Logo

কালা নামের একজন সাদা মনের মানুষ!

অনিন্দ্য বাংলা
রবিবার, মে ১৭, ২০২০
  • শেয়ার করুন

মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল।।

কালা। আনন্দ মোহন কলেজের একটি বহুমাত্রিক চরিত্র। দীর্ঘদিন ধরে সে কলেজ চত্বরে আছে। আমরা কোনোদিন তাঁর ইতিহাস খুঁজে দেখি নি। হঠাৎ করে ফেইসবুকে কালার বিষয়টি উঠে এসেছে।

আমি গতকাল বলেছিলাম কালা কে নিয়ে লিখবো। সারাদিন কালার ইতিহাস খুঁজেছি।

সেটা তুলে ধরা হলোঃ

কলেজের হাজার ছাত্রছাত্রীর কাছে কালা নামটি পরিচিত। একটা অদ্ভুত ক্যারেক্টারের মানুষ সে। একটু প্রতিবন্ধী টাইপ। একটু জাগ্রত করলেই এই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে “কালা” নাম টি উদ্ভাসিত হতে বাধ্য। কলেজের এমন কোনো ছাত্রছাত্রী ছিলো না যার সাথে কালার কথা হয়নি দুই, চার, দশ,বিশ টাকা দেয়নি!

আমি যখন ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলাম কাজী জিএস ছিলো প্রায়শ সে আমাদের কাছে আসতো। কালার ইতিহাস টি অনেক বড়। যা লেখা সম্ভব নয়।

একবার কালা আমাদের ইতিহাস বিভাগের সাথে পিকনিকে গিয়েছিলো মধুপুরে। আমরা যখন ফিরবো তখন দেখি কালা নেই মনিরুজ্জামান স্যার, মনিবুর রহমান স্যার ব্যস্ত হয়ে গেলেন কালার জন্য। সকল ছাত্রছাত্রী বাসে উঠে গেলো। আমি মাইকযোগে কালা কে ডাকতে লাগলাম কিন্তু কালার কোনো খোঁজ মিলে নি এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমরা রওনা দিলাম কালা কে ছাড়াই পরের দিন সকালে আমি ছাত্র সংসদ অফিসে গিয়ে বসলাম দেখি কালা হাঁটতে হাঁটতে আমার অফিসে প্রবেশ করে আমাকে বল্ল

” নেতা আমারে থইয়া আইসো কেয়া “???

আমি তাকে বল্লাম তুই কই গেসিলি? তরে না পায়া আমরা আয়া পরসিলাম।

কালা বল্ল – আমি জঙ্গলে ঘুমাইসিলাম উইঠা দেখি অন্ধকার কেউ নাই বনপুলিশ আমাকে ধইরা মেইনরোড দেখায়া দেয়। আমি সারা রাইত হাঁটতে হাঁটতে আয়া পরসি।

তখন আমি ক’টা টাকা দিয়ে কালা কে বিদায় করলাম। এইভাবেই কালা সকলের সাথে চলতো ফিরতো থাকতো। একটা লাঠি কালার হাতে সকল সময় থাকতো নতুন ছাত্র ছাত্রীরা এসে প্রথমে কালা কে দেখে ভয় পেতো পরে আর এই ভীতি থাকতো না পরে অনেকেই কালা কে নিয়ে মজা করতো।

কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার পর যখন বিয়ে করলাম একদিন কলেজে গেলাম একটি অনুষ্ঠানে আমার বউ কে নিয়ে গেইটেই কালার সাথে দেখা। কালা বলেছিলো –

কই যাউ? তুৃমার বউ রে ত চিনছি সে মিল্কী আপাদের লগে থাকতো। মিল্কী আমার বউ এর বান্ধবী ছিলো। এই কালার সাথে এই কলেজের ধুলো মাটি কণা লাল ইটের গাঁথুনি তারপর শহীদ মিনার বোটানিক্যাল গার্ডেন বাংলা বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কড়ই তোলার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মিটিং মিছিল হিন্দু হোস্টেল, ডিগ্রী হোস্টেল, ইন্টার হোস্টেল এবং বড় পুকুরের পাঁকা ঘাটলা এই সব কিছুর সাথে কালার সম্পর্ক ছিলো। এসব জায়গায় কালা কে পাওয়া যেতো।

