Logo

ভুলুয়া থেকে নোয়াখালী !

অনিন্দ্য বাংলা
বৃহস্পতিবার, মে ১১, ২০২৩
  • শেয়ার করুন

অনিন্দ্যবাংলা : নোয়াখালী অঞ্চলের ইতিহাস শুরু হয় শিলুয়া ও ভুলুয়া গ্রামে সভ্যতার ওজুদ নিয়ে। পুন্ড্র, হরিকেল এবং সমতটের বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজত্বের সময় ভুলুয়া একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এবং এর ফলে বৃহত্তর অঞ্চলের প্রাথমিক নাম ভুলুয়া হয়ে যায়। মধ্যযুগীয় ভুলুয়া রাজ্য মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে যাওয়ার আগে ত্রিপুরা রাজ্য এবং শাহী বাংলার অধীনে কিছু স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেছিল।
বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চল বর্তমান নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলা নিয়ে গঠিত। যদিও একসময় ভোলা, সন্দ্বীপ, ভারতের ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চল এবং দক্ষিণ কুমিল্লাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নোয়াখালীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ‘নোয়াখালির ইতিহাস’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম পরিচ্ছেদের শুরুতে উল্লেখ আছে, ‘নোয়াখালি জেলার প্রাচীন ইতিহাস ঘোর তমসাচ্ছন্ন। ইহার কোন লিখিত প্রাচীন ইতিবৃত্তমূলক পুস্তক না থাকায় ধারাবাহিক বিবরণ সঙ্কলন সহজসাধ্য নহে।’ তবে প্রাচীন যুগে এ অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধ নৃপতিদের রাজত্ব ছিল।
মধ্যযুগ হতে নোয়াখালী অঞ্চলের ইতিহাস বিস্তারিত জানা যায়। আগেই আমরা মিথিলাগত রাজকুমার বিশ্বম্ভর শূর ও বারাহী দেবীর কিংবদন্তি উল্লেখ করেছি। মুসলমান সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির বাংলা আক্রমণ ও বিশ্বম্ভর শূরের ভুলুয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা একই সময়ে সংঘটিত হয়েছে বলে ঐতিহাসিকদের দাবি। এ প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রমোহন বসু ‘ভুলুয়া রাজবংশ’ নামক প্রবন্ধে লেখেন, ‘বঙ্গোপসাগরের উত্তর পূর্ব প্রান্তস্থিত দ্বীপপুঞ্জের সমাহারে ভুলুয়া পরগনার সৃষ্টি হয়। … জনশ্রুতি আছে যে ভুলুয়ার শূর রাজবংশ জাতিতে ক্ষত্রিয় ছিলেন।’ বিশ্বম্ভর শূর ছিলেন এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তবে কালক্রমে বিশ্বম্ভরের উত্তরসূরিরা ত্রিপুরা রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। ত্রিপুরার সামন্ত শ্রেণীতে তারা ‘সর্বপ্রধান’ উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। ত্রিপুরার নৃপতিদের রাজ্যাভিষেককালে ভুলুয়ার রাজারা তাদের কপালে রাজটীকা দিতেন। বিশ্বম্ভর শূরের চার পুত্র—গণপতি, মনোহর, হেমন্ত ও দামোদর। বিশ্বম্ভর শূরের মৃত্যুর পর তার গণপতি ‘রায়’ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। গণপতি রায়েরই এক উত্তর পুরুষ রাজা লক্ষ্মণমাণিক্য রায় বাংলার বারোভূঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন।
মোঘল আমলে বাংলায় ‘ভুলুয়া’ নামে একটি রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। মেঘনার পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ রাজ্য, যার অধিকাংশ এলাকা বর্তমানের বৃহত্তর নোয়াখালীর (নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেণী) এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এর অন্তর্ভুক্ত। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে ওই রাজ্যের নাম লেখা আছে ‘বালাজোয়ার’।
বর্তমান নোয়াখালী (সুধারাম), প্রাচিন ভুলুয়া একসময় সমতট, চন্দ্রদ্বীপ ও হরিকেলের মাঝামাঝি বঙ্গাল জনপদ নামে অভিহিত হতো।
ভুলুয়া নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে অনেক তথ্য উপকরণ ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যেমন ‘ভুলনা’ দ্বীপ বা চর হতে ভুলুয়া নামকরণ হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে মেঘনা নদীর তীরবর্তী বঙ্গোপসাগরের মেঘনা উপকূলের একটি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রামের নাম থেকে ভুলুয়া নামের উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানের মেঘনার একটি শাখা নদীর নামও ভুলুয়া, যেটি বর্তমান লক্ষ্মীপুরে পড়েছে।
