Logo

এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়ামে ৩৬৫ বছরের পুরোনো সারিন্দা !

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, মে ২১, ২০২২
  • শেয়ার করুন

শেখ  অনিন্দ্যমিন্টু : ময়মনসিংহে  ৩৬৫ বছরের পুরোনো সারিন্দা প্রদর্শনী করে তাক লাগিয়ে দিলেন হাজারো দর্শককে ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’ । আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী শতবর্ষী সারিন্দা প্রদর্শনীর আজ ছিলো শেষ দিন। এই প্রদর্শনীতে সতের শতাব্দী থেকে উনিশ শতাব্দীর সংগৃহীত ১২টি দুর্লভ সারিন্দা সহ পাশাপাশি ৬০০ বাদ্যযন্ত্রও ছিলো।  প্রতিদিন দুপুর ১২ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলো এই প্রদর্শনী।
‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’ এর আয়োজনে গত বুধবার বিকেল থেকে ময়মনসিংহ নগরীর কাঁচিঝুলির ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ভবনের নিচ তলায় ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’ গ্যালারিতে ছিলো এই আকর্ষণীয় সারিন্দা প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর সাথে ছিলো পুঁথি পাঠ, বাউল বৈঠক, শিশুদের সংগীত ও যন্ত্রসংগীত। সহযোগিতায় ছিলো নোভিস ফাউন্ডেশন ও ময়মনসিংহ বাউল সমিতি।

বাদ্যযন্ত্র গবেষক, লোকজ সংস্কৃতি সংগ্রাহক ও নোভিসের পরিচালক রেজাউল করিম আসলাম বলেন, তিন পুরুষ ধরেই এই বাদ্যযন্ত্র ব্যবসার সঙ্গে বংশ পরম্পরায় জড়িত আমার পরিবার। ময়মনসিংহের বড় বাজারে ‘নবাব অ্যান্ড কোং’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান আছে আমাদের। ১৯৪৪ সালে দাদা নবাব আলী বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর বাবা, পরে আমি ব্যবসা করছি।

বংশপরম্পরায় বাদ্যযন্ত্রের প্রতি রয়েছে বিশেষ ভালোবাসা তাই ২০০৬ সাল থেকে শুরু করি বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ। বিশেষ করে পুরোনো ও বিলুপ্তপ্রায় বাদ্যযন্ত্রগুলো সবার আগে সংগ্রহ করতে চাই। এসব বাদ্যযন্ত্র প্রচুর কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হয়।  অনেক সারিন্দা কারো রান্নাঘর, কারো গোয়ালঘর, কারো উগার বা সিলিং থেকে পাওয়া গেছে। যাদের কাছে থেকে পাওয়া গেছে তারা জানে না এর ঐতিহাসিক বা ঐতিহ্যগত মূল্য কতো ! অনেক সারিন্দা চুলার লাকড়ী বা মাটিতে মিশে ফসিল হয়ে গেছে।

প্রর্দশনী নিয়ে রেজাউল করিম আসলাম আরো জানান, বর্তমানে বাদ্যযন্ত্রের তৈরিকারক, বাদক, উপকরণ সবই হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় সারিন্দা ছিল খুবই মুল্যবান। যারা বাজাতো তারাও ছিলেন মরমি লোক। এগুলো হারানো বা নষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এই উদ্যোগ। প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য হলো সবাই জানুক, সারিন্দা আসলে কি?  আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ধারক-বাহক এসব পুরাতন সারিন্দাগুলো যেনো বিলুপ্ত না হয়। আর নতুন প্রজন্মের কাছে এই দেশীয় বাদ্যযন্ত্রটি নিয়ে যেন নতুন করে আগ্রহ তৈরি হবে, হয় আশা নিয়েই এই অসাধারণ আয়োজন।

সবচেয়ে পুরানো সারিন্দাটি পাওয়া গেছে  বুড়িমারি, কুড়িগ্রাম এর রহমান ফকিরের কাছ থেকে। এর বয়স প্রায় পাওয়া ৩৬৫ বছর। সংগৃহীত সারিন্দার মধ্য এটিই সবচেয়ে পুরোনো । কালীররহাট, লালমনিরহাট, গুনধর বাবুর কাছ থেকে পাওয়া গেছে আরেকটি সারিন্দা যার বয়স প্রায় ৩০০ বছর।

হারিয়ে যাওয়া দেশজ বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সারিন্দা অন্যতম। সারিন্দা হলো লুটে বা বেহালার অনুরূপ একটি তারযুক্ত ভারতীয় লোক বাদ্যযন্ত্র। এটি ধনুকাকৃতির ছড় দ্বারা বাজানো হয় এবং এতে দশ থেকে ত্রিশটি তার থাকে। মূল কাঠামোর প্রশস্ত অংশ দুপাশে বেশ চাপা থাকে, ওপরে থাকে চামড়ার ছাউনি এবং বাকি অংশ দন্ডাকৃতির। দেড় ফুট লম্বা কাঠ দিয়ে তৈরি যন্ত্রটিতে চামড়ার তিনটি তার যুক্ত থাকে। সারিন্দার মাথা ময়ূর কিংবা অন্যান্য পশুপাখির মাথার মতো। যেখানে তিনটি কাঠের বলয় রয়েছে। এগুলোকে বলা হয় কান। চামড়ার তারগুলো মূলত এ কান থেকে সারিন্দার শেষ প্রান্তজুড়ে আংটা দিয়ে আটকানো থাকে। এ কান ঘুরিয়ে ইচ্ছেমতো সুর নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সারিন্দার ব্যবহার আজকাল দেখা যায় না বললেই চলে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সারিন্দা পাওয়া যায় তা সাধারণত ছুতার বা কাঠ মিস্ত্রির দ্বারা বাদকের নির্দেশনা অনুযায়ী তৈরি। কেউ কেউ আবার নিজের সারিন্দা নিজেই বানিয়ে নিতেন কুড়াল, খুন্তা, বাইশা, বাটাল দিয়ে। সেক্ষেত্রে মনপবন, নিম, চন্দন, লোহা,  শাল, বৈলাম ও মেহগিনি কাঠ ব্যবহার করা হতো। সারিন্দা বাজানো হয় ছড়ের সাহায্যে। ধনুকাকৃতির এই ছড় পশুর লেজের চুল বা রেশম সুতা দিয়ে তৈরি। সাধারণত  বিচার গান,  মুর্শিদি গান, নৌকাবাইচের গান,  কবিগান ইত্যাদিতে অনুষঙ্গী যন্ত্র হিসেবে সারিন্দা বাজানো হয়; তবে স্বতন্ত্রভাবেও এতে গানের সুর তোলা যায়। সাধারণত মুর্শিদি ও কেচ্ছা গানের অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গে এটি বাজানো হতো। আজ মুর্শিদিও নেই, সারিন্দাও নেই।

সারিন্দার পাশাপাশি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে সন্তর, শরৎ, সানাই, বেহেলা, তবলা, বিনা, সারেঙ্গি, সেতার, তানপুরা, একতারা, গিটার, বাঁশিসহ আরও অনেক বাদ্যযন্ত্র।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার ডেপুটি-কিপার মুকুল দত্ত বলেন, “এই ধরনের আয়োজন আরও বেশি হওয়া উচিত। এর মূল বার্তাটি সবার কাছে পৌঁছলে আমাদের লোকজ সম্পদ ও লোকজ ঐতিহ্য বিপুপ্তি থেকে রক্ষা পাবে।

বাউল শিল্পী সুনীল কর্মকার বলেন, সারিন্দা বাঙালির প্রাচীনতম বাদ্যযন্ত্র। এটি সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এসব যন্ত্র সংরক্ষণ করে রাখা খুবই জরুরি। সংরক্ষণ করে না রাখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না যে তাদের নিজস্ব একটা বাদ্যযন্ত্র ছিল। এসব যন্ত্র সম্পর্কে কেউ জানলে, তাহলে সে নিজেরে জানল এবং নিজে কিছু শেখার সুযোগ পেল।”

“সাড়ে ৩০০ বছর আগে সারিন্দার ভালো প্রচলন ছিল। এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমরা গুরুজনের সঙ্গে আলোচনায় মনে করি সারিন্দা শেখা আমাদের খুব দরকার। প্রদর্শনীতে এসে বুঝতে পারলাম এটার গুরুত্ব অনেক। আমাদের মতো যারা রয়েছে সবার উচিৎ এ বিষয়ে অবগত থাকা। এখানে এসে অনেক উৎসাহিত হচ্ছি।

বাউল শিল্পী আবুল কাশেম সরকার বলেন, “এটি একটি ব্যতিক্রম প্রদর্শনী। “এমন আয়োজন শিল্পীমনকে প্রফুল্ল করে। প্রদর্শনীর মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রকে মানুষ নতুন করে জানতে পারবে। এখানে এসে খুব ভালো লাগছে। সারিন্দা সম্পর্কে অনেক ধারণা নিতে পারছি। এগুলো সম্পর্কে আমাদের আগে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। এসব প্রদর্শনী নিয়মিত হলে নিজেদের সংস্কৃতির বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে ভালো জানতে পারবে মানুষ।”

আয়োজনটির সঙ্গে সমন্বয়করী হিসেবে কাজ করছে জয়িতা অর্পা ও শৈল্পিক নির্দেশনায় জাওয়াতা আফনান।