Logo

প্রত্যাবর্তন : মিজানুর রহমান টিটু

অনিন্দ্য বাংলা
সোমবার, অক্টোবর ১২, ২০২০
  • শেয়ার করুন

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।”
গানটি গাইতে গাইতে সুজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে, কান্নার কারণ জানতে চাইলে জোড়েসোড়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। আমরাতো রীতিমতো অবাক এ বয়সে এসেও একজন শিক্ষিত মানুষ এভাবে আবেগ তাড়িত হতে পারে!! সুজন অনবরত বলতে থাকে তার বেঁচে যাওয়ার গল্গ! সে বলে যায়..
মাত্র তিন বছর বয়সেই আমি দেখি আমার বাবাকে প্রতিপক্ষের হাতে নৃশংস খুন হতে। জমি সংক্রান্ত বিরোধে আমার বাবা খুন হন। আমার মা আমাকে নিয়ে মামাবাড়িতে আশ্রয় নিয়ে কোন রকম বেঁচে থাকেন। অনেক হেলায়ফেলায় বেড়ে উঠি আমি। মানুষের মাঝে হাজারও অমানুষ আমাদের গিলে খেতে চায়। আমার মা আমাকে ঘিরেই গড়ে তুলেন আপন ভূবন। চরম প্রতিকূলতার মাঝেও পড়াশুনা চালিয়ে যাই। মাস্টার্স পাশের পর মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে চাকুরি নেই বেসরকারি একটি ফার্মে, মায়ের ইচ্ছায় এক মামাতো বোনকে বিয়ে করে সংসার সাজাই। আমাদের ছোট সংসার আলোকিত করে জন্ম নেয় সূচি। এরই মাঝে আমার চাকুরি চলে যায় মানে ফার্মটি বন্ধ হয়ে যায়। দারিদ্র্যের কষাঘাত সইতে পারছিলামনা কোন ভাবেই। চারিদিকে প্রতিকূল পরিবেশ। নানান কারণে সমগ্র পৃথিবীটা আমার কাছে কেবলই অপরিচিত লাগে। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাতে পারি না, শিশু কন্যার দুধ কিনতে পারি না, নিজেও কিছু একটা করবো তাও পারিনা!! অনেক অসুস্থ আমি। কারো কাছে হাত পাতাও আমার স্বভাবে নেই। মনে মনে স্থির করলাম নশ্বর পৃথিবীতে আর বাঁচার অধিকার আমার নেই, আত্মহত্যা করবো। কিন্তু স্ত্রী সন্তানের কি হবে? যে মা আমার মুখের দিকে চেয়ে জীবনের সব কিছু ত্যাগ করেছেন! তারই বা কি হবে? ওদের কোথায় রেখে যাবো আমি??
অনেক ভেবেচিন্তে একটি পথ আবিষ্কার করলাম। মা মামাবাড়িতেই কোন ভাবে বাঁকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন। স্ত্রী সন্তান নিয়ে আমি একসাথে আত্মহত্যা করবো। সিদ্ধান্ত পাকা। পৃথিবীর কেউ ফেরাতে পারবে না আমাকে। সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার যাবো স্বপরিবার। সেখান থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথে ছবি তোলার ভান করে স্ত্রী সন্তানকে সমুদ্রে ফেলে দেবো, তারপর আমি ঝাঁপিয়ে পড়বো সমুদ্রে। পরিকল্পনা মতো সেন্টমার্টিনে উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম । মার কাছ থেকে বিনয়ের সাথে বিদায় নিলাম,আত্মীয়- স্বজন , বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মা শুধু বলে ছিলেন টাকা পয়সা নেই এসময়ে বেড়াতে যাবি!! মা আমার চোখে হয়তো অন্য কিছু দেখে ছিলেন।। যাকগে যথারীতি চলেগেলাম কক্সবাজার পরদিন যাবো সেন্টমার্টিন। দেখি চারদিকে মানুষজন আনন্দ করছে হইচই করছে আর আমার ভেতরটা শুধুই শুকিয়ে যাচ্ছে। এতো অভাবের মাঝে স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি বেড়াতে সেও খুশিতে আত্মহারা,কিন্তু আমার নির্লিপ্ত চেহারা অপরিচিত বাচন ভঙ্গী তাকে চিন্তিত করে ফেলেছে। সে আমার কাছে জানতে চায় এই চমৎকার পরিবেশে আমার মন খারাপ কেন ?? জবাব না পেয়ে আরো চিন্তিত হয়ে ওঠে। কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট। কাল সেন্টমার্টিন যাবো!! কাল সকাল পর্যন্তই আমাদের পরম আয়ু। রাতে একেবারেই ঘুম হয়নি। প্রিয়তমা স্ত্রী পাশেই শুয়ে আছে, আমার সন্তান তার বুকে!!
অবুঝ শিশুটি অপলক তাকিয়ে ছিলো সারাদিন আমার দিকে! বাবার শরীরে শরীর ঘষে স্নিগ্ধ স্নেহের পরশে আপলুত হয়েছে রাত অবধি। আমার শরীরের গন্ধ নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটি আমার। রাত পোহালেই তাদেরকে আমি সমুদ্রে ফেলে হত্যা করবো। আমি নর পিশাচ করবো আত্মহত্যা। ভাবতে ভাবতে ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। সমুদ্রের সবটুকু পানি পান করেও এ তৃষ্ণা নিবারণ সম্ভব নয়। ভোর হয়ে গেছে। স্ত্রী সন্তানের ঘুম ভেঙেছে। পাখির কলকাকলিতে ভোরবেলাটুকু আরো বেদনাময় হয়ে উঠেছে। ওদেরকে রেডি করে চান্দের গাড়ি করে জাহাজ ঘাটে পৌঁছি। এদিকে হোটেলে সিট ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আর ফেরা হবে না আমাদের। খোদাহাফেজ কক্সবাজার, খোদাহাফেজ পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য। আমরা জাহাজের ভেতরে সিটে বসি। জাহাজ ছাড়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে শতশত গাঙচিল আমাদের বিদায় দিতে সঙ্গে রওনা করে। ভোরের নরম আলো হালকা কুয়াশা স্নাত মৃদু হাওয়া নদীর ঢেউ আর গাঙচিলের উড়াউড়ি আমাকে বিমোহিত করে। ভাবি আমার জীবনের শেষবেলাটুকুও সুন্দর। জাহাজের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে মৃত্যুর প্রস্তুতি, বাড়ে ভেতরের রক্তক্ষরণ, বাড়ে যন্ত্রণার ঝড়। আর মাত্র ক’টা মিনিট পর সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যাবো আমরা। আমার স্ত্রী সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে চির বিদায়ের সুরে বলি চলো জাহাজের সামনে যাই সমুদ্রের রূপ-রস সৌন্দর্য দেখি। তারাও উৎফুল্ল চিত্তে রাজি হয়। জীবনের প্রথম সমুদ্রটা দেখা হবে তাদের। আমিতো জানি এ দেখাই শেষ দেখা । আমরা তিনজনই চির নিদ্রায় যাবো সলিল সমাধিতে।
আমার সু-জুতার ফিতা গুলো শক্ত করে বেঁধে নিয়েছি যাতে পানিতে দ্রুত তলিয়ে যেতে পারি। জাহাজ এখন সমুদ্রের গভীরে প্রায় আমরা মৃত্যুর দিকে পা বাড়াচ্ছি। পূর্ব পরিকল্পনা মতে ছবি তোলার ভান করে ওদের সমুদ্রে ফেলে আমিও ঝাঁপ দেবো। আমরা জাহাজের সামনে আসতেই দেখি গত বছরের ক্লোজআপ ওয়ান স্টার এক গায়িকা তার দলবল নিয়ে গান গাইছে। খুব মজা করছে ওরা। আমার পরিকল্পনা মতো স্ত্রীকে বললাম রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াও তোমাদের ছবি তুলি!!! ভেতরে জাহান্নামের আগুন, প্রচণ্ড দাবানল। পুড়ে যাচ্ছে জীবনের সবটুকু আয়ুর পৃথিবী। এরই মাঝে এই ক্লোজআপ স্টার এসে আমার স্ত্রীর হাত থেকে আমার সন্তানকে নিয়ে যায়। ওর কোলে বসিয়ে গান গাইতে থাকে, আমার অবুঝ কন্যা সূচিও ওদের সাথে তাল মিলায়। এদিকে আমার অস্থিরতা সমুদ্রের উন্মাদ ঢেউয়ের মতো বাড়ে। খুব রাগ হয় স্টারের প্রতি। আমার সূচির মৃত্যুর সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এদিকে সে কিনা গান নিয়ে ব্যস্ত !!! ঔ হারামজাদী স্টার আমার মেয়েটাকে দেড় ঘন্টা আটকে রেখে সেন্টমার্টিন জাহাজ ঘাটে এসে ছেড়েছে। আমাদের মৃত্যুর সময় পিছিয়ে যাওয়ায় আমি ভাবতে শুরু করলাম আমি পৃথিবীর উচ্ছ্বিষ্ট হলেও আমার প্রজন্ম, হৃদয়ের ধনকে মানুষ ভালোবাসে ওর হাসি মানুষ ভালোবাসে। তার প্রতি ভালোবাসাকে ঘিরেই তো আমরা বাঁচতে পারি!! যেমনটি বেঁচেছিলেন আমার মা দীর্ঘ বছর আগে আমাকে অবলম্বন করে।
আমার সূচি এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশুনায় অনেক ভালো। নামকরা ছাত্রী। ওর মায়ের কথা আর কি বলবো আমার খামার, ব্যবসাপাতি দেখেদেখেই তার সময় যায়!!! আর আমি ?? আজ না হয় থাক… অন্য আর একদিন বলবো…
সুজন আর কিছু বলতে চায়নি আজ
তার কথা আগামীতে শুনার অপেক্ষায় রইলাম আমরা…।
মিজানুর রহমান টিটু
কবি, গল্পকার ও সংস্কৃতি কর্মী