Logo

বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ-জয়িতা শিল্পী

অনিন্দ্য বাংলা
সোমবার, আগস্ট ২৩, ২০২১
  • শেয়ার করুন

‘শেখ মুজিব’, ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের সঙ্গে পরিচয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা শুরু করবার পর । ১৫ আগস্ট-এর শোকাবহ ইতিহাস জানা হয়নি তখন। নিজে যখন বঙ্গবন্ধুকে চিনতে পেরেছি তখন ধানমন্ডি ৩২ এ গিয়ে অঝোরে কেঁদেছি। সে অনেক পরের কথা।

১৯৭৫ পরবর্তী প্রজন্ম দেখেছে সামরিক শাসনের দীর্ঘকাল। বাংলাদেশ টেলিভিশন-সংবাদপত্র তথা সকল গনমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিষিদ্ধ। ফলে তাঁর ভাষণ শোনা, জীবনী এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। পাঠ্য বইয়ে শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের দুটি চরণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সম্পর্কে জেনেছি। এই দু’টি বাক্যের যে তাৎপর্য ও গভীরতা সেটা বোঝার বয়স তখন হয়নি। কোনো শিশুর মস্তিষ্ককে এ বিষয়গুলো নিয়ে খেলবার কোনো উপাদান শিক্ষকগণ শ্রেণিকক্ষে দিয়েছেন এমনটি মনে পড়ে না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর উপায়ও ছিলনা। চাকরি হারানোর ভয়ে কেউ হয়তো সেটা করতেন না। বঙ্গবন্ধু নামের প্রচণ্ড আবেগ বুকে চাপা দিতে হয়েছে অনেকগুলো বছর।

বাবা-মায়ের মুখে শুনেছি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সকালে স্তব্ধ বাংলাদেশের কথা। সে এক বিভৎস নারকীয়তা আর বর্বরতার জঘন্য ইতিহাস! তখন থেকে বঙ্গবন্ধুকে জানার আগ্রহ আরো প্রবল হয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কোনো বই পেলে পড়েছি। শিশু মনে প্রশ্ন জাগত ‘বঙ্গবন্ধু এত সাহস কোথা থেকে পেলেন? বঙ্গবন্ধু এত আকর্ষণীয়ভাবে বক্তৃতা কিভাবে করতেন? বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুনতে এত মানুষ কেন যেত?’ কি ছিল তাঁর কথায়! জেনেছি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠবার গল্প। শিহরণ জেগেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে। কী বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, কী আবেগঘন প্রক্ষেপণ, কী দৃঢ়তা চিত্তে, অপ্রতিরোধ্য শক্তি। ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণটি যেন পরম যত্নে সাজানো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা স্বাধীনতা যুদ্ধের। কতটা দেশপ্রেম আর কঠোরতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এদেশের মানুষের মুক্তি চাই’। গনমানুষের মুক্তি এবং অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু কখনো আপোষ করেননি।
বঙ্গবন্ধুর অনেক ঐতিহাসিক বক্তৃতার একটি হচ্ছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রদত্ত। এই বক্তৃতার  কথা জেনেছি আরও অনেক পরে। ২৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেযখন সারদায় মৌলিক প্রশিক্ষণ নিতে যাই। সারদা পুলিশ একাডেমির মিউজিয়াম থেকে জেনেছি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স্ থেকে কীভাবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেরকালরাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে কীভাবে নয় মাসের সসস্ত্র যুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর এসেছে স্বাধীনতা।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত প্রথম পুলিশ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাংলাদেশ পুলিশের একটি গৌরবের ইতিহাস ও দেশ গড়ার দিক নির্দেশনা। তিনি যেভাবে পুলিশ বাহিনীকে গড়তে চেয়েছিলেন তা তাঁর সেদিনের বক্তব্যের মাধ্যমে তুলে ধরেন :-
“আমার পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ও সমবেত অতিথিবৃন্দ,
আজ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। যতদিন বাংলার স্বাধীনতা থাকবে, যতদিন বাংলার মানুষ থাকবে, ততদিন এই রাজারবাগের ইতিহাস লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। ২৫ মার্চ রাত্রে যখন ইয়াহিয়া খানের  সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে আক্রমণ করে, তখন তারা চারটি জায়গা বেছে নিয়ে তার ওপর আক্রমণ চালায়। সেই জায়গা চারটি হচ্ছে- রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমার বাড়ি। একই সময়ে তারা এই চার জায়গায় আক্রমণ চালায়। রাজারবাগের পুলিশেরা সেদিন সামান্য অস্ত্র নিয়ে বীর-বিক্রমে সেই সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করেন। কয়েক ঘন্টা তুমুল যুদ্ধ করেন। তারা এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের মানুষকে রক্ষা করতে। এর জন্য আজ আমি গর্বিত। আজ বাংলার জনগণ গর্বিত। সেদিন বাংলার জনগণের ডাকে, আমার হুকুমে এবং আমার আহ্বানে বাংলাদেশের জনগণের সাথে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী এগিয়ে এসেছিল মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে, বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষা করতে। স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে রাজারবাগের এবং পুলিশের ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। পুলিশ  বাহিনীর অনেক কর্মী এখানে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন নয়মাস পর্যন্ত। যাঁরা পুলিশ বাহিনীর বড় বড় কর্মচারী ছিলেন, তাদেরও অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

আজ তিনবছর হলো বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আজ প্রথম আমাদের পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। এখন একটা কথা আমাদের মনে রাখা দরকার। যে রক্ত দিয়ে আমরা স্বাধীনতা এনেছি, সেই রক্ত দিয়েই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, এই রাজারবাগে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের কথা মনে রাখতে হবে। তারা আপনাদেরেই ভাই। তারাও পুলিশে চাকরি করতেন। জনগণের সঙ্গে তারা হাত মিলিয়েছিলেন। ত্রিশ লক্ষ লোকের সঙ্গে পুলিশের অনেক লোকও আত্মত্যাগ করেছিলেন। তাঁদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। তাদের ইজ্জত আপনারা রক্ষা করবেন। তাদের সম্মান আপনারা রক্ষা করবেন। তাঁদের আত্মা যাতে শান্তি পায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর।

আজ আপনাদের কর্তব্য অনেক। যেকোনো সরকারের, যেকোনো দেশের সশস্ত্রবাহিনী গর্বের বিষয়। আমার মনে আছে যেদিন আমি জেল থেকে বের হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসি, সেদিন দেখেছিলাম- আমাদের পুলিশ বাহিনীর না আছে কাপড়, না আছে জামা, না কিছু। অনেককে আমি ডিউটি করতে দেখেছি লুঙ্গি পরে। একদিন রাত্রে তারা আমার বাড়ি গিয়েছিল। তাদের পরনে ছিল লুঙ্গি, গায়ে জামা, হাতে বন্দুক।
এই অবস্থায় এই দেশ শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানি জালেমরা বাংলাদেশের সম্পদ শুধু লুট করেই নেয়নি, যাবার বেলায় সব ধ্বংস করেও দিয়ে যায়। তারা ভেবেছিল, বাংলাদেশ টিকতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ টিকেছে। বাংলাদেশ থাকবে। বাংলাদেশ থাকার জন্যই এই দুনিয়ায় এসেছে। একে কেউ কোনোদিন ধ্বংস করতে পারবে না। আজ আমরা জাতিসংঘের সদস্য। আজ সারা দুনিয়ায় আমার বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। আজ দুনিয়ার মাঝে আমার বাংলাদেশের স্থান হয়েছে।

একটা কথা আপনাদের ভুললে চলবে না। আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশি শোষকদের পুলিশ নন, জনগণের পুলিশ। আপনাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা। আপনাদের বাহিনী এমন যে, এর লোক বাংলাদেশের গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। আপনাদের নিকট বাংলাদেশের মানুষ এখন একটি জিনিস চায়। তারা যেন শান্তিকে ঘুমাতে পারে। তারা আশা করে- চোর, বদমাইশ, গুণ্ডা, দুর্নীতিবাজ যেন তাদের উপর অত্যাচার করতে না পারে। আপনাদের কর্তব্য অনেক।

আমি জানি, আপনাদের নানা রকম অসুবিধা আছে। ৭০ থেকে ৮০টা থানা হানাদার বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। সেগুলো নতুন করে আমরা গড়তে চেষ্টা করছি। অনেকগুলো গড়া হয়েছে, অনেকগুলোর কাজ চলছে। আপনাদের কিছুই ছিল না। আজ আস্তে আস্তে কিছু কিছু হতে চলেছে। এক দিনে কিছুই হবে না।

বাংলাদেশের মানুষ দুঃখী, বাংলাদেশের মানুষ গরিব, বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে কষ্ট পায়। যুগ যুগ ধরে তারা শোষিত হয়েছে। আজ তাদের অবস্থা যে কেমন, আপনারা ভাড়াটিয়া নন। আপনারা বাংলা মায়ের ছেলে। আপনাদের বাপ-মা এই বাংলাদেশে রয়েছেন। তাঁদের অবস্থা আপনারা জানেন। গ্রামে গ্রামে আপনারা দেখেছেন, মানুষ হাহাকর করে, না খেয়ে কষ্ট পায়। বন্যা, সামদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ে কষ্ট আরও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসের দাম অত্যন্ত বেড়ে গেছে। ফলে, মানুষের খাবার যোগাড় করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আজ গবিবের ওপর ট্যাক্স ধরার ক্ষমতাও আমাদের বেশি নেই। তাঁরা টাকা কোত্থেকে দেবেন? তারা না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। এবার যে বন্যা হয়েছে, যে দুর্ভিক্ষ হয়েছে, তা আপনারা দেখেছেন।

আমি আপনাদের কাছে এই আশা করব যে, আপনারা হবেন আমার গর্বের বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ যেন আপনাদের জন্য গর্ব অনুভব করতে পারে। আপনারা যদি ইচ্ছা করেন, আপনারা যদি সৎ পথে থেকে ভালোভাবে কাজ করেন, যদি দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকেন, তাহলে দুর্নীতি দমন করতে পারবেন। আপনারা যদি আজকে ভালোভাবে  থাকেন, শৃঙ্খলা বজায় রাখেন, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, যে থানায় ভালো অফিসার আছেন এবং ভালোভাবে কাজ করছেন, সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোরো প্রকার সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ, তারা সব সময় সজাগ থাকেন এবং দুুষ্টকে দমন করেন। যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না। মনে রাখবেন, আপনাদের মানুষ যেন ভয় না করে। আপনাদের যেন মানুষ ভালোবাসে। আপনারা জানেন, অন্যদেশে পুলিশকে মানুষ শ্রদ্ধা করে। আপনারাও শ্রদ্ধা অর্জন করতে শিখুন।

আপনাদের বনে-বাদাড়ে নদীতে লোকালয়ে- সর্বত্র যখন যেখানে প্রয়োজন পড়ে, ডিউটি করতে হয়। চব্বিশ ঘন্টা মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে হয়। অনেকে বলেন যে, সকলের ছুটি আছে, কিন্তু পুলিশের ছুটি নেই- এজন্য আমার দুঃখ হয়। সংখ্যায় আপনারা খুব কম বলেই আপনাদের রাত-দিন কাজ করতে হয়। আমি আপনাদের সব অসুবিধার খবর যে রাখি না, তা নয়। কিন্তু উপায় কি? সাধারণ মানুষের টাকা দিয়েই সব চলে। কিন্তু আজ মানুষের যে অবস্থা দেশের যে অবস্থা, তাতে তাদের ওপর আর ট্যাক্সের বোঝা চাপানো যায় না। আজ আমরা যারা এখানে আছি, তারা সরকারি বা বেসরকারি কর্মচারী। পুলিশ, সামরিক বাহিনী, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী বা আনসার যা-ই আমরা হই না কেন সকলেই এই বাংলাদেশের জনগণের টাকা দিয়েই চলি এবং সবাইকে রাখা হয়েছে জনগণের সেবা করার জন্য।

জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী- এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন? গরিবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনাদের নয়, সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি- যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য  যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটি নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আল্লাহর কাছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, আমি আপনাদের জাতির পিতা, আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাদের নেতা। আমারও সেখানে দায়িত্ব রয়েছে। আপনাদের প্রত্যেকটি কাজের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত আমার ঘাড়ে চাপে, আমার সহকর্মীদের ঘাড়ে চাপে। এ জন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল, আমার অনুরোধ রইল, আমার আদেশ রইল- আপনারা মানুষের সেবা করুন। মানুষের সেবার মতো শান্তি দুনিয়ার আর কিছুতে হয় না। একটা গরিব যদি হাত তুলে আপনাকে দোয়া করে, আল্লাহ সেটা কবুল করে নেন। এ জন্য কোনোদিন যেন গরিব-দুঃখীর ওপর, কোনো দিন যারা অত্যাচার করেনি, তাদের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। যদি হয়, আমাদের স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।

আমার ভাইয়েরা, একদল লোকের পয়সার লোভ অত্যন্ত বেড়ে গেছে। পয়সার জন্য তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। মৃত্যুর পর এ পয়সা তাদের কোনো উপকারে আসবে না। এই পয়সায় যদি তাদের সন্তানরা মানুষ না হয়, তাহলে তারা নানা অপকর্মে তা উড়িয়ে দেবে। তাতে তারা লোকের অভিশাপ কুড়িয়ে আখেরাতেও শান্তি পাবে না। তাই আমি সকলকে অনুরোধ করি, রাত্রে একবার চিন্তা করবেন, সারাদিন ভালো কিছু করেছেন, না মন্দ করেছেন। দেখবেন, এতে পরের দিন মনে আশা জাগবে যে, আমি ভালো কাজ করতে পারি। এদেশের মানুষ বহু কষ্ট করেছে। যুগ যুগ ধরে তারা কষ্ট করছে। এই বাংলাদেশে কয়েক হাজার লোক না খেয়ে মারা গেছে। একথা আমি গোপন করিনি। বিদেশ থেকে খাবার আনতে চেষ্টা করেছি। নিরন্ন মানুষদের খাওয়ার জন্য পাঁচ হাজার সাত শ’র মতো লঙ্গরখানা চালু করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী ও রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে সেই সব লঙ্গরখানা চালিয়েছেন। কোনো মতে আমরা এই দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি।

মাঠে, কল-কারখানার সর্বত্র আমাদের উৎপাদর বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে। কোনোরূপ ফ্যাশন আর চলবে না। এই তিনবছরে অনেক ফ্যাশন হয়েছে। কিন্তু যে ফ্যাশন বজায় রাখতে গিয়ে মানুষ তার নিজের কাজে ফাঁকি দেবে, চুরি-ডাকাতি করবে, আর বড় বড় কথা বলবে, সে ফ্যাশন আর করতে দেওয়া হবে না। মানুষের সহ্যের সীমা আছে, আমারও সহ্যের সীমা আছে। এবার আমি আপনাদের কাছে সাহায্য চাই। আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব। প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব। প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষকে ভালোবাসবো। প্রতিজ্ঞা করুন- আমরা দেশের মাটিকে ভালোবাসাবো। যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে যায়, আপনারা মোকাবেলা করে বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।

আপনাদের দুঃখ-কষ্টের কথা আমি জানি, আপনাদের খাওয়া-পরার কষ্টের কথাও। কিন্তুকষ্ট কি শুধু আপনারাই করছেন? যাদের টাকা দিয়ে আমরা চলি, তারাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করছে। আমরা চাই একটা শোষণহীন সমাজ। আমরা চাই ইনসাফের রাজত্ব। আমরা চাই মানুষ সুখী হোক, গরিব-দুঃখী, বড়-ছোট সবাই পেট ভরে ভাত খাক। তাহলেই তো আমাদের স্বাধীনতা সার্থক হবে। যারা আত্মত্যাগ করেছে, রক্ত দিয়েছে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
আজ হতে শুরু হোক আপনাদের নতুন জীবন। এই পুলিশ সপ্তাহ থেকে আপনারা নতুন মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করুন, যাতে বাংলাদেশের পুলিশ দুনিয়ার বুকে গর্বের বস্তু উঠতে পারে। এটিই আমি চাই আপনাদের কাছে। আপনাদের জন্য আমার সহানুভূতি আছে। আপনারা জানেন, আপনাদের আমি ভালোবাসি। আপনাদের জন্য চব্বিশ ঘন্টা কাজ করেও আমি ক্লান্তি বোধ করি না। কিন্তু আমি চাই, আপনারা মানুষকে ভালোবাসুন। তাহলেই শান্তি আসবে।

আমি আপনাদের এই সপ্তাহে কামিয়াবি হওয়ার কামনা করি এবং আরও কামনা করি, সব পুলিশ কর্মচারী, যিনি যেখানেই থাকুন না কেন, সবাই যেন সৎ হওয়ার এবং মানুষকে ভালোবাসার সুযোগ পান। আজকে আপনারা আরও প্রতিজ্ঞা করুন, ‘আমরা এমন পুলিশ গঠন করব, যে পুলিশ হবে মানুষের সেবক, শাসক নয়’। আমি পুলিশ বাহিনীর ভাইদের আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে বলছি- একদিন বাংলার মানুষ সুখী হবে, এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সৎ পথে থাকতে হবে। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা।”

স্বাধীন দেশের প্রথম পুলিশ সপ্তাহের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু কিভাবে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে কত ত্যাগের বিনিময়ে এ অর্জন তা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং কিভাবে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা প্রয়োজন তার দিক-নির্দেশনা দেন। পুলিশ জনগণের সেবক, পুলিশের দায়িত্ব, পুলিশ বাহিনী যাতে শৃঙ্খলা বজায় রেখে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি নির্দেশ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পুলিশের দুঃখ-দুর্দশার কথা উল্লেখ করে বলেন- দেশে একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাহলেই আমাদের স্বাধীনতা সার্থক হবে।

বঙ্গবন্ধু সেদিনের ভাষণে পুলিশ বাহিনীকে কর্মোদ্দীপনা যুগিয়েছিলেন। শান্তি-শৃঙ্খলা ঠিক রেখে জনজীবনে স্বস্তি বজায় রাখতে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদ্বারিত্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। ‘পুলিশ জনগনের বন্ধু’ এটি আজ স্বীকৃত। পুলিশ বাহিনী জনগণের সহযোগিতায় এবং তাদের অংশগ্রহণেই প্রো-এ্যাকটিভ পুলিশিং এর মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে যা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

‘মুজিববর্ষের অঙ্গিকার, পুলিশ হবে জনতার’। পুলিশ সপ্তাহ-২০২০ উদযাপনের শুরুতে এই শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ কার্যক্রম শুরু করে যেটি গ্রহণ করা হয় পুলিশ সপ্তাহে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত প্রথম পুলিশ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘একটা কথা আপনাদের ভুললে চলবে না। আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশি শোষকদের পুলিশ নন, জনগণের পুলিশ, আপনাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা।’ বাংলাদেশ পুলিশ সেই কাজটি করার প্রয়াসে নিবেদিত। সমাজে এমন কোন ঘটনা নেই যেখানে পুলিশের উপস্থিতি নেই। পুলিশ জনগনের সেবক হয়ে জনগণের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, আমরা এমন পুলিশ গঠন করবো, যে পুলিশ হবে মানুষের সেবক, শাসক নয়।’ বাংলাদেশ পুলিশের জন্মলগ্ন থেকেই পুলিশ বাহিনী জনগণের সেবায় নিয়োজিত। পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের সেবা করার মানসিকতা নিয়েই এই সার্ভিসে প্রবেশ করেন এবং এই সার্ভিসের সদস্যগণ দেশপ্রেমের চেতনায় লালিত। যার কারণে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে পুলিশের অকুতোভয় বীর সদস্যরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স থেকে বেতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধের সংবাদ তখন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা সেই গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে সেবা দিয়ে চলেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পর পুলিশ বাহিনীতে বিভিন্ন পরিবর্তন সাধিত হয়।  পুলিশকে জনবান্ধব করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। থানায় এসে আইনগত সেবা গ্রহণে জনসাধারনকে উৎসাহিত করা হয়। পুলিশ এখন আর শোষকের ভূমিকায় নয়, পুলিশ এখন জনগণের সেবক। আধুনিক পুলিশ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। জনগণের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হয়। মানুষের ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশের কোনো বিকল্প নেই।

দেশের যেকোনো ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ পুলিশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ সর্বদা প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগন হৃদয়ে ধারণ করে। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসা পুলিশ সদস্যদেরর আবেগ তাড়িত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের বীর সদস্যগণ যে গৌরবময় ভুমিকা রেখেছেন ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বাংলাদেশ গড়তে পুলিশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা ছিল অনেক। পুলিশের প্রতি জনগণের প্রত্যাশাও বেশি। দুর্নীতিমুক্ত হয়ে শতভাগ পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করলে মানুষের আস্থা অর্জন করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের পুলিশ হয়ে নিজেদেরকে সেবার উদ্দেশ্যে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চায়। মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ পুলিশ যে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তা জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করবার জন্য। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ পুলিশ মানবিক পুলিশিংয়ের দিকে গুরুত্ব দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় উজ্জীবীত বাংলাদেশ পুলিশের সেবার মান উন্নয়ন এবং তড়িৎ গতিতে সেবা পৌঁছে দেয়াই তাদের মূল লক্ষ্য।

সাম্প্রতিক সময়ে ২০২০ ও ২০২১ সালে সারাবিশ্বে যখন বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় তখন ফ্রন্টলাইনার হিসেবে করোনাযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা সারাবিশ্বে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও দূরদর্শীমূলক সিদ্ধান্তে করোনা মহামারি কোভিড-১৯ ঠেকাতে বাংলাদেশ অনেকাংশে সফল একথা অনস্বীকার্য। এই যুদ্ধজয়ে বাংলাদেশ পুলিশ নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের পাশে ছিল। জনগণের দুঃসময়ে পাশে থেকে জনতার পুলিশ হওয়ার এই বোধ দেশপ্রেমেরই নামান্তর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এটাই আশা করেছিলেন। বাংলাদেশ পুলিশ জাতির পিতার আদর্শ লালন করে জনতার পুলিশ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

লেখক : #জয়িতা শিল্পী, পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ ও উপ-পরিচালক, র‌্যাব-৪