Logo

আশুরার তাৎপর্য ও আমাদের করণীয়

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, আগস্ট ১৭, ২০২১
  • শেয়ার করুন

ভূমিকা : কালচক্রে আবারো আমাদের সামনে উপস্থিত হলো মুহাররম মাস। ইসলামী হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররম, আর এর দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। আশারা অর্থ দশ উক্ত দশ শব্দ হতেই আশুরা নির্গত। যার অর্থ দশম দিবস। মূলত মুহাররমের মাসটাই ফযিলত পূর্ণ। পবিত্র কুরআনুল করীমে মুহাররম, জিলকদ, জিলহজ্ব, ও রজব এ চার মাসকে হারাম তথা সম্মানিত করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ এরশাদ করেন নিশ্চই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারোটি যা আল্লহর কিতাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সেদিনেই আসমান জমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। তন্মধ্যে চার মাস হারাম (সম্মানিত) (সুরা তাওবা-৩৬)
এ চার মাসের সম্মানেই ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ মাস গুলোতে যুদ্ধ বিগ্রহ করা হারাম ছিল। পরবর্তীতে বিশেষ কল্যানে এ হুকুম রহিত হয়ে সকল মাসেই জিহাদ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এ মাস গুলোর সম্মান ও ফজিলত বহাল থাকে।
এ মাসের ফযীলত : উক্ত চার মাসের ফযীলত সর্ম্পকে ইমাম জাছ্ছাস (রহ) বলেন, এ মাসগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, যারা এ চার মাস বিশেষ ভাবে ইবাদত-বন্দিগীতে কাটাবে; অবশিষ্ট আট মাস তাদের অন্যায় ও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হবে। (তাফসীরে আহকামুল কুরআন)
এ চার মাসের মধ্যে আবার মুর্হারমের বিশেষ মর্যাদার কথা বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন- রমযানের পর অধিক ফযীলতের রোজা হলো, আল্লাহর মাস মুর্হারমের রোজা। হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম বলেন, রমযানের পর যদি তোমরা রোজা  রাখার ইচ্ছা কর তাহলে মুর্হারম মাসের রোজা রাখ। কারণ এটা আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন দিন আছে যে দিন আল্লাহ তা‘য়ালা গোনাহগার অনেক বান্দার তাওবা কবুল করেন এবং তাদেরকে গুনাহ হতে মুক্ত করেন। মুর্হারম মাসের অন্যতম ফযীলতময় দিবস হচ্ছে আশুরা। বৎসরের দিবসসমূহে অনন্য একটি দিন হল আশুরার দিন। কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট ও গুনাবলীতে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এই দিন বিরল গুরুত্ব ও মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছে। পৃথিবীর শুরু থেকে অদ্যাবধী যত বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মরমান্তিক ঘটনাবলী সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশই এ দিনে হয়েছে। সাহাবীগণ মহানবী সাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম-কে আশুরা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তা‘য়ালা আকাশসমূহ, পর্বতমালা এবং সাগরসমূহ সৃষ্টি করেছেন এই আশুরার দিনে। এমনিভাবে লওহে মাহফুজও এই দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে আল্লাহ তা‘য়ালা আদিপিতা হযরত আদম (আ)-কে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন ও হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম হয়েছিল। তদ্রেুপ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জন্মদিনও ছিল আশুরার দিন এবং হযরত ইসমাঈল (আ)-এর পরিবর্তে দুম্বা জবাই দেওয়া হয়েছিল এই দিনে। এবং মুসা (আ)-কে আল্লাহ ফেরাউনের উপর বিজয়ী করেছিলেন। যাঁকে হত্যা করার জন্য ফেরাউন জন্মলগ্ন থেকেই ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল। কারণ ফেরাউন একদা স্বপ্ন দেখলো যে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিক থেকে একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে গোটা মিসর ঘিরে ফেলেছে। বিস্ময়ের  কারণ হলো যে আগুন কেবল মিসরের আধিবাসি কিবতিদেরকেই জালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বনী ইসরাইলের কাউকে স্পর্শ করছে না। জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বানী    করল যে, ইসরাঈল বংশে এমন ছেলে জন্ম গ্রহণ করবে,  যার হাতে তোমার রাজ্যের পতন ঘটবে। এজন্য ফেরাউন নবজাতক পুত্রসন্তানদেরকে হত্যা করতে শুরু করলো, যখনই কোন ছেলে জন্মগ্রহন করত তখনই মেরে ফেলত। কিন্তু মহান আল্লাহ সেই মূসা (আ)-কে ফেরাউনের প্রতিপালনেই বড় করেন। পর্যাক্রমে এই মুসার হাতেই তার রাজ্যের পতন ঘটে। আর যেদিন মুসা (আ) ও তার উম্মতগণ এই জালেম খোদাদ্রহী শাষকের উপর বিজয়ী হয়েছিলেন সেই দিনটিও ছিল আশুরার দিন। (তাফসীরে জালালাইন)
এই দিনেই দয়াময় আল্লাহ তা‘য়ালা হযরত আইয়ুব (আ)-কে রোগমুক্ত করে ছিলেন। এই দিনেই হযরত আদম (আ)-এর তাওবা কবুল করেছিলেন। অনুরূপভাবে এই দিনে বেদনা বিধুর মর্মান্তিক ইতিহাস সৃষ্টিকারী হযরত হুসাইন (রা)-এর শাহাদাতের ঘটনা সংঘঠিত হয়েছিল। এমনকি বর্ণিত আছে যে কিয়ামত দিনেই সংঘঠিত হবে।
আশুরা দিবসে করণীয় : আশুরার করনীয় কী? আমাদের বুঝতে হবে যে, হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে- হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন মহানবী (সা) মদীনায় তাশরীফ আনলেন তখন সেখানকার ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা রাখত। এটা দেখে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এটা ঐদিন যেদিন মহান আল্লাহ মুসা (আ) ও বনী ইসরাঈলদেরকে ফেরাউনের উপর বিজয় দান করেছিলেন। তাই আমরা এদিনের সম্মানার্থে রোজা রাখি। তখন মহানবী (সা) বললেন, আমি হযরত মুসা (আ)-এর সম্পর্কে তোমাদের চেয়ে বেশী হকদার অর্থাৎ, হযরত মুসা (আ) এর অনুসরণ আমরা বেশী করি। এরপর হযরত (সা) নিজে রোজা রাখা আরম্ভ করলেন এবং সাহাবীদেরকেও আশুরা দিবসে রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করলেন। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাযাহ)
আশুরা দিবসে রোজার ফযীলত : আশুরার দিন রোজা রাখার ফযিলত হল, হযরত কাতাদা (রা) বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখার ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আশা রাখি যে, আশুরার দিনে রোজা রাখালে তিনি পিছনের এক বছরের (সগীরাহ) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (বুখারী, মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
এবিষয়ে অন্য হাদীসে হুজুর (সা) বলেছেন, যে ব্যাক্তি আশুরার দিন রোজা রাখবে মহান আল্লাহ তা‘য়ালা তার আমল নামায় ষাট বছরের রোজা রাখার ও রাত্রি জাগরনের সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। (আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ) রচিত আল মাআলিল মাসনুআহ ফিল আহাদীসিল মাওযূআহ- ২/১০৮; হাদীস নং- ১৫০৯)
অপর এক হাদীসে হুজুর (সা) বলেন, রমজানের রোজার পর সব চাইতে ফযিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মহান আল্লাহর সেই মাসে যাকে তোমরা মুহাররম বলে জেনে থাকো, আর ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম নামাজ হচ্ছে কিয়ামুল লাইল। (মুসলিম শরীফ)
আশুরার রোজা কয়টি : এখন জানার বিষয় হলো রোজা একটি রাখবো নাকি দুইটি এ বিষয়ে হুজুর (সা) বলেন, আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ১০ তারিখের আগের দিন ৯ তারিখ  রোজা রাখবো যাতে করে ইয়াহুদীদের সাথে সমাঞ্জস্য না হয়। এ জন্যই মুর্হারমের দশ তারিখের আগে বা পরে যে কোন একদিন মিলিয়ে রোজা রাখা সুন্নত এবং শুধু ১০ তারিখে রোজা রাখা মাকরুহে তানযিহি।
আশুরা দিবসে যা বর্জণীয় : আমাদের সামনে গুরুত্ব ফযিলতের বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়েগেছে। আমাদের সমাজে এদিন নিছক বিজাতীয় স্টাইলে কারবালাসংক্রান্ত নানা কুপ্রথার অবতারনা করে থাকে। এমন কর্মকাণ্ডের কোনটি শিরকী, কুফরী পর্যায়ের, কোনটি হারাম পর্যায়ের, কোনটি বিদআত পর্যায়ের, অনেক ভ্রান্ত শিয়াদের গর্হিত রীতি-নীতি থেকে এজাতীয় অনৈসলামিক কাজ মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। সেই সকল নাজায়েয রীতি প্রথা থেকে রয়েছে- তাজিয়া বানানো তাতে ভেট দেয়া, নযর নিয়াজ দেয়া, এর প্রতি করজোরে ভক্তি প্রদর্শন করা, তাজিয়া মিছিল করা। হুসাইনী ঘোড়া সাজানো সেই ঘোড়ার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন নিবেদন করা।কবুতর উড়ানো। শিন্নী শরবত বিতরণ করা বা  খাওয়া। কোন স্থানকে কারবালার নাম দিয়ে সেখানে হুসাইন (রা) ও ইয়াযীদের নাটকীয় বাহিনী তৈরী করে যুদ্ধ তামাশা করা, লাল-কালো শোকপোশাক বা ব্যাজ পরে হায় হুসাইন বলে মাতম করা, বুক চাপড়ানো প্রভৃতি এসকল শরীয়ত বিবর্জিত কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকা সকলের ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদেরকে বিষয়টি বুঝে আমল করার তৌফিক দান করুন আমীন।
লেখক: মুহা. নেয়ামতুল্লাহ রশিদি
ছাত্র : জামিয়া দারুল উলূম নুরিয়া,
মধ্যবাড্ডা, গুলশান, ঢাকা-১২১২
ফোনঃ ০১৯৬৩-৯৫১১৩১