নোয়াখালীর প্রাচীন নাম ভুলুয়া। এ নামকরণের সঙ্গে একটি কিংবদন্তি জড়িত। কিংবদন্তি অনুসারে, এ রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন বিশ্বম্ভর শূর। তিনি মিথিলার রাজকুমার ছিলেন। তেরো শতকের গোড়ার দিকে তিনি চন্দ্রনাথ তীর্থে আসেন। তিনি জলপথে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে নাবিকরা দিকভ্রান্ত হন। তারা পথ ভুলে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি দ্বীপে পৌঁছান। রাতে বিশ্বম্ভর শূর বারাহী দেবীকে স্বপ্নে দেখেন। দেবী জানান, তিনি অদূরেই সমুদ্রের পানিতে ডুবে আছেন। সেখান থেকে তুলে যথাযথ স্থানে স্থাপন করে পূজা করতে বিশ্বম্ভরকে আদেশ দেন বারাহী দেবী। বিশ্বম্ভর সে আদেশ পালন করলে তার রাজ্যলাভ হবে বলে দেবী তাকে আশীর্বাদ করেন। বিশ্বম্ভর শূর দেবীকে সমুদ্রগর্ভ থেকে তুলে এনে পূজা করেন। তবে অতিরিক্ত কুয়াশা থাকায় দিগনির্ণয় করতে না পেরে দেবীকে পূর্বমুখী করে স্থাপন করা হয়। এটি রীতিবিরুদ্ধ। সাধারণত দক্ষিণ বা পশ্চিমমুখী করে দেব-দেবী প্রতিষ্ঠা করা নিয়ম। দেবীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ছাগল বলি দেন বিশ্বম্ভর। সেখানেও ভুল। পশ্চিমমুখী করে ছাগলটিকে বলি দেয়া হয়। রাতের আঁধারে এসব ভুল কারো নজরে আসে না। কিন্তু সূর্যোদয়ের পর ঘন কুয়াশার আবরণ সরে গেলে সবাই ভুল বুঝতে পারেন। তখন তারা ‘ভুল হুয়া’, ‘ভুল হুয়া’ বলে সমস্বরে চিৎকার করে ওঠেন। এ কিংবদন্তির উল্লেখ করে বসন্তকুমার সেনগুপ্ত তার ‘ভুলুয়া’ নামক প্রবন্ধে লেখেন, ‘এই “ভুল হুয়া” শব্দ হইতেই “ভুলুয়া” নামের উত্পত্তি। কালক্রমে বিশ্বম্ভর শূরের প্রতিষ্ঠিত নবীন রাজ্য “ভুলুয়া” নামে অভিহিত হয়। অদ্যাপি “ভুলুয়া” প্রদেশে বহু স্থানে পশ্চিমাস্য করিয়া ছাগবলি দিবার ব্যবস্থা আছে।’ সুরেন্দ্রমোহন বসুর ‘ভুলুয়া রাজবংশ’ নামক প্রবন্ধেও এ কিংবদন্তির উল্লেখ আছে।
সেন বংশের রাজাদের মধ্য হেমন্ত সেনের পুত্র বিজয় সেন ছিলেন সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বিজয়সেন (মৃত্যু ১১৫৯ খৃঃ) তিনি সমগ্র বাংলার অধিপতি ছিলেন। বিজয় সেনের পুত্র বল্লাল সেন মিথিলা রাজ্য জয় করে তার রাজ্যেকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করেন। যথা-রাঢ় (পশ্চিমবঙ্গ), বরেন্দ্র (উত্তরবঙ্গ), বাগড়ী (দক্ষিণবঙ্গ), বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ) এবং মিথিলা। মিথিলার রাজা ছিলেন বিশ্বম্ভর শূর। তিনি ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি মিথিলাধিপতি আদি শূরের নবম পুরুষ। খ্রীষ্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কুতুবউদ্দিনের সেনানী ইখতিয়ারউদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী (১২০৩-১২০৫ খৃঃ) বঙ্গের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হন, সেই সময় গৌড় নদীয়ার রাজাগণ তাঁদের রাজ্য ত্যাগ করে পূর্ব-দক্ষিণ বঙ্গে পলায়ন করেন। মিথিলা রাজ্যের বিতাড়িত রাজা বিশ্বম্ভর শুরকে এরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয়। বিশ্বম্ভর শুরের তিন-চার পুরুষ পরে সম্রাট আকবরের সময় ওই রাজ্যের রাজা হন লক্ষ্মণ মাণিক্য। তার রাজত্বকালে রাজ্যে চলছিল মগদস্যুদের উৎপাত। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মি. গ্রান্ট এ সম্পর্কে বলেন, ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে ভয়ানক জলপ্লাবন ও মগদের দৌরাত্ম্যে সাগর তীরবর্তী অঞ্চলটি প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। লক্ষ্মণ মাণিক্য মগদের প্রতিরোধে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছোট ভাই রামানুজ রাজ্যের লোভে আরাকানরাজের সহায়তায় আপন ভাই লক্ষ্মণ মাণিক্যকে উচ্ছেদ করেন। লক্ষ্মণ মাণিক্য তখন সাহায্যের আশায় ছুটে যান খিজিরপুরের ভূঁইয়া ঈশা খাঁর কাছে। ঈশা খাঁ লক্ষ্মণ মাণিক্যকে পৌঁছে দেন মোগল দরবারে। মোঘল বাদশাহর সহায়তায় লক্ষ্মণ মাণিক্যকে ফিরে পান নিজ রাজ্য। ১৬০১ খ্রিস্টাব্দে মগদের বিপক্ষে নৌ-যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে লড়তে গিয়ে মারা যান রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য। মগদের আক্রমণ থেকে ভুলুয়া রাজ্যের সীমান্তের হেফাজত জোরদার করার জন্য, ভুলুয়ার রাজা রাজবল্লভ এলাহাবাদ ও দাঁদরা পরগনার সামন্ত গভর্নর