অনেক ছাত্রছাত্রীর জন্য কালা ছিলো অপরিহার্য একটি বিষয়। কালা কে দেখে অনেকেই মায়া করতো। শিক্ষক মন্ডলীরা কালা কে স্নেহের চোখে দেখতো এবং প্রশ্রয়ও দিতো। আনন্দ মোহন কলেজের ৭৫ থেকে ৯০ দীর্ঘ সময়ের এক ছাত্র আমি। খুব সম্ভবত ১৯৮৫ সালে কালা কে প্রথম আমি কলেজ চত্বরে দেখি। তারপর দেখেছি কালা কলেজ রোড থেকে কলেজে প্রবেশ করে ইতিহাস সেমিনার থেকে পদার্থ বিজ্ঞান এইভাবে বাংলা, হিসাববিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, অর্থনীতি সবগুলো সেমিনারে ঘুরে বেড়াতো কালা। সবাই মজা করতো কালা কে নিয়ে । একসময় আমি কলেজ থেকে চলে এলাম কালা রয়েই গেলো। বছরের পর বছর কেটে গেছে এখনো কালা কলেজে আছে। কলেজে অস্থায়ী ভিত্তিতে কালার চাকরী হয়েছে। কালা এখন কলেজের গার্ড। ১৫০০০ টাকা বেতন পায়। এখন কালা খুব দূর্বল। কষ্ট করে হাটে। আজ সারাদিন আমি কালা সম্বন্ধে আরও যা জানতে পেরেছি –

কালা দুটি বিয়ে করেছে প্রথম স্ত্রী কালা কে ছেড়ে চলে গিয়েছে তারপর কালা আরেকটি বিয়ে করে।

কালার শ্বশুরবাড়ির জায়গার নাম কল্পা। কলেজ থেকে পশ্চিম দিকে।

কালার প্রথম ঘরের একটি কন্যা সন্তান আছে।

কালার কন্যা টি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী এখন।

মেয়েটি তার খালার কাছে বড় হচ্ছে।

কালা প্রতি মাসে তার বেতন থেকে মেয়েকে লালন পালনের জন্য ৭০০০ টাকা দিয়ে দেয়।

কালা এখন খুব কষ্টে আছে। জন্মের পর যে কষ্ট নিয়ে বড় হয়েছে তার নাম কালা।

কালার বাবার নাম মোহাম্মদ আলী।

মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন।

বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলা।

থাকে শ্বশুরবাড়ি কল্পা তে।

কালার চার ভাই ছিলো। কালা ছোটো কালে হাড়িয়ে গিয়েছিলো। অনেক দিন পর কালা এই কলেজ রোডে ফিরে এসেছিলো। বাবা মা না থাকায় বাড়িতে কালার আশ্রয় হয়নি। কালার অন্যান্য ভাই রা ব্যাংকে চাকরি করতো। জানা গেছে একজন অগ্রণী ব্যাংক এর ব্যবস্থাপক হয়েছিলেন।

কালার জীবন কাহিনী টা অনেকটাই বৃদ্ধাশ্রম এর মানুষ এর মতো। এই এলাকায় কালার একজন ভাতিজা আছে। কিন্তু এই ভাতিজা বা পরিবারের অন্য কেউ কালার কোনো খোঁজ খবর নেয় না। দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় কালা এখন দূর্বল, চলা ফেরা ঠিকমতো করতে পারে না। এই কালার চোখের সামনেই ফারুখ আহমেদ খান, সুলতান উদ্দীন, আমি মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, কাজী আজাদ জাহান শামীম, গোলাম ফেরদৌস জিলু, মাসুদ আহমেদ তান্না, সাজ্জাদ হোসেন শাহীন, মফিজুন্নুর খোকা, মোস্তাক আহমেদ রুহী, মাহবুব জাহান শাহীন, আমকসুর ভিপি জিএস হিসেবে বেড়িয়ে এসেছি। সনামধন্য এমদাদুল হক মিল্লাত, ওয়াহাব আকন্দ, নজরুল ইসলাম চুন্নু, এম. এ. কুদ্দুস, শওকত জাহান মুকুল সহ অনেক সনামধন্য ব্যক্তিরা কালার চোখে চোখে বড় হয়েছে।

হাজারো আমলা, হাজারো ডাক্তার,হাজারো ইঞ্জনিয়ার, হাজারো আইনজীবী, হাজারো শিক্ষক, হাজারো সেনা পুলিশ এবং ব্যবসায়ী এই কালার চোখের সামনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কালা জানে না সে কাদের সাথে ছিলো, কাদের সাথে চলতো! তারা এখন কে কোথায়!

এই কালা এখন অনেকটাই বৃদ্ধ হয়ে গেছে। একটা লাঠি হাতে ধীরে ধীরে কলেজে আসে। নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে ফিরে। কারও সাথে দেখা হলেই ভরসা করে হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউ তাকে ফেরায় না।

তাই আমার সকলের কাছে আবেদন আমাদের জীবনের একটি সাক্ষী কে আমরা যেনো একটু ভালো রাখার চেষ্টা করি। আমি অনুরোধ জানাবো কেউ দায়িত্ব গ্রহন করুন আমরা আপনার সাথে থাকবো কালা কে একটু ভালো রাখার চেষ্টা করবো।

এগিয়ে আসুন।
ধন্যবাদ।

মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল

সাবেক ভিপি, আনন্দমোহন কলেজ

সাধারণত সম্পাদক, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