Logo

বাংলাদেশ কোন্ পথে যাবে?

অনিন্দ্য বাংলা
রবিবার, এপ্রিল ১২, ২০২০
  • শেয়ার করুন

( মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয় )

বাংলাদেশ কোন্ পথে যাবে?

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বৃটিশ মডেলে পার্লামেন্টারী শাসন কিংবা মার্কিন মডেলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন এ যাবতকাল ধরে প্রয়োগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। পশ্চিমা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি সমূহ যেভাবে কাজ করে বা করছে বাংলাদেশে এগুলোর প্রয়োগ এবং ফলাফল অনুরূপ নয়। পাশ্চাত্যের সমাজ, মানুষ, মূল্যবোধ এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের অনুরূপ নয়। ফলে রাষ্ট্রতত্ত¡ কোন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান না হওয়ায় এর প্রয়োগ এবং ফলাফল সকল সমাজে অনুরূপ হতে পারে না। মালয়েশিয়ার ড. মাহাথির মোহাম্মদ এশিয়ান টাইপের গণতন্ত্রের কথা বলেন যা পাশ্চাত্যের কোন ব্যবস্থার হুবুহু প্রয়োগের প্রচেষ্টা নয়, বরং কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির, ভিন্ন মাত্রার। এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এরকম নানাবিদ বা ভিন্ন চিন্তা হতে পারে। কিংবা পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন সমাজ এবং জনগোষ্টীর জন্য বহু ও বিভিন্ন শাসন পদ্ধতির সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের সার্বিক স্বচ্ছতা বিধানের জন্য আমরা একটি অভিনব পদ্ধতির সূচনা করেছিলাম। সূচনালগ্নে অনেকেই মনে করেছিলেন ‘তত্ত¡াবধায়ক ব্যবস্থা’ সুফল নিয়ে আসবে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে এ পদ্ধতিটিও নিখুঁত নয় বা ততটা আশাব্যঞ্জক হওয়ার মত নয়। যেহেতু গতানুগতিক শাসন পদ্ধতিগুলো আমাদের খুব কাজে দিচ্ছে না ফলে আমাদের বর্তমান সেনাপতি শাসন পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য অনুকরনের বিকল্প কিছু ভাবার তাগিদ দিয়েছেন একাধিকবার। সমাজের বিভিন্ন স্তরেই এ নিয়ে শংকা, চিন্তা এবং পর্যালোচনা রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী শাসন ব্যবস্থার সাথে তাদের একটি স্থায়ী সংশ্লিষ্টতার কথাও বলেছে যতে শাসন প্রক্রিয়াকে সুষ্টু পরিচালনায় সেনাবাহিনী সহযোগী হতে পারে। তবে এরকম পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়, পৃথিবীতে এর নজির আছে অনেক। সুস্থ-স্বাভাবিক সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনা অংশগ্রহণ খুব কাজের কিছু হতে পারে না নানাবিদ কারণেই।

বাংলাদেশ এখন কোন্ পথে যাবে? স্বাধীনতার পর থেকে এখন নাগাদ বাংলাদেশের সব পথ ইতিমধ্যে হাঁটা হয়ে গেছে। সব পথই আমাদেরকে নিয়ে গেছে ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে। অনেকেই বলেন এসব পথের কোন দোষ নেই, পথগুলো মন্দ নয় বরং এই পথে আমাদের নেতৃত্বে কে/কারা আছেন সেটার উপর নির্ভর করে আমাদের গন্তব্য হবে সফলতা না ব্যর্থতা। সেটাও সত্যি, খুবই সত্যি। কিন্তু ইতিমধ্যে এটাও প্রমাণিত হয়েছে আমরা যাদের নেতৃত্বে এই পথ হেঁটেছি তারা বার বার আমাদেরকে ব্যর্থতার দ্বার প্রান্তে নিয়ে গেছেন। আমরা এখনও একটি অনুন্নত, পশ্চাদপদ জাতি। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের কোন কান্ডারী নেতৃত্ব তৈরী হবে তারও কোন সম্ভাবনা নেই। বরং আগামী দিনের বাংলাদেশে যারা প্রধানমন্ত্রী হবেন তারা ইতিমধ্যে অবধারিতভাবে পূর্বনির্ধারিত হয়ে গেছেন এবং তাদের চলমান কার্যক্রম আমাদেরকে কোন আশার আলো দেখায় না। আগামী দিনগুলোতে আমাদেরকে যে রাজনৈতিক দলগুলো শাসন করবে তাদের রাজনৈতিক চরিত্র আমাদের মুখস্ত, তাদের সকল নেতা-কর্মীরা আমাদের চেনা-জানা পরিচিত। তাদের দ্বারাই ঘুরেফিরে আমরা এ যাবত শাসিত হয়ে এসেছি। আমাদের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর কোন কর্মসূচী, মনোভাব, কার্যক্রম বা নেতৃত্ব গঠন প্রক্রিয়া আমাদের সামনে এমন কোন আশা তৈরী করে না যে তারা পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে।

বাঙ্গালীর সূদীর্ঘ ইতিহাসে স্ব-শাসনের তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই। ৭১-এর পর আমরা নিজেরা নিজেদের শাসন করার যোগ্যতা অর্জন করি। এই জাতির অনেক সাফল্যের ইতিহাসও আছে, গৌরবময় কিছু বিষয় আমাদের জাতিচরিত্রে আছে। তবে শাসন করার ইতিহাস আমাদের সুখকর নয়। যে রাজনৈতিক দলটি এবং তার অবিসম্বাদিত নেতা তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে গোটা জাতিটিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার পথে এবং যাদের নেতৃত্বে জাতি স্বাধীন হয়েছিল তারা যখন শাসন করতে এলেন তখন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। সেই রাজনৈতিক দলটি অতি স্বল্প সময়ে জনপ্রিয়হীন হয়ে গেল, জাতির জনক আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলেন। তারপর গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার ইতিহাস আরো করুণ। আমরা গত ৩৭ বছরে প্রমাণ করলাম আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটাই শাসনের যোগ্য নয়। ২০০৭ সালের ৯/১১ এর প্রেক্ষাপটে যে তত্ত¡াবধায়ক সরকারটি ক্ষমতায় আসে তাদের কাছে প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। এর কিছু সুনির্দিষ্ট কারণও ছিল। যেমন-
০১) একটি বিশেষ সংকটময় প্রেক্ষাপটে এঁরা ক্ষমতায় এলেন ত্রাণকর্তা রূপে।
০২) এঁদের সাথে সক্রিয়ভাবে ছিল দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ সেনাবাহিনী।
০৩) এঁরা প্রত্যেকেই সৎ, যোগ্য এবং দক্ষ ব্যক্তিত্ব।
০৪) এঁরা রাজনীতি নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ-সচেতন মানুষ।
০৫) এঁদের সাথে শুরুতে সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত সমর্থন ছিল।
০৬) এটি কোন গতানুগতিক তত্ত¡াবধায়ক সরকার নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়াও তাঁরা অনেক মৌলিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং একটি দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছেন।
আমাদের দেশে একটি কথা খুব প্রচলিত, আর তা হল এখানে যারা রাজনীতি করেন তারা দেশের সবচেয়ে অযোগ্য লোক। তাদের অধিকাংশই দূর্নীতিপরায়ন, অশিক্ষিত, হিংস্র এবং অযোগ্য। ফলে বর্তমান তত্ত¡াবধায়ক সরকারটি ঠিক তার উল্টো। এঁরা যোগ্য, শিক্ষিত (অনেকেই বলেন ’ডক্টরস্ টিম’), দুর্নীতিবিরোধী, নিরপেক্ষ এবং ক্ষমতালোভী নয়। তাঁদের শুরুর দিকের কার্যক্রমে মানুষ আশাবাদী হয়েছিল এই ভেবে যে, এঁরা যেহেতু রাজনীতিবিদ নন ফলে শাসন ক্ষমতার সাথে স্থায়ীভাবে থাকবেন না, তবে রাজনীতিতে তাঁরা কিছু গুনগত পরিবর্তন এনে দিয়ে যাবেন যাতে পরবর্তীতে যারা আমাদেরকে শাসন করবে তারা যেন আর বিপথগামী হবার সুযোগ না পায়। তাঁরা রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই স্বল্পসময়ে কোন আমূল পরিবর্তন করে দিয়ে যাবেন তা নয়, তবে পরিবর্তনের একটি কার্যকর ধারা সূচনা করবেন- এটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তাদের দু-বছরের শাসনের কি ফলাফল হল? আমরা দেখলাম আমাদের শ্রেষ্ঠ লোকগুলোও ব্যর্থ হলেন। তারাও সবত্রই, সকল অশুভের সাথেই আপোষ করলেন। তাঁরা ক্ষমতায় এসেই পরিবর্তনে যে ঝড় তুলেছিলেন তা একসময় হঠাৎ করেই থেমে যায়। তাঁরা দু’বছর পর আমাদের কাছে সেই পরিবর্তনহীন বাংলাদেশ রেখেই চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা অযতাই আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম, অযতাই মাঝখানে কিছু জাদুকরী ব্যাপার ঘটেছিল। যাদেরকে শুরুতে সার্বিক উন্নয়নের শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত করে কোনঠাসা করতে চেয়েছিলেন এখন আবার তাদেরকেই আলিঙ্গণ করে নিলেন। আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি সেই নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক পরিবেশের দিকে।

বাংলাদেশ তাহলে এখন কোন্ পথে যাবে? রাজনীতিকরা আমাদের সাফল্য দিতে পারেন না, আমাদের সেনাবাহিনী ১৫ বছর শাসন করেছে তারা আমদেরকে এগিয়ে নিতে পারে নি, আমাদের সবচেয়ে যোগ্য শ্রেষ্ঠ লোকদের নিয়ে গঠিত সরকারও সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে আমাদেরকে কোন পরিবর্তনের আলো দেখাতে পারেন নি। বাংলাদেশের জন্য কি আরো কোন পথ খোলা রইল? বাংলাদেশের একজন মানুষও কি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন আগামী নির্বাচনে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা এসে আমাদের সব ব্যর্থতা মুছে দেবেন? বাংলাদেশের একজন মানুষও কি কল্পনা করেন অদূর ভবিষ্যতে আমাদের একজন মাহাথির মোহাম্মদ তৈরী হবেন বা আমাদের আওয়ামীলীগ-বিএনপি বৃটেন-আমেরিকার রাজনৈতিক দলগুলোর মত সভ্য হয়ে উঠবে? তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কি? আমরা কার হাতে ক্ষমতা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব? কোন রাজনৈতিক দল? সেনাবাহিনী? কোন তেজস্বী তত্ত¡াবধায়ক সরকার? এরা কেউ কি আমাদের জন্য কোন সাফল্যের সম্ভাবনা তৈরী করেছেন?

স্বশাসনের অভিজ্ঞতার অভাবই হোক বা অন্য কোন জাতিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যই হোক আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি এটাই সত্য। সেনাবাহিনী মাঝখানে ১৫ বছর শাসন করেছে। জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের সামরিক শাসনামলে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রশাসন এবং অর্থনীতিতে কিছু পরিমাণগত পরিবর্তন হলেও তারা কোন গুণগত পরিবর্তন আমাদের এনে দিতে পারেন নি। বরং আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাজনীতিতে তারা কিছু স্থায়ী আপদ তৈরী করে রেখে গেছেন। সেনা শাসনের ফলাফল পৃথিবীজুড়েই এমন হয়, এটি অবাক হওয়ার ব্যাপার নয়। বর্তমান তত্ত¡াবধায়ক সরকারের হাতেই ছিল স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় সুযোগটি। তারা নানাবিদ কারণেই আমাদের রাজনীতিতে কোন স্থায়ী গুণগত পরিবর্তন দিয়ে যেতে পারেন নি। যে বিল্পব তারা শুরু করেছিলেন সেনাবাহিনীর কাঁধে চড়ে সেটাই ছিল মারাত্মক ভুল। রাষ্ট্রের একটি সংগঠন হিসেবে সেনাবাহিনী যুদ্ধের মাঠ ছাড়া আর কোথাও, কখনও সাংগঠনিকভাবে দেশপ্রেমিক হওয়ার কোন কারণ নেই। সাংগঠনিক কারণেই সেনাবাহিনী রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিছক একটি চাপ সৃষ্টিকারী/স্বার্থ গোষ্ঠী। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরে তারাও অন্যান্য সংগঠনের মতোই গোষ্ঠীস্বার্থে আবর্তিত। তাদের কাছ থেকে এর বেশী কিছু আশা করা বোকামী। সেনাবাহিনী রাষ্ট্র এবং রাজনীতিকে শুদ্ধ করে দিয়ে যাবার কোন দায়িত্ব বহন করে না। কারণ দেশের রাজনৈতিক কোন দায় সেনাবাহিনীর নেই। আমরা দেখেছি বর্তমান সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা যখন তাদের সরকারটিকে ’সেনাসমর্থিত সরকার’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, তখন তাৎক্ষণিক ভাবেই সেনাবাহিনী এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সেনাপ্রধান বলেছিলেন, সেনাবাহিনী সব সময়ই সকল সরকারেরই সমর্থক, কোন বিশেষ সরকারের নয়। সেনাবাহিনীর পেশাগত অবস্থান এরকমই। কোন রাজনৈতিক সাফল্য বা ব্যর্থতা কোনটার দায়ই তাদের নেয়ার কথা নয়। ফলে প্রথম দিকে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের মাত্রাতিরিক্ত সেনা নির্ভরতা এবং পাশাপাশি রাজনীতি বিচ্ছিন্নতা এটিকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে গেছে হয়তো। আর্বজনাগ্রস্ত নর্দমা পরিস্কারকর্মী দিয়েই পরিচ্ছন্ন করাতে হবে; তাদেরকে দায়িত্বে অবহেলার অজুহাতে তালাবদ্ধ করে রেখে কোন ভদ্রলোককে দিয়ে এই আর্বজনা পরিস্কার করানো সম্ভব নয়। আমাদের বর্তমান সরকার হয়তো এই ভুলটিই করেছেন।

আমরা জানি বাঙ্গালী একটি আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগ উস্কে দিয়ে এই জাতির দ্বারা বিপ্লব ঘটানো যায়, স্বাধীনতা অর্জন করানো যায়, প্রচন্ডভাবে বিক্ষুদ্ধ করে তোলা যায়। কিন্তু সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমে, শাসন পরিচালনায় এবং টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে ধীর-স্থির হিসেবী পদক্ষেপ এই জাতি কখনোই গ্রহণ করতে পারে নি। সূদীর্ঘ ইতিহাসে বাঙ্গালী তার অপূর্ব সুযোগ গুলো কাজে লাগিয়েছে এমন নজির হাতে গোনা। বর্তমানের উন্নত জাতিগুলোর দৃষ্টান্তে দেখা যায় শতবছরে একটি মাত্র সুযোগ পেয়ে সেই সুযোগটিকে দূর্দান্তভাবে কাজে লাগিয়ে অনেক জাতিই তার ভাগ্য পাল্টিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর ৩৭ বছর একটি জাতির ভাগ্য পাল্টানোর জন্য যথেষ্ট সময়। আমরা ৭১ এর মহান অর্জনের মাধ্যমে ঘুরে দাড়াতে পারিনি। ৯০ এর গণতন্ত্র প‚নরুদ্ধারের সুযোগটি কাজে লাগাতে পারিনি, নোবেল বিজয়ের অর্জনকে কাজে লাগাতে পারি না, ক্রিকেটের সাফল্য জাতীয় একাত্মতায় কাজে লাগাতে পারি না। কোন সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারি না। সর্বশেষ ২০০৭ এ ঘুরে দাঁড়ানোর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগটিও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা এখন ঠিক উল্টো পথে হাঁটা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি। ডিসেম্বর ’০৮ এর নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনের প্রেক্ষিতে যে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসছে তারা অবধারিতভাবে আমাদেরকে নিয়ে আবারো উল্টো পথে অন্ধকারের দিকে রওয়ানা দেবে। আমরা ৩৭ বছর যাবত উল্টো পথের যাত্রী।

অনেকেই বলেন গণতন্ত্র আইন করে, সংবিধান করে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপার নয়। গণতন্ত্র অর্জন করতে হয় দীর্ঘ চর্চার মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানটি ছিল পৃথিবীর সেরা সংবিধানগুলোর একটি । কিন্তু সেই সংবিধান দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রটির রাজনীতি, প্রশাসন বা অর্থনীতি পৃথিবীর সেরা রাষ্ট্রগুলোর অনুরূপ হতে পারেনি। সেই সংবিধানের অধীন বাংলাদেশও ছিল অপরাজনীতির শিকার। ফলে গণতন্ত্র এমন কোন বিধানভিত্তিক ব্যবস্থা নয়। এটি ধীরে ধীরে শুধু রাষ্ট্রে নয়, সমাজের সকল স্তরে অর্জিত হতে হয়। এভাবেই গড়ে উঠে উন্নততর রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ফলে অনেকেই ভাবেন বাংলাদেশ নিয়ে এত হতাশ হওয়ার কিছু নেই; এখানেও একসময় সুদিন আসবে। কিন্তু ৩৭ বছরে সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠার পথে আমরা কতটা এগিয়েছি? কিংবা তার কি কোন লক্ষণ এখানে আছে? ’৯০ এর গণঅভ্যূত্থানের ভিত্তিতে যে গণতান্ত্রিক ধারা এখানে সূচিত হয়েছিল তাতে অনেকেই আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিল। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার সেই ধারাটি কল্পনাতীত ভাবে আবারো ভেঙ্গে পড়ে। ফলে এখানে একটি উন্নততর রাজনৈতিক সংস্কৃতি সহসা গড়ে না উঠার সম্ভাবনা নিয়ে শংকিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসলে জাতিগতভাবে আমরা একটি শংকর জাতি বিধায় এই রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর কোন একক জাতীয় চরিত্র নেই। আমাদের রক্তে বিভিন্ন মেজাজের নৃতাত্তি¡ক জনগোষ্ঠীর রক্ত প্রবাহিত। ফলে আমাদের যেমন ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন ভিন্ন বা বিপরীতমুখী, তেমনি জাতিগতভাবেও কোন নির্দিষ্ট প্যাটার্নের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের নেই। ফলে কোন বিষয়ে একমত হতে পারার ঘটনাটি এখানে খুব কমই ঘটে। প্রধান প্রধান জাতীয় ইস্যুগুলোতে আমাদের জাতীয় ঐকমত্য নেই। এরকম শংকর জাতির জনগোষ্ঠীর চেয়ে বহুজাতিক জনগোষ্ঠীসমূহ বরং অধিকতর ভাল রাজনৈতিক পরিচয় অর্জনে সক্ষম। কোন সভ্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের নিজেদের দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়। এরকম একটি সংস্কৃতির চাপে অভ্যস্ত হতে হতে আমাদের দ্বারা তা অর্জিত হতে পারে।

বাংলাদেশ তাহলে কোন্ পথে যাবে? বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য উপায় হল আমাদের সরকার কাঠামোতে ‘শাসন বিভাগটির’ আন্তর্জাতিকীকরণ। সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন এবং বিচার বিভাগ আমাদের হাতেই থাকবে। সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। তবে শাসন বিভাগটির দায়িত্ব আমাদের হাতে নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবে/জাতিসংঘের মাধ্যমে গঠিত একটি ক্যাবিনেটের/উপদেষ্টা পরিষদের হাতে শাসন বিভাগ ছেড়ে দিতে হবে। শাসন বিভাগের প্রশাসন এবং আমলাবাহিনী আমাদের নিজস্ব থাকবে। শুধুমাত্র ক্যাবিনেটের আন্তর্জাতিকীকরণ করা হবে। আমাদের পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রদত্ত সুপারিশের ভিত্তিতে জাতিসংঘ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার ক্যাবিনেট প্রেরণ করবে যা হবে আমাদের পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত। সেই ক্যাবিনেট/উপদেষ্টা পরিষদ একটি স্বল্পকালীন (৩/৪ বছর মেয়াদী) শাসন পরিচালনা করবে এবং তাদের যাবতীয় কার্যাবলীর জন্য তারা আমাদের সংসদের নিকট দায়িত্বশীল থাকবে। সংসদ মধ্যবর্তী পর্যায়ে (একটি জটিল প্রক্রিয়ায়) প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে পারবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং সফল রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, কুটনীতিবিদ সমন্বয়ে গঠিত হবে সেই ক্যাবিনেট। পক্ষপাতহীনভাবে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পরিচালিত হবে তাদের দ্বারা। রাষ্ট্রপতির পদটিকে আরো কার্যকর এবং শক্তিশালী করে তুলতে হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেসব গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করেন সেগুলোর মধ্যে যেসব দায়িত্ব ঐ ক্যাবিনেট প্রধানের হাতে দেয়া অনুচিত হবে সেই সব স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর দায়িত্ব থাকবে রাষ্ট্রপতির হাতে। সরকার সংসদীয় প্রকৃতির হওয়া সত্তে¡ও প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি জনগনের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আগামী ২০/৩০ বছরের জন্য শাসন বিভাগের আন্তর্জাতিকীকরণের কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধুমাত্র তাহলেই বাংলাদেশের রাজনীতি আর অর্থ এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক থাকবে না। রাজনীতি হবে একটি স্বেচ্ছাসেবী সেবামূলক পেশা। আমাদের রাজনৈতিক দূষণের বড় কারণ হল ক্ষমতা উপভোগ এবং এর অপব্যবহার, বার বার ক্ষমতায় থাকার অসুস্থ প্রচেষ্টা আর ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন। রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে যদি ক্ষমতা না আসে, আর এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিত্ত অর্জনের সুযোগ যদি না থাকে তাহলে রাজনীতি থেকে অবাঞ্চিতরা এমনি এমনি ঝরে পড়বে। নি:স্বার্থ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী ব্যক্তিবর্গই একটি সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে অবস্থান করবেন। শাসন বিভাগের আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা পরিচালনার পরিবর্তে শুধুমাত্র নীতি-নির্ধারনী এবং আইনী কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকবে। দলগুলো শুধুমাত্র উন্নয়নের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করবে। ক্ষমতা থাকবে অন্যদের হাতে, ক্ষমতার সুবাদে যাবতীয় সুবিধা অর্জনের পথ রুদ্ধ হবে।

একটি দেশের ক্রিকেট/ফুটবল টিমকে সাফল্য এনে দেয়ার জন্য যদি বিদেশী কোচ নিয়োগ করা যায়, শান্তি-শৃংখলা এবং সুষ্ঠু শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যদি শান্তিমিশন হিসেবে বিদেশী সৈন্য মোতায়েন করা যায় তাহলে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনয়নে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রার উন্নয়ন অর্জনের জন্য সরকারী কাঠামোতে অংশগ্রহণমূলক আন্তর্জাতিক সহযোগীতার ধারনাটি অবাস্তব কিছু নয়। এটা আত্মমর্যাদার প্রশ্নে সস্তা আবেগে তাড়িত হয়ে বিরোধীতার ব্যাপার নয়, বাস্তবতা হল নিছক একটি টেকনিক্যাল কাজের জন্য লোক ভাড়া করা। কারণ সমস্ত রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থাকবে আমাদের দেশীয় কর্তৃপক্ষের হাতেই। সরকারের সকল নীতি-নির্ধারনী ক্ষমতা থাকবে পার্লামেন্টের হাতে। সরকার পরিচালনা এবং পার্লামেন্ট প্রণীত বিধান সমূহের বাস্তবায়ন, সরকারী সকল বিভাগকে কার্যকর ভাবে সক্রিয় রাখা, সরকারী প্রশাসনকে দায়িত্ব পালনে কঠিন ভাবে বাধ্য রাখা ইত্যাদি কাজগুলোই এরা সম্পাদন করবেন। সরকারের শাসন বিভাগটির এমন আন্তর্জাতিকীকরণের ধারণাটি পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই প্রযোজ্য হতে পারে।

আমাদের দেশীয় সকল কর্তৃপক্ষই নানাবিধ কারণে এই সমাজ এবং রাষ্ট্রের সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত যে তারা কেউ এখানে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ঝুঁকি গ্রহণ করতে পারবে না, এমনকি করতে চাইলেও তা সম্ভব নয় নানা কারণেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কোন জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বা পরিবর্তন নিয়ে ভাবিত নয়; বাস্তব কারণেই এরা সবাই ভোটের হিসেব নিয়ে চলে। কোন সমাজ থেকে যাদের প্রাপ্তির প্রত্যাশা রয়েছে তারা সেই সমাজকে নির্লিপ্ত ভাবে শাসন করতে পারে না; কোন অসুস্থ সমাজের ভিতরে যাদের অবস্থান সেই অসুস্থ সমাজকে তারা নির্ভিকভাবে শাসন করতে পারে না। আমাদের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারগুলোতে যারা অংশ নেন এবং কাজ করেন তাদের শেকড়ও এই সমাজেই। তাদেরকে এই সমাজেই, এই রাজনৈতিক পরিমন্ডলেই বাস করতে হবে। হয়তো সদিচ্ছা সত্তে¡ও বাস্তবতার কারনেই তাদের দ্বারাও এই রাষ্ট্র কাঠামোতে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। ফলে এমন একটি কর্তৃপক্ষ যার এই সমাজের সাথে কোন স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা নেই এবং যাদের কর্মকান্ড বেধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রায় মূল্যায়িত হবে, যারা একটি বিশেষ মিশন নিয়ে আসবে, যারা আমাদের দেশীয় কর্তৃপক্ষ সমূহের নিকট তাদের কর্মকান্ডের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে, যাদের কোন মৌলিক নীতি-নির্ধারনী ক্ষমতা থাকবে না তারা এই অনুন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি কার্যকর পরিবর্তন সাধন করতে পারবে।

— মোশারফ হোসেন

অধ্যাপক রাস্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

আনন্দমোহন কলেজ