Logo

উকিল মুন্সি: বাংলার বিরহভাবের সম্রাট | আহমেদ স্বপন মাহমুদ

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, জুন ১২, ২০২১
  • শেয়ার করুন

উকিলের মারপ্যাঁচ বোঝা অত সহজ না! অন্তত স্টুপিড শিক্ষা আর কুলষিত মন নিয়া ভবের চালে-তালে মইজা ভাব ধরা যায় না। ভাবের বোঝাপড়া ভাব দিয়াই করতে হয়। আজ উকিল মুন্সির জন্মদিন। মহাজনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। জয়গুরু।
উকিল মুন্সি: বাংলার বিরহভাবের সম্রাট | আহমেদ স্বপন মাহমুদ

পানির বেদনা কী হাওরের উতলা ঢলের মতন বহমান, দিগন্তহীন আকাশের অশেষের মতন সীমাহীন। সেই বেদনার সুর কী মানবমনকে ছুঁয়ে যায়, ছিঁড়েখুঁড়ে খায়! উতলা ঢেউয়ের অস্থিরতার মতন কী মানুষের পোড়া মন। মনের গোপনে কী কী আছে যা হাসায় কাঁদায়, আপ্লুত করে, বেদনায় ভরে দেয়। কী সে পরশপাথর যা বেদনায় হেসে ওঠে। কোত্থেকে আসে বেদনা। বিরহ-বিচ্ছেদ কেন কেবলি বেদন জাগায় মনে। কেন মায়া হয় নায়রির নাও দেখে। মায়া কী! বিস্তৃীর্ণ হাওরের তাজা পানির ঢেউয়ের তালে তালে কারা আবার নেচে নেচে নৌকাবাইচ করে, গান গায়। সেই সুর কী মধুর, বেদনা ও মায়ার। দৃশ্যের আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত নাওয়ের দৃশ্য, মানুষ হারিয়ে গেলে অবশিষ্ট কেবলি কী মায়া। ঢেউ হাহাকার করে ওঠে, বুক থরথর করে, মন কাঁপে ডংকারে। জলের নাচনে পাড়হীন হাওর প্রজগে ওঠে। এই জেগে ওঠা দেখে দেখে বাংলার ভাবপ্রকৃতি গঠিত হয়েছে। বাংলার ভাবদর্শনে ভাটিবাংলার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
‘আষাঢ় মাইসা ভাসা পানি রে, পূবালি বাতাসে’ গানের মর্মভেদ করতে হলে হাওরের বিস্তৃীর্ণ জলের ঢেউয়ের মর্মকেও বুঝতে হবে।
উকিল মুন্সি গান করেছেন বিরহবেদনার। বন্ধুর বিরহবিচ্ছেদে কাতর উকিলের মন বারবার বন্ধুর কাছে আকুতি করেছেন, তাকে পাবার। বাংলা গীতিকাব্যে এই বন্ধু বান্ধব, বন্দে, বান্ধই হিসেবে উল্লেখ আছে। আর বন্ধু কখনো পরানবন্ধু, দীনবন্ধু, দয়ালবন্ধু, নিঠুর বন্ধু ইতাদি নানা নামে আখ্যায়িত হয়েছে। উকিল মুন্সির গীতিকাব্যে বন্ধুর প্রতি গভীর আকুতি দেখা যায়। বন্ধুর বিরহে কাতর তিনি। বন্ধুর জন্যই যেন অর্ঘ্য হিসেবে অন্তরের আকুলি-ব্যকুলি প্রকাশ করছেন তিনি।এ-ও ঠিক এই বন্ধু কেবল রক্তমাংসের বন্ধু না, কেবলি দেহজ পিরিতির জ্বালায় কাতর বন্ধুর মায়া না, এই বন্ধু দয়ালবন্ধু, পরমবন্ধু হিসেবেও তার কাব্যে বিস্তর পাওয়া যায়।
বাংলার ভাবপরিমণ্ডলে রাধাকৃষ্ণ লীলা শত শত বছর ধরে বাংলার সংস্কৃতি ও জীবনধারায় যুক্ত হয়ে আসছে। বাংলার গীতিকবিরা সেই প্রেমলীলা রূপ দিয়েছেন কখনো ঐশ্বরিক প্রেমকে মানবিক করে, কখনো যেন মানবের প্রেমকে ঐশ্বরিক করে। এই দোলাচল ও রূপাকার তাৎপর্যময়। কারণ মানুষ খুঁজতে গিয়ে পরমের সন্ধান আর পরম খুঁজতে গিয়ে মানবের সন্ধান এই ভাবদর্শন বাংলার আদি প্রকৃতির মূল ভাব।
উকিল মুন্সীর গীতিকাব্যের সাবলীল বৈশিষ্ট্য তাঁকে স্বতন্ত্র করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কাব্যের উতলা ভাব কেবল নয়, বরং শব্দ-বাক্যের ঘোর লাগা বেদনার প্রকাশ, পৌরাণিক প্রেমকাহিনি, চয়ন ও প্রকাশভঙ্গি তাঁকে মহিমান্বিত করে তোলে। আমরা তাঁর কাব্য থেকে উদাহরণ দিতে পারি। যেমন:
আমার প্রাণবন্ধু আসিয়া কাছেতে বসিয়া/ নয়নের জল আমার মুছিয়া দিবে/ এমন সুদিন আমার কোনদিন হবে।