হিসেবে একজন মুসলিম সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এর ফলে এই অঞ্চলে মুসলিম অভিবাসীদের আগমন ঘটে। এই সময়ের মধ্যে, বগদাদ থেকে একজন সৈয়দ বংশীয় সুফী পীর একটি বাঘের উপরে চড়ে ভুলুয়ায় এসেছিলেন এবং এইভাবে স্থানীয় লোকদের কাছে শের আলম নামে পরিচিত হন। রাজবল্লভ সৈয়দ শের আলমকে দুই দ্রোণ জমি ও একটি বড় লাখেরাজ বাড়ি উপহার করেন দানাইকোটে। শের আলম কিছুক্ষণ দানাইকোটে অবস্থান করেন, কিন্তু বাদে রাজগঞ্জের কাছাকাছি দিলিলপুর/টাঙ্গিরপাড় বসবাসকারী মুসলমানদের সাথে বসবাস শুরু করেন যেখানে তাকে তাদের সরদার হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে, বাংলার সুবাহদার ইসলাম খাঁ ভুলুয়া দখলের জন্য একটি বাহিনী পাঠান, যেটি বিশ্বম্ভরশূর রাজবংশের অনন্ত মাণিক্য দ্বারা শাসিত হয়েছিল। এই অভিযানে মীর্জা নূরউদ্দীন, মীর্জা ইসফান্দিয়ার, হাজী শামসউদ্দীন বগদাদী, খাজা আসল, আদিল বেগ এবং মীর্জা বেগের বাহিনী ছাড়াও সুবাহদারের অশ্বারোহী বাহিনীর ৫০০ জন সদস্য ছিল। খাঁন আব্দুল ওয়াহিদকে পুরো অভিযানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করেন, যা মোট ৫০টি হাতি, ৩০০০ ম্যাচলকার এবং ৪০০০ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে গঠিত ছিল।
অনন্ত মাণিক্য ডাকাতিয়া তীরে এগিয়ে যাওয়ার আগে মগ রাজার সহায়তায় ভুলুয়ার চারপাশে প্রতিরক্ষা স্থাপন করেছিলেন যেখানে তিনি একটি কেল্লা তৈরি করেছিলেন। মোগলরা কয়েক দিনের মধ্যে কেল্লায় পৌঁছেছিল এবং একটি জঙ্গ শুরূ হয় যার ফলে উভয় পক্ষের অনেক লোক মারা যায়। ভুলুয়া বাহিনীও রাতে আকস্মিক আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। মানিক্যের মুখ্যমন্ত্রী মীর্জা ইঊসুফ বরলাস মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং আবদুল ওয়াহিদ তাঁকে ৫০০ সৈন্য ও ৩০০ ঘোড়ার মনসবদার হিসাবে পুরস্কার করেন। তবে বরলাসকে হারানোর পর, মাণিক্য আত্মসমর্পণ করেননি এবং মধ্যরাতে ভুলুয়ায় পশ্চাদপসরণ করেন কেল্লাকে মজবূৎ করার জন্য। পশ্চাদপসরণের খবর দুই পহর পরে মোগলদের কাছে পৌঁছায় এবং তাই তারা ভুলুয়া বাহিনীর অনুসরণ শুরু করে। মাণিক্য মগ রাজার কাছে পানা নিতে আরও পিছু হটে কিন্তু ফেনী নদীর তীরে পরাজিত হন। মোগলরা মানিক্যের সমস্ত হাতি দখল করে নেয় এবং আব্দুল ওয়াহিদ সফলভাবে ভুলুয়ার নিয়ন্ত্রণ নেন। কাসিম খাঁন চিশতীর সুবাহদারীর সম​য়, ভুলুয়ার আব্দুল ওয়াহিদ সুবাহদারের সাথে দেখা করতে জাহাঙ্গীরনগরের দিকে চলা শুরু করেন। সফর শুরূ করার আগে, আব্দুল ওয়াহিদ তাঁর ছেলেকে ত্রিপুরা হানা দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং ভুলুয়ায় দেখাশোনার জন্য একজন মুতসদ্দী রেখে যান।
আব্দুল ওয়াহিদের সফরের খবর পেয়ে, মগ রাজা এটিকে ভুলুয়া আক্রমণের সুযোগ হিসাবে দেখেছিলেন এবং তাই তিনি অশ্বারোহী, হাতি, কামান, পদাতিক বাহিনী এবং একটি নৌবহর নিয়ে গঠিত আরাকান থেকে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে ভুলুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। অভিযানের বিষয়ে ভুলুয়ার মুতসদ্দী জাহাঙ্গীরনগরকে সতর্ক করতে একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সুবাহদার কাসিম খাঁন চিশতী মনে করেছিলেন এটি সম্ভবত আবদুল ওয়াহিদের উপস্থিতি ত্যাগ করার জন্য একটি অজুহাত ছিল। বিক্রমপুর ও শ্রীপুরের থানাদারদের আরও সতর্কতার পর কাসিম খাঁন চিশতী সর্বশেষে আব্দুল ওয়াহিদকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। চিশতী নিজে খিজিরপুরের দিকে অগ্রসর হন যেখানে তিনি আদেশ দিলেন যে ভুলুয়া থেকে খিজিরপুর সংযোগ সব নদীগুলো পাতিলা এবং ভদিয়ার মত বৃহৎ পণ্যসম্ভার জাহাজের সঙ্গে অবরোধ করা হোক। তিনি সৈয়দ আবূ বকরকে আসাম অভিজান বাতিল করার বার্তা পাঠান, এবং মগদের দমন করার জন্য নৌবহরকে বাংলায় ফিরিয়ে আনার জন্য একটি বার্তাও পাঠান। চিশতী ভুলুয়া জঙ্গের তৈয়ারীতে মীর্জা মক্কী ও শেখ কামালের ফউজকে জাহাঙ্গীরনগরে নিয়ে আসার জন্য সজাবলদেরকে নিয়োগ করেন। এরপর চিশতী তার নিজের ৪০০০ ম্যাচলকার এবং ২০০০ ঘোড়সওয়ারের একটি ফউজ পাঠান, যেগুলিকে তার ছেলে, শেখ ফরীদ এবং জেনারেল আব্দুন্নবীর নেতৃত্বে লক্ষা নদী দিয়ে নিরাপদে ভুলুয়া অভিমুখে পাঠানো হয়েছিল।
