনিকায়ন করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন। এ সকল কাজে সহায়তা করতে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তরুণ এই পরিচালক গীতিকার সুজন হাজং।

যারা প্রাকৃতিক নিবিড় সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটাতে চান, দেখতে চান আদিবাসীদের নৃত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, বাংলাদেশে অল্প পরিচিত অথচ দর্শনীয় ব্যতিক্রমি স্থান, উপভোগ করার জন্য বেড়াতে আসতে পারেন নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেতিতে। এর পাশেই রয়েছে মেঘালয় কন্যা সোমেশ্বরী নদীর বুকে কালো সোনা (কয়লা), মোটা বালু ও বিজয়পুর এলাকায় বিশাল বিশাল সাদা মাটির (চীনা মাটির) কোয়ারী। পাহাড় ও নদী যেন এক হয়ে মিশে আছে। শত শত খেটে খাওয়া নারী-পুরুষ নদীর বুক থেকে বালু ও কয়লা উত্তোলন করছে জীবন জীবিকার তাগিদে, যা এখানে এলেই দেখা যাবে। ভ্রমন পিপাসুদের হাত ছানি দিয়ে ডাকছে সাদা মাটি এলাকার নীল পানি।