আমার দুই নয়নের পানি বহে দিনরজনী/এই দুঃখের কাহিনি আর কতদিন রবে/ এইভাবে রাধায় কান্দে যদি সদায়/ আমি মরিয়া গেলে কারে দেখাবে।

উকিল মুন্সির কাব্যসুষমার মহিমাও তাকে স্বতন্ত্র করে তুলে। প্রাণপ্রকৃতির সাথে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের আনন্দ-বেদনা এমনভাবে প্রকাশ করেছেন তা প্রকৃত কাব্যের সৌন্দর্য্যেকে ছুুঁয়ে যায়। যেমন:

আমার প্রাণবন্ধুর তালাশে যে-সখি যাইবে
পরশমণি চরণ তাহার ও সখি ভাগ্যেতে জুটিবে গো।
পূবেতে উদয় ভানু পশ্চিমে ডুবিবে গো সখি
অমাবশ্যা রাইতে নি কেউ ও সখি পূর্ণিমা দেখিবে গো।

চিরায়ত সত্যের এমন সুন্দর প্রকাশ তার কাব্যকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। উকিলের গানে মর মর বেদনার ভার পাঠকশ্রোতাকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। গীত কাব্যগুলো এমন বেদনা নিয়ে হাজির হয় যে মানবমনের গুপ্তরহস্যের জায়গাগুলো ছুঁঁয়ে বিচ্ছেদ-বিরহ ভাবে ভরে তোলে। যেমন:

আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
বন্ধুয়ারে কর তোমার মনে যাহা লয়।
নিঠুর বন্ধুরে বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই ভেবে
সাক্ষী তো ছিল না সেই সময়।।

জলের আর হাওয়ার দোলায় কাঙাল উকিলের প্রাণ বেদনায় ভরে উঠেছে আর তিনি সাবলীলবাবে আমাদের বাংলার ভাব ও মরমকে সমৃদ্ধ করেছেন। আবার দেখি উকিলের বয়ানে,

আমার দুই নয়নের পানি বহে দিনরজনী
এই দুঃখের কাহিনি আর কতদিন রবে
এইভাবে রাধায় কান্দে যদি সদায়
আমি মরিয়া গেলে কারে দেখাবে।
আমার গেল না দুঃখ বিধাতা বৈমুখ
আর কী সুখ উকিলের হবে
আমার প্রাণবন্ধু বিনে এই ত্রিভূবনে
এমন দয়া আমায় কে করিবে।

উকিলের গীতকাব্যের মূল সুর মানবমনের অন্তগূঢ় বেদনা। এই বেদনাকে বন্ধু, সখি, রাধাকৃষ্ণসহ বিভিন্ন মিথের মাধ্যমে, প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণের অভিপ্রকাশের মাধ্যমে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। উকিলের প্রেমভাব দশা কেবল মানুষের নারীপুরুষের সম্পর্কের প্রেমভাব নয়, অনেকক্ষেত্রে তা পরমঅন্বেষণ ও পরমকে দেখার আকাঙ্ক্ষার, পরমে বিলীন হবার বাসনার তীব্র প্রকাশ।