১৬২০ সালের মধ্যে, মুসলমানরা ভুলুয়া গ্রামের কাছে একটি ফাঁড়ি স্থাপন করেছিল যাকে তারা ইসলামাবাদ ডাকতেন। ইতিহাসবিদরা এটিকে বর্তমান লক্ষ্মীপুরের সাথে চিহ্নিত করেছেন।[১০] বাংলার সুবাহদার ইব্রাহীম খাঁন ফতেহ-ই-জঙ্গের সাবেক বখশী মীর্জা বাকী ৪০০ ঘোড়াসহ ৫০০ সৈন্যের মনসবদারী দেওয়ার পাশাপাশি ভুলুয়ার থানাদার হিসাবে নিযুক্ত হন।
১৬৬০ এর দশকে ত্রিপুরা পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর বন্যার জলে উত্তর-পূর্ব ভুলুয়ার কৃষি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৬৬০ সালে ডাকাতিয়া থেকে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা নদী ও ফেনী নদীর সংযোগস্থলে পানির প্রবাহ প্রবাহিত করার জন্য একটি খাল খনন করা হয়। এই দীর্ঘ খালটি খননের পর একটি নতুন শহর গড়ে ওঠে যাকে স্থানীয়রা “নোয়াখালী” বলে ডাকতে শুরু করল, যদিও একালে ভুলুয়া নামটি প্রচলিত ছিল। ১৬৬১ সালে, ভুলুয়ায় ওলন্দাজ নাবিকরা জাহাজ ভেঙে পড়েছিল এবং ভুলুয়া শাসকদের দ্বারা তাদের যত্ন নেওয়া হয়েছিল।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ভুলুয়া একটি পরগনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, ও ফরহাদ খাঁন ১৬৬৫ থেকে ১৬৭০ ভুলুয়ার থানাদার হিসেবে জিম্মাদারী পালন করেন। ১৬৬৫ সালে নিকটবর্তী চাটগাঁর মোগল বিজয়ের সময়, ক্যাপ্টেন মুরের নেতৃত্বে ফিরিঙ্গীরা আরাকানী নৌবহরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ভুলুয়ায় পালিয়ে যায় যেখানে ফরহাদ খাঁন তাদের পানা দেন। ফরহাদ খাঁন পরে তাদের জাহাঙ্গীরনগরে বাংলার সুবাহদার শায়েস্তা খাঁনের কাছে পাঠিয়ে দেন।
শায়েস্তা খাঁনের সুবাহদারীর আমলে ভুলুয়াকে চাকলা-ই-জাহাঙ্গীরনগরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভুলুয়া গ্রামে ১৭তম শতকের মোগল দুর্গের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।রাজা কীর্তি নারায়ণ ১৭২৮ সালে ভুলুয়ার জমিদার হন।
মোগল সম্রাট মুহম্মদ শাহের শাসনামলে, ঈরান থেকে পীর মিঞা আম্বর শাহ, যিনি উমর শাহ নামেও পরিচিত, নৌকায় করে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার বন্দোবস্ত এবং প্রচারের সুবিধার্থে, সম্রাট মুহম্মদ শাহ একটি তাম্রশাসন তৈরি করেছিলেন যাতে তার জন্য বজরা একটি লাখেরাজ বন্দোবস্ত ছিল। বজরা শব্দটি বড়নৌকা শব্দ থেকে আসছে, এবং এটি উমর শাহের নৌকা থেকে নামকরণ করা হয়েছে।কথিত আছে যে পীর প্রথমে তাঁর নৌকাতেই বাস করতেন এবং নৌকা থেকেই স্থানীয়দের কাছে ইসলাম প্রচার করতেন। উমর শাহ ছনগাঁও থেকে স্থানীয় এক বিধবার দুই ছেলে আমানুল্লাহ ও ছানাউল্লাহকেও বড় করেন। উমর শাহের নির্দেশে আমানুল্লাহ বজরা শাহী মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছানাউল্লাহ মসজিদের সামনে ৩০ একর জলাধার খনন করেন। ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শুরু হয় এবং এটি ১৭৪১ সালে শেষ হয়। ইসলাম প্রচারের জন্য এই অঞ্চলে হিজরত করা আরেক ওলী হলেন পীর আহমদ খন্দকার যিনি বাবুপুরে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
১৭৫৬ সালের মধ্যে, বিলাতী পূর্ব ভারত কারবার জাগদিয়ায় ফেনী নদীর কাছে তাঁত কারখানা তৈরি করেছিল। ভুলুয়া ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে আসে এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকা বিভাগের একটি অংশ করা হয়। সন্দ্বীপ ও ফেনীকে চট্টগ্রামের কালেক্টরের অধীনে রাখা হয়।
বৃটিশ আমলে ভুলুয়া জেলা’র মর্যাদা পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক এ অঞ্চলে জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়। ১৭৭২ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশে প্রথম আধুনিক জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা নেন। তিনি সমগ্র বাংলাকে ১৯টি জেলায় বিভক্ত করে প্রতি জেলায় একজন করে কালেক্টর নিয়োগ করেন। ১৯টি জেলার একটি ছিল কলিন্দা। এ জেলাটি গঠিত হয়েছিল মূলতঃ নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে। কিন্ত ১৭৭৩ সালে জেলা প্রথা প্রত্যাহার করা হয় এবং প্রদেশ প্রথা প্রবর্তন করে জেলাগুলোকে করা হয় প্রদেশের অধীনস্থ অফিস। আঠারো শতকে ইংরেজদের লবণ বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ভুলুয়া বিশেষ পরিচিতি লাভ করে।
১৭৮৭ সালে পুনরায় জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং এবার সমগ্র বাংলাকে ১৪টি জেলায় ভাগ করা হয়। ১৪ জেলার একটি হলো ভুলুয়া জেলা । যার নিজস্ব কালেক্টর এবং সহকারী কালেক্টর ছিল। সেই বছরের শেষের দিকে, টেইনমাউথের জন শোর ভুলুয়াকে ময়মনসিংহের কালেক্টরের জিম্মাদারীতে থাকার নির্দেশ দেন। ১৭৯০ সালে টিপ্রা (কুমিল্লা) জেলা গঠিত হলে, নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ড ভুলুয়া পরগনা শাসন করে ড্যান্ড্রিজ সাহেবের সাথে সেই জেলায় যোগ দেয়। নোয়াখালীতে ড্যান্ড্রিজের কার্যালয় তিন বছর ধরে, যেখানে কারখানার মালিক এবং লবণের এজেন্টদের সাথে তার খারাপ সম্পর্ক ছিল। টিপ্রার কালেক্টরের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের আগে অবশেষে তিনি থম্পসন সাহেব দ্বারা প্রতিস্থাপিত হন।
উল্লেখ্য, জেলা প্রশাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন হয় ১৭৯০ সালে। এর পূর্বে কোম্পানীর শাসন বলতে আইনত ছিল শুধু বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্ব শাসন। আর সিভিল প্রশাসন ছিলো নবাবের হাতে। জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ সময় পর্যন্ত কোম্পানী কর্তৃক যে সকল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় তা শুধু রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূমি রাজস্ব থেকে কোম্পানীর আয় বৃদ্ধির জন্য। কিন্ত ১৭৯০ সালে কোম্পানীর গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ নবাবকে তাঁর নিজামত ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেন এবং রাজস্ব প্রশাসনের সাথে সমস্ত ফৌজদারী বিচার ও পুলিশী ক্ষমতা জেলা কালেক্টর এর উপর অর্পণ করেন। ফলে সমাপ্ত হয় বাংলার নবাবী এবং বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমগ্র বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচ্ছত্র শাসন। আর এ শাসন পরিচালনার সমুদয় ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করা হয় কালেক্টর পরিচালিত জেলা প্রশাসন ব্যবস্থায়।
১৭৯২ সালে ত্রিপুরা নামে একটি নতুন জেলা সৃষ্টি করে ভুলুয়াকে এর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু নানা রকম অসুবিধা এবং ভুলুয়ায় লবণ ব্যবসায়ীদের অবস্থানগত কারণে উদ্ভূত প্রশাসনিক সমস্যার জন্য ১৮২২ সালে তা ত্রিপুরা থেকে বিযুক্ত হয় এবং পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে নতুন করে ভুলুয়া জেলা গঠিত হয়।
১৮২০ সালে, কারখানার মালিকরা, লবণ এজেন্টরা এবং সংগ্রাহকদের মধ্যে ভুলুয়াতে প্রচলিত সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য ক্যালারি কমিটি একটি সভা করেছিল। প্লোডেন সাহেব, নোয়াখালীর সল্ট এজেন্ট, ভুলুয়াকে নিজস্ব জেলা করার ও তাকে ভুলুয়ার কালেক্টরের জিম্মাদারী দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। গভর্নর-জেনারেল ফ্রান্সিস রডন-হেস্টিংস ১৮২১ সালে এই সুপারিশ কবুল করেন। ২৯ মার্চ ১৮২২ সালে, হেস্টিংস এই বিষয়ে একটি আদেশ জারী করেন এবং তদনুসারে একটি নয়া জেলা গঠন করা হয় যার অধীনে ছিল: দক্ষিণ শাহবাজপুর, সুধারাম, বেগমগঞ্জ, রামগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, পরশুরাম, টিপ্রা জেলার এলাহাবাদ পরগনা এবং চাটগাঁ জেলার হাতিয়া, সন্দ্বীপ ও বামনী।
ভুলুয়া ১৮২৯ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে গঠিত হয়েছিল। পার্বত্য ত্রিপুরা থেকে কুকিদের একটি বড় দল ছাগলনাইয়া সমভূমিতে (তৎকালীন টিপরা/কুমিল্লায়) প্রবেশ করে যেখানে তারা ১৮৫ জন বিলাতী আশখাসকে কতল করে, তাদের মধ্যে ১০০ জনকে অপহরণ করে এবং এক বা দুই দিন সমতল ভূমিতে অবস্থান করে। বিলাতী সৈন্য ও পুলিশ সদস্যদের তাদের দমন করার জন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্তু কুকিরা ইতিমধ্যেই দেশীয় রাজ্যের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তারা আর কখনও ফিরে আসেনি।
বৃহত্তম পরগনা ভুলুয়ার আয়তন ছিল ৬৩৫.৮৫ বর্গ কিমি এবং সেখান থেকে রাজস্ব আদায় হতো মোট ১,২৩,৯২৯ টাকা। ১৭২৮ সালের সেটেলমেন্টে রাজা কীর্তিনারায়ণের নামে ভুলুয়া রেকর্ড করা হয়। ১৭৮৮ সালে রাজ্যের চার-আনা অংশ পাইকপাড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিং-এর নিকট বিক্রি করা হয়। ১৮৩৩ সালে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধের জন্য সমগ্র ভুলুয়া রাজ্য বিক্রয় করা হয়। দ্বারকানাথ ঠাকুর রাজ্যটি ক্রয় করেন। পরিশেষে তিনিও তিন লক্ষ টাকা মূল্যে পাইকপাড়া পরিবারের রানী কাত্যায়নীর নিকট তা বিক্রি করে দেন। ১৮৪৫ সালের দিকে পৃথক রাজ্য হিসেবে ভুলুয়ার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।
১৮৬৮ সালে ভুলুয়া জেলার নাম বদল করে নোয়াখালী রাখা হয়। পরের বছর দক্ষিণ শাহবাজপুর বাকেরগঞ্জ জেলায় দেওয়া হয়। ‘নোয়াখালির ইতিহাস’ থেকে জেলাটির নামকরণের একটি ইতিহাস জানা যায়। বইটি থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, নোয়াখালী শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের নামানুসারে জেলাটির নামকরণ হয়েছে। খালটির নাম নতুন খাল। কিন্তু নোয়াখালী অঞ্চলের স্থানীয় উচ্চারণে নতুনকে ‘নোয়া’ বলা হয়। সে কারণে নতুন খাল হয়ে যায় নোয়াখাল। আর সেখান থেকেই নোয়াখালী। অবশ্য এমন নামকরণে ফার্সি ভাষার প্রভাব থাকাও বিচিত্র নয়। ফার্সি ভাষায় নতুন খালকে বলা হয় ‘নওখাল’। সেখান থেকেও ‘নোয়াখালি’ নামের উদ্ভব ঘটার দাবি করেছেন অনেক ঐতিহাসিক। নোয়াখালীর নামকরণ প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন’-এ উল্লেখ আছে, ‘ইতিহাসবিদদের মতে, একবার ত্রিপুরার পাহাড় থেকে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর পানিতে ভুলুয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহভাবে প্লাবিত হয় ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে ১৬৬০ সালে একটি বিশাল খাল খনন করা হয়, যা পানির প্রবাহকে ডাকাতিয়া নদী হতে রামগঞ্জ, সোনাইমুড়ি ও চৌমুহনী হয়ে মেঘনা ও ফেনী নদীর দিকে প্রবাহিত করে। এ বিশাল নতুন খালকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় নোয়া (নতুন) খাল বলা হতো, ফলে অঞ্চলটি একসময়ে লোকের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয়ে নোয়াখালী হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে।’
১৮৭৫ সালের ৩১ মে তারিখে টিপরা (কুমিল্লা) ও নোয়াখালীর মধ্যে সীমানা সমন্বয় করা হয় যাতে নোয়াখালী ৪৩টি গ্রাম লাভ করে এবং ২২টি গ্রাম হারায়। ১৮৭৬ সালে, নোয়াখালী জেলাকে দুটি মহকুমায় বিভক্ত করা হয়; সদর ও ফেনী। ফেনী মহকুমা নিয়ে গঠিত হয়েছিল: ছাগলনাইয়া থানা (পূর্বে টিপরা/কুমিল্লা), মীরসরাই থানা (পূর্বে চাটগাঁও), ফেনী পরগনা, পরশুরাম এবং সোনাগাজী। ১৮৭৮ সালে, মীরসরাই চাটগাঁও জেলায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৮১ সালে ফেনী নদীকে নোয়াখালী ও চাটগাঁও জেলার মধ্যে বিভাজক রেখায় পরিণত করা হয়, যার ফলে নোয়াখালী চারটি গ্রাম লাভ করে।
১৮৯৩ সালে, একটি ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলের ফসলের পাশাপাশি এই অঞ্চলের সুপারি খেজুরের অর্ধেককে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিপুল পরিমাণ গবাদি পশুও ডুবে যায় যদিও মানুষের ওফাত ঘটেনি। ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় যার ফলে সুপারি খেজুর ব্লাইটে আক্রান্ত হয়। এর ফলে হাজার হাজার নোয়াখাইল্লার ওফাত হয়। ১৮৯৬ সালে অস্বাভাবিকভাবে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছিল যা এই অঞ্চলে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল এবং ফসলের ক্ষতি করেছিল। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাই হোক না কেন, এই অঞ্চলের বার্ষিক পয়দাহার বার্ষিক ওফাতের হারের চেয়ে অনেক বেশি ছিল; ১৮৮১ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত জনসংখ্যা ২৩% বৃদ্ধির সাথে। এই অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চল, রামগঞ্জ উপজেলার মতো স্থানগুলি, ঘূর্ণিঝড়ের তেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি যদিও মেঘনা নদীর মাধ্যমে দুর্যোগ ছড়িয়েছিল।
১৯০১ সালের আদমশুমারীতে, জেলার আয়তন ছিল ১,৬৪৪ মা২ (৪,২৬০ কিমি২) এবং এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় 1,141,728 জন। বামনী নদী কোম্পানীগঞ্জের একটি বড় অংশকে ডুবিয়ে দেয়, যার ফলে জালিয়া কৈবার্তা সম্প্রদায় সন্দ্বীপে চলে যায়। সুধারামের দক্ষিণ অংশও ভূমি ক্ষতির শিকার হয় এবং ছাগলনাইয়াবাসীর বেশ কিছু সংখ্যক বাসিন্দা তাদের বিলাতী দখলের দেশ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে, পরবর্তীতে ত্রিপুরা চলে যায়। জেলার সীমানার মধ্যে বেশ কিছু চর আবির্ভূত হয়েছে, যা অভিবাসনের কারণও হয়েছে। এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি মুসলমান ছিল সুধারামে, সম্ভবত এটি নোয়াখালী অঞ্চলের ঐতিহাসিক মোগল কেল্লা হওয়ার কারণে। ছাগলনাইয়াতে সর্বাধিক হিন্দু ছিল, সম্ভবত এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে ছিল এবং সম্প্রতি বিলাতী জেলায় যোগ দিয়েছে।
নোয়াখালীর সদর দপ্তর সুধারাম/নোয়াখালী শহরটি ১৯৫১ সালে মেঘনা নদীর ভাঙনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর বাদে মাইজদীতে নোয়াখালী জেলার একটি নয়া সদর দপ্তর কায়েম করা হয়। ১৯৬৪ সালে সদর মহকুমা সদর ও লক্ষ্মীপুর নামে দুটি মহকুমায় বিভক্ত হয়।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের আজাদী জঙ্গের সময় , পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলাকে ধরে রাখার জন্য নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ৩৯তম অ্যাডহক ডিভিশন তৈরি করে, সেই এলাকায় মোতায়েন করা ১৪তম ডিভিশন ইউনিট থেকে, এবং ১৪তম ডিভিশনকে হেফাজত করার জিম্মাদারী দেওয়া হয়েছিল স্রেফ সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়।
১৯৭১ সালের ১৫ জুন সোনাপুর আহমদিয়া বিদ্যালয়ের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে নোয়াখালীতে মোতাবেক ৭৫ জন বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর নোয়াখালী আজাদ হয়।
১৯৮৪ সালে, নোয়াখালী জেলাকে প্রশাসনিক ফায়দার জন্য আরও তিনটি জেলায় বিভক্ত করা হয়; নোয়াখালী জেলা, লক্ষ্মীপুর ও ফেনী। দেশভাগের ফলে ফেনী নদীর পানি উত্তোলন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২০২১ সালে, তিনও জেলা চাটগাঁও বিভাগ ছেড়ে মেঘনা বিভাগের অধীনে আসে।
ভুলুয়া একটি নদীর নাম। এটি মেঘনা নদীর শাখা নদী। নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৭১ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৮৫ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক ভুলুয়া নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী নং ১৫।
আর ভেলুয়া ? চট্টগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পালাগান হচ্ছে ‘ভেলুয়া সুন্দরী’ – র পালা। আমির সওদাগর ও ভেলুয়ার কাহিনী নিয়ে গড়ে ওঠা এই পালা একসময় চট্টগ্রামে বেশ জনপ্রিয় ছিলো। এই পালাটি একসময় চট্টগ্রামের বিবাহ অনুষ্ঠানেগুলোতে প্রায় গাওয়া হতো। এই পালাগানের অনেকগুলো মুদ্রিত সংস্করণ রয়েছে।
পূর্ববঙ্গের গীতিকার আশুতোষ চৌধুরী এই পালাগানটি চট্টগ্রামের কয়েকজন পালা শিল্পীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রাউজানের বাগোয়ান গ্রামের জেবল হোেেসন, লাম্বুরহাটের ইসমাইল এবং রাঙ্গুনিয়া থানার পোমড়া গ্রামের ওমর বৈদ্য। বিশেষত ওমর বৈদ্যের নিকট থেকেই তিনি ভেলুয়ার পালাটি সংগ্রহ করেছিলেন। এই পালাগানটি আমির সওদাগর এবং ভেলুয়াকে নিয়ে রচিত হলেও এর পেছনে ছিলো বিশেষ প্রেক্ষাপট। এই পালার ঘটনাসমূহে চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার নাম উল্লেখ রয়েছে, যে জায়গাগুলো বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয়। পালায় উল্লেখিত শাফলাপুর বর্তমানে মহেশখালির অন্তর্ভুক্ত শাফলাপুর নামেই আছে। মহেশখালির শাফলাপুর আর ভেলুয়ার পালার শাফলাপুর এক এবং অভিন্ন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মধ্য যুগের পর চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিলো এসময় পর্তুগীজরা ব্যবসায়িক কারণে শাফলাপুরে একটি বন্দর স্থাপন করেছিল। এই শাফলাপুর বন্দরটি তৎকালীন সময়ে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। পালায় উল্লেখিত ভেলুয়ার পিত্রালয় তৈলন্যাপুর হচ্ছে বর্তমান আনোয়ারা থানার শঙ্খনদীর তীরস্থ তৈলারদ্বীপ। এই পালার ভিলেন ভোলা সওদাগরের বাড়ি ছিল কাট্টলি গ্রামে।
পাহাড়তলি স্টেশনের নিকটেই ভেলুয়ার দীঘি বর্তমানেও রয়েছে। বর্তমান চট্টগ্রাম শহরের খুলসীর পশ্চিমেই কাট্টলির অবস্থান। ভেলুয়া পালাগানের সারেঙ্গ বাদক টোনাবারুই – এর বাড়ি বর্তমান রাঙ্গুনিয়া থানার সৈয়দ নগর। সেখানে টোনা বারুই- এর ভিটা এখনও বর্তমান আছে। চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার সরাইপাড়া নামক স্থানে পালায় বর্ণিত মুনাপ কাজির কাছারি ঘর ছিলো। সরাইপাড়ার পার্শ্ববর্তী এলাকা এখনও কাজীপাড়া নামে খ্যাত এখানে মুনাপ কাজির নামে দীঘিও আছে। কুড়াল্যামুড়া নামক পাহাড়টি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। তৎকালীন সময়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ছিলো এই কুড়াল্যামুড়া পাহাড়। কুড়াল্যামুড়ার পাহাড়ের উত্তর পূর্বে কর্ণফুলির নদীর পানির ভয়াবহ ঘূর্ণিপাক ছিলো যা কাউখালি ঘূর্ণিপাক নামে বেশ পরিচিত ছিলো। ভেলুয়ার পালার আমির সওদাগর এই কাউখালি ঘূর্ণিপাকেই ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলে একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। ভেলুয়ার পালায় বর্ণিত শ্রীমাই, শঙ্খ, বাইচা ইত্যাদি নদী চট্টগ্রামে বেশ পরিচিত।
তথ্যসূত্র :
“View of Noakhali (Bengal)”। দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরি।
ওয়েবস্টার, জন এডওয়ার্ড (১৯১১)। Eastern Bengal and Assam District Gazetteers [পূর্ব বাংলা ও আসাম জেলা গেজেটিয়ার্স]। দ্য পাইওনিয়ার প্রেস।
Bangladesh District Gazetteers। বাংলাদেশ সরকার। ১৯৭৭।
Mitra, Naliniranjan (১৯৬৫)। “ইলাহাবাদ ও দাঁদরা পরগণা”। নোয়াখালির ইতিকথা।
Sen, Pyarimohan। নোয়াখালীর ইতিহাস। পৃষ্ঠা 18 and 52।
মাওলানা নুর মুহাম্মদ আজমি। “২.২ বঙ্গে এলমে হাদীছ”। হাদীছের তত্ত্ব ও ইতিহাস। এমদাদিয়া গ্রন্থাগার। পৃষ্ঠা ২৪।
ইসলামী বিশ্বকোষ। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ১৯৮৬। পৃষ্ঠা ২৩৮।
Jarrett, Henry Sullivan। The Ain I Akbari of Abul Fazl ‘Allami (Vol 2)। Bibliotheca Indica। পৃষ্ঠা 128।
Hasan, Perween (২০০৭)। Sultans and Mosques: The Early Muslim Architecture of Bangladesh। I.B. Tauris। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 978-1-84511-381-0।
M. I. Borah (১৯৩৬)। Baharistan-I-Ghaybi – Volume II।
Population Census of Noakhali। Bangladesh Bureau of Statistics, Statistics Division, Ministry of Planning। ১৯৭৪। পৃষ্ঠা 12।
“3. The Feringhees of Chittagong”। The Calcutta Review। University of Calcutta। ১৮৭১। পৃষ্ঠা 74।
M Noorul Haq (১৯৭৭)। বৃহত্তর চট্টলা। পৃষ্ঠা 66।
Ghulam Husain Salim (১৯০২–১৯০৪)। Riyazu-s-salatin; a history of Bengal. Translated from the original Persian by Maulavi Abdus Salam। Calcutta Asiatic Society। পৃষ্ঠা 230–231।
Thompson, W. H. (১৯১৯)। “24”। Final Report on the Survey and Settlement Operations in the District of Noakhali, 1914–1919। Bengal Secretariat Book Depot। পৃষ্ঠা 60–61।
Eaton, Richard M (১৯৯৩)। “Bengal under the Mughals: Islam and the Agrarian Order in the East: Charismatic Pioneers on the Agrarian Frontier”। The rise of Islam and the Bengal frontier, 1204-1760। University of California Press। পৃষ্ঠা 211।
Muhammad Badrur Huda, additional subdivisional officer, Revenue, Noakhali District Collectorate, 17 June 1982
Hasan, Dr Syed Mahmudul (১৯৭১)। Muslim Monuments of Bangladesh। পৃষ্ঠা 101।
“উপজেলার পটভূমি”। সেনবাগ উপজেলা। ১ নভেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২১।
Rāẏa, Suprakāśa (১৯৯৯)। Peasant Revolts And Democratic Struggles In India। ICBS (Delhi)। পৃষ্ঠা 24। আইএসবিএন 978-81-85971-61-2। সংগ্রহের তারিখ ২৯ অক্টোবর ২০১৫।
Sharma, Suresh Kant; Sharma, Usha (২০০৫)। Discovery of North-East India: Geography, History, Culture, Religion, Politics, Sociology, Science, Education and Economy. Tripura. Volume eleven। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 24। আইএসবিএন 978-81-8324-045-1। সংগ্রহের তারিখ ২৯ অক্টোবর ২০১৫।
Salik, Siddiq, Witness to Surrender, pp126
ইটন, রিচার্ড দ্য রাইজ় অফ ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার, ১২০৪-১৭৬০ (ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যাল​য় ছাপাখানা, ১৯৯৩)
সম্পাদনায় : মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু