বিশেষ আর্টিকেল: দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের হার দিনদিন বেড়েই চলেছে। মৃত্যুও বাড়ছে তালমিলিয়ে।আজ পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৬৩৪১৩২ এবং মৃত্যু সংখ্যা ৩১১৭৮১ । বাংলাদেশে সরকারী হিসাব মতে এই আক্রান্তের সংখ্যা ২২,২৬৮ এবং মৃত্যু সংখ্যা ৩২৮। আরো বেশী হারে রোগ নির্নয় সম্ভব হলে এই সংখ্যা যে বেশী হবে তা অনেকেই মনে করে।
করোনার এই মহামারি কালে আরেক প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গু, মহীরূহ-করোনায় চাপা পড়লেও তার অবস্হান জানান দিতে খুবই তৎপর হয়ে উঠেছে।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ লোক প্রাণ হারিয়েছে। সরকারি হিসাবে এ মৃতের সংখ্যা ১৭৯। এবছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে ডেঙ্গু তার গুরুত্ব কম পাচ্ছে। তবে গত বছরের প্রথম তিন মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ গতবারের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ছিল ৭৩ জন। এ বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে এ রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৬৯ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম তিন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার গুণ বেশি।
গত বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। এবছর যাঁরা দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক বেশী হবে।
কভিড-১৯ রোগের ভরকেন্দ্র চীন, ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে এখন দক্ষিন এশিয়া তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান এর দিকে।এই রোগের কার্যকর ঔষধ ও টিকা আবিষ্কার না হওয়ায় প্রতিরোধই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। আর যারা আক্রান্ত হয়েছে, রোগের মাত্রা(Severity) অনুযায়ী দ্রুত লক্ষন ও জটিলতা ভিত্তিক চিকিৎসা শুরু করা গেলে মৃত্যু কমানো যাবে।
মহামারী নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে- দ্রুত রোগ-নির্ণয় করা, রোগীকে আইসোলেশন করা, কন্টাক্ট ট্রেসিং করে কোয়ারেন্টাইনে আনা এবং আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া। এক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনে কঠোরতা অবলম্বন করার প্রয়োজন হতে পারে। সমাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি তাদের জনগণকে নিয়ম মানতে বাধ্য করতে পারে কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার জনগণের উপর এতটা কঠোরতা প্রয়োগ করতে পারে না, জনগণ যদি শিক্ষিত এবং স্বপ্রনোদিত হয়ে নিয়ম না মানে।যেমনটা আমরা চীন ও আমেরিকায় দেখেছি। এক্ষেত্রে মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা একেবারেই কঠিন হয়ে যায়। পরিণামে রোগে ভোগান্তি এবং প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর এই সারি দীর্ঘায়িত হবে।
আমাদের মত অধিক জনসংখ্যা ঘনত্বের দেশে শতভাগ কার্যকরী লকডাউন আরোপ করে মানুষকে দীর্ঘদিন ঘরে আটকে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ দলবদ্ধভাবে গল্পগুজব করে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। মানুষ সচেতন নয়, গুজবে বিশ্বাস করে, কুসংস্কার বিশ্বাস করে, বিজ্ঞান মানতে চায়না, গরম পানি খেলে ভাইরাস মরে যাবে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিশ্বাসে কত মানুষ মুখ ও গলা পুড়ে ফেলছে। মানুষ বাজার থেকে ভিটামিন সি, জিঙ্ক, ভিটামিন ডি ট্যাবলেট খেতে খেতে এসব মার্কেট আউট হয়ে যাচ্ছে, ইমিউনিটি স্ট্রং করার নামে। মানুষ খাচ্ছে লেবু, আদা, কালোজিরা, লং সহ আরো অনেককিছু। এগুলো খেলে তেমন ক্ষতি নাই, তবে ইমিউনিটি খুব দ্রুত স্ট্রং হয়ে যাবে ব্যাপার টা এমন নয়। ইমিউনিটি দুই প্রকার- জন্মগত এবং অর্জনীয। জন্মগত ইমিউনিটি অনেকটাই নির্দিষ্টকৃত এবং অর্জনীয় যেটা সেটা ভাইরাসে কেউ আক্রান্ত হলে তার বিরুদ্ধে অর্জিত ইমিউনিটি তৈরী হয়, সেটাও খেলে দ্রুত বেড়ে যাবে সেরকম নয়। ইমিউনিটি যদি বেড়েই যায়, Immunological response যদি বেশী হয়, COVID -19 এর ক্ষেত্রে খারাপ ঘটনা ঘটবে- Cytokine Storm Syndrome বেশী হবে, ফুসফুস (ARDS) সহ অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত বেশী হবে, এতে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে।
এলকোহলে করোনা ভাইরাস মারা যায়। হাত ধোয়ার পাশাপাশি অতিসচেতন এক ব্যক্তি বাজার থেকে এলকোহল কিনে ঘ্রান নিল, মুখ ও গলা ওয়াস করার পাশাপাশি কিছুটা খেয়েও নিল। সম্ভবত বিষাক্ত মেথিলেটেড স্পিরিট ছিল। রাত থেকে পরেরদিন সে কিছুটা কোমায়(Comatose) চলে গেল।বাসাতেই ছিল। লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারলো না, চিকিৎসাও নিতে পারেনি। এর পরের দিন পুরোমাত্রায় কোমায় চলে গেলে আত্মীয়-স্বজন হাসপাতালে আনলেও একটি তরতাজা যুবকের প্রাণপ্রদীপ নিভেই গেল চিরতরে। সুতরাং অতিরিক্ত কোনকিছু করার দরকার নেই। স্বাভাবিক থাকুন।
করোনাভাইরাস খুব দ্রুত চলে যাবে এমনটা মনে হচ্ছে না। যে সমস্ত দেশ করোনা ভাইরাস কে পিছু হটিয়েছে, তারা নিয়ম মেনে জোর-পূর্বক একে পিছু হটতে বাধ্য করেছে, যেটা আমরা এখন পর্যন্ত করতে পারছি না।
হয়ত অনেকেই ভাবছেন, মৃত্যু তো বেশী হচ্ছেনা। হাঁ, এইটা আশার কথা। তবে যাঁরা (~২%) মারা যাচ্ছেন তাদের মধ্যে বয়স্ক( বাবা-মা, দাদা-দাদী) বেশী থাকলেও তরুন-যুবকও আছে, থাকবে এবং এটা আপাতত চলতেই থাকবে। চিন্তা করে দেখুন – পরিবারে একটি অনাকাঙ্খিত মৃত্যু(!) – কখনোই কাম্য হতে পারে না। সুতরাং সতর্ক হোন। করেনা ভাইরাস কখনোই আপনার ঘরে ঢুকবেনা যদি বাহির থেকে নিজের অজ্ঞাতসারে ঘরে না ঢুকান।
করেনা ভাইরাসের টিকা খুব দ্রুত আবিষ্কার হবে এবং কার্যকরী হবে, তা ঠিক বলা যাচ্ছে না। এইচআইভি ও ডেঙ্গু ভাইরাসের টিকা এখন পর্যন্ত আবিস্কার হয়নি।
সুতরাং বাঁচার জন্য প্রত্যেককে করোনার সাথে সহাবস্থানের কৌশল আয়ত্ত করতে হবে, যতদিন না কার্যকরী টিকা বা ঔষধ আবিস্কৃত হয়।
করোনাভাইরাস এর সাথে সহাবস্থান করে একে প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে –
– হাত এবং মুখ-মন্ডলকে রক্ষা করতেই হবে। হাত ঘনঘন ধুয়ার অভ্যাস করতে হবে।
– মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে।
– ঘর থেকে বাহির হইতে হলে, গায়ে জামা পড়ার মত পকেটে এক টুকরা সাবান, একটা ছোট হ্যান্ড স্যানিটাইজার, একটা রুমাল অবশ্যই সঙ্গে করে নিয়ে বের হতে হবে।
– সর্দি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে
– তিন থেকে ছয়ফুট দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে।
এগুলোর প্রত্যেকটি দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
– স্কুল-কলেজে শিশু-কিশোরদেরকে বই মুখস্থ করানোর চাইতেও হাঁচি-কাশির শিষ্ঠাচার, আদব-কায়দা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, সদা সত্য কথা বলিবে এগুলো অধিক গুরুত্ব দিয়ে শিখাতে হবে।
– বাজারে দোকানের সামনে অথবা জনসমাগম স্থানে কমপক্ষে ৩ ফুট দূরত্বে দাঁড়ানোর জায়গা নির্ধারণ করে দিতে হবে,
– প্রতিটা বাজারে/দোকানের সামনে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে মানুষ হাত ধুয়ে প্রবেশ করে।
করোনার সাথে বাংলাদেশে যদি ডেঙ্গু মহামারি শুরু হয়, তা সামলানোর পুরোপুরি ব্যবস্থা বা প্রস্ত্ততি কি আছে বাংলাদেশের? নাকি ঝরবে আরো কিছু তাজা প্রাণ?
ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার লার্ভা নিধনে এখন থেকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে অন্যথায় ডেঙ্গুও মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
সবাই সুস্হ থাকার প্রত্যাশায়।
MBBS, CCD, MCPS, FCPS, MD, MACP.
মেডিসিন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও বিশেষজ্ঞ
কনসালটেন্ট ও আর পি (মেডিসিন)
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
মতামত লিখুন :