Logo

বাঙালির যৌনজীবন

অনিন্দ্য বাংলা
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৩
  • শেয়ার করুন

যৌনতা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ট্যাবু। সাধারণ ট্যাবু না, ভয়ংকর ট্যাবু। যৌনতা নিয়ে আলোচনা বলতে আমরা বুঝি, নীলক্ষেতে পাওয়া চটি বই অথবা ঘৃত কুমারী মানে এলোভেরা খেয়ে কিভাবে পুরুষের যৌনক্ষমতা বাড়ানো যায় সেই রকম স্বাস্থ্য-পরামর্শক বই। এর বাইরে আরো এক জাতের বই আছে, যা পড়তে গেলে দাঁত দুইটা খুলে রাখতে হয়। অসম্ভব তাত্ত্বিক এই বইয়ে  প্রাত্যহিক যৌনজীবনের সমস্যা-সংকটগুলোর সহজবোধ্য কোন সমাধান/আলোচনা নাই। অতএব এই বইয়ের পাঠক যৌনতা নিয়ে বিরাট আলোচনা করে উল্টে ফেলবে, তা নয়। বরং সীমিত জানাশোনা এবং জ্ঞান নিয়ে সরল বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান বাঙালি সমাজের যৌন জীবনের ধরন, চর্চা তথা বোঝাপড়া-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা যেতে পারে ।

যৌনতা কি? আমাদের সমাজের যৌনতার ধারনা আর বহির্বিশ্বের যