Logo

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্যানিটারি ল্যান্ডফিলিং

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১
  • শেয়ার করুন

ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ও দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সকল শহরে বর্জ্য উৎপাদন দিনদিন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের মোট বর্জ্যরে শতকরা ৩৭ ভাগই উৎপাদিত হয় রাজধানী ঢাকায়। অথচ সেখানে বর্জ্যরে কোনো পরিকল্পিত ব্যবহার নেই। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এসব বর্জ্য পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করছে। ছড়াচ্ছে প্রচন্ড দুর্গন্ধ ও রোগজীবাণু। শহরগুলি বসবাসের ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বর্জ্য পদার্থ অপরিশোধিত অবস্থায় রয়ে যাচ্ছে। দেশে তৈরি হচ্ছে আবর্জনার পাহাড়। নালা, জলাশয় এবং নদী সবই বর্জ্য পদার্থে বুজে গিয়েছে। শহরগুলোতে অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা , চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সবাইকে। ডাস্টবিন থাকা সত্তে¡ও অনেকেই রাস্তাঘাটেই ময়লা ফেলে দিচ্ছে, এগুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যাচ্ছে ড্রেনে, ড্রেন থেকে নদী ও সাগরের তলদেশে গিয়ে নষ্ট করছে জীববৈচিত্র ও পরিবেশ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সফল না হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা এবং পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের অভাব , দূরদর্শিতার অভাব, বছরের পর বছর অবহেলা, যথাযথ প্রযুক্তির অব্যবহার, দুর্বল অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর অভাব, সাধারণ মানুষের উদাসীনতা। বর্তমানে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এতটাই জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ, যাকে উপেক্ষা করার অর্থ হল নিজেদের বিপদ ডেকে আনা।

ল্যান্ডফিলিং হল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা পরিশোধনের সবচেয়ে পুরাতন পদ্ধতি। পদ্ধতিটি ১৯১২ সালে ইংল্যান্ডে চালু হয়েছিল। পৃথিবীর বহু জায়গায় এটি দেখা যায়। এটি হচ্ছে, পৌরসভার কঠিন বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্পত্তি করার পদ্ধতি। লোকালয় থেকে দূরে ফাঁকা জায়গায় কিংবা নীচু জমিতে বিপজ্জনক নয় এমন কঠিন বর্জ্য পদার্থ জমা করাকে ল্যান্ডফিল বলে। এতে ময়লা বা আবর্জনাকে কোন নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে মাটিচাপা দেয়া হয়। ল্যান্ডফিলিং অভ্যন্তরীণ ধরনের হতে পারে, যেখানে একজন ময়লা উৎপাদনকারী তার বর্জ্য, উৎপন্ন স্থানেই নিজস্ব জায়গায় ফেলবে অথবা সকলের জন্য ব্যবহার্য হতে পারে, যেখানে অনেক উৎপাদনকারী ময়লা ফেলবেন। অনেক ল্যান্ডফিলিং এ আবর্জনা ফেলা ছাড়াও অন্য কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন অস্থায়ীভাবে বর্জ্য জমা রাখার জন্য এবং ঘনীকৃত করে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির জন্য কিংবা আবর্জনা প্রক্রিয়াকরণের কাজে (বেছে আলাদা করা, পরিশোধন করা কিংবা পুনর্ব্যবহারোপোযোগী করে তোলা)। ঐতিহাসিকভাবে ল্যান্ডফিলিং সুশৃঙ্খলভাবে বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত একটি ব্যবস্থা হলেও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য এই পদ্ধতিতে উৎপন্ন মিথেন গ্যাস ও লিচেট (ল্যান্ডফিল থেকে নিষ্কাশিত তরল) কার্যকরভাবে পরিচালনা করা হয় না। ফলে সহজেই দূষণের সৃষ্টি হয় এবং রোগ বহনকারী কীটপতঙ্গদের আকর্ষণ করে। উন্মুক্ত ডাম্পগুলি এখনও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রচলিত যা পরিবেশগত নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। দূষণ রোধের জন্য বায়ু এবং পানি থেকে আবর্জনা বিচ্ছিন্ন করা জরুরী। সেই গুরুত্ব থেকেই আধুনিক স্যানিটারি ল্যান্ডফিল সাইট প্রস্তুত করা হয়।

বাংলাদেশে এখনও বিজ্ঞানসম্মতভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক কোন ল্যান্ডফিলিং গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ পৌরসভা বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলোকে কোন গর্তে বা নিচু জায়গায় ফেলে থাকে। তবে রাজধানী ঢাকাতে দুটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট রয়েছে। এর একটি আমিনবাজারে এবং অন্যটি মাতুয়াইলে। রাজধানীর সব আবর্জনা এ দুটি স্থানে জমা হয়। উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যরে মাত্র ৫৫% সংগ্রহ করা সম্ভব হয় এবং ফেলে দেওয়া হয় এই দুটি ল্যান্ডফিল সাইটে। মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলটি ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে, ১০০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত যেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এর পৌরসভার কঠিন বর্জ্য নিষ্পত্তি করা হয়। এটি যাত্রা শুরু করে ১৯৯৫ সালে। বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণে প্রতিদিন ৩,২০০ থেকে ৩,৫০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, প্রায় ২৬ বছর বয়সী, এই ল্যান্ডফিলটি এখন সর্বাধিক ধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন দ্বারা ব্যবহৃত আমিন বাজারের সাইটটির মেয়াদ ইতোমধ্যে ২০১৭ সালে শেষ হয়েছে। প্রতিদিন আসা প্রায় ৩,০০০ টন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছে এটি। বর্তমানে এখানে প্রায় দশ মিটার উঁচু উঁচু আবর্জনার পাহাড় দেখা যায়। এখানে নেই কোন বিভাজন ও রিসাইকেল সুবিধা। ২০০৬ সালে মূলত স্যানিটারি ল্যান্ডফিল তৈরী করার উদ্দেশ্যে এটি স্থাপন করা হয়েছিলো কিন্তু বর্তমানে এটি একটি খোলা ডাম্পের চেয়েও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ঢাকার ল্যান্ডফিলগুলি বর্তমানে বর্জ্যে পরিপূর্ণ এবং সিটি কর্পোরেশনগুলি আধুনিক টেকসই ল্যান্ডফিল ব্যবহারের পদ্ধতিগুলি প্রয়োগ করার পরিবর্তে কেবল আরও বেশি বেশি জমি অধিগ্রহণ করছে। এই দুইটি সাইটই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারে নি ।

আধুনিক স্যানিটারি ল্যান্ডফিলগুলি বর্জ্যপদার্থ নিরাপদ বিভাজন করতে এবং ভূগর্ভস্থ জলের দূষণ বা অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যা প্রতিরোধ, পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে এমন কোন উপজাত, লিকেজ এবং অন্য যেকোন কিছু নিরীক্ষণের জন্য ডিজাইন করা একটি লেয়ারিং সিস্টেম ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে নির্মাণ করা হয়। আধুনিক ল্যান্ডফিলে প্রথমত একটি নিরাপদ জায়গা নির্বাচন করা হয়, যেটি সাধারণত শহর থেকে দূরে হয়। তারপর সঠিক ডিজাইনের বড় গর্ত করে কাদামাটির আবরণ দেওয়া হয়, তার উপর প্লাস্টিক লিনিয়ার বিছিয়ে দেওয়া হয় , যাতে করে মাটি এবং ভূগর্ভস্থ-পানি বর্জ্য থেকে পুরোপুরি আলাদা এবং নিরাপদ থাকে। পৌরসভার বর্জ্যগুলি এখানে এসে পৌঁছার পর বাছাইকরণ করে অপচনশীল বর্জ্য যেমন প্লাস্টিক, কাচ ইত্যাদি আলাদা করে বাদ দেওয়া হয়। সংগৃহীত বর্জ্যগুলি নির্ধারিত জায়গায় কয়েকটি সেলের মধ্যে ধাপে ধাপে রেখে ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে চাপা দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়। ভরাট হয়ে গেলে উপরে ঢাকনা দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে বৃষ্টির পানি এবং বাতাস ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। তারপর ধীরে ধীরে বর্জ্য পচতে থাকে। ল্যান্ডফিল থেকে নিষ্কাষিত তরল বা লিচেট নিচের স্তরে জমা হয় ,তা পাইপের সাহায্যে বাহিরে বের করে এনে কালেকশন পুকুরে রাখার ব্যবস্থা থাকে। পরবর্তীতে ট্রিটমেন্ট এর মাধ্যমে কোন জলাশয়ে তা মুক্ত করে দেওয়া হয়। ল্যান্ডফিলিং সম্পর্কিত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, সমাহিত বর্জ্য কখনো ভূপৃষ্ঠের পানির বা ভূগর্ভস্থ পানির সংস্পর্শে আসে না। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইনের মাধ্যমে ল্যান্ডফিলের নিচে এবং বর্ষার মওসুমে উঁচু ভূ-গর্ভস্থ ওয়াটার টেবিলের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে। বেশিরভাগ নতুন ল্যান্ডফিলগুলোর নিচে একটি অবিচ্ছিন্ন লাইনার বা বাধা থাকার পাশাপাশি ভূ-গর্ভস্থ পানি পর্যবেক্ষণ কূপের ব্যবস্থা থাকে যাতে এর আশেপাশের এলাকার ভুগর্ভস্থ পানির অবস্থা সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখা যায়। এই প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে মিথেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। মিথেন একটি দাহ্যগ্যাস এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই এর ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। মিথেন গ্যাস পরিবেশে ছেড়ে না দিয়ে বাহিরে বিশাল ট্যাঙ্ক এ সংরক্ষণ করা হয়। যা পরবর্তীতে শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। যেমন বিকল্প জ্বালানি , বিদ্যুৎ শক্তি ইত্যাদি। বিষয়টি এতটাই চমৎকার যে, অতীতে যারা বায়ুমন্ডলকে দূষিত করত এখন তারা বন্দী হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি ল্যান্ডফিল পূর্ণ হয়ে গেলে স্থায়ীভাবে প্লাস্টিকের লাইনারে আবদ্ধ করে দুই ফুট বা তার বেশি মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তারপরে বৃষ্টিপাত এবং বাতাসের কারণে মাটির ক্ষয় রোধ করার জন্য উদ্ভিদ (সাধারণত ঘাস এবং কম শিকড়যুক্ত গাছপালা) রোপণ করা হয়। পরবর্তীতে এই জায়গায় বিভিন্ন ধরণের গাছপালা রোপণ করা যেতে পারে, অন্যথায় অকেজো জমি যেমন- উদ্যান, গল্ফ কোর্স বা অন্যান্য উপযুক্ত পাবলিক প্রকল্প নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। পরিবেশের উপর কোন ক্ষতিকারক প্রভাব যেন না পড়ে সেজন্য ৩০ বছর ধরে এই সাইটটি পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভবিষতের কথা চিন্তা করে জরুরিভিত্তিতে এমন আধুনিক স্যানিটারি ল্যান্ডফিল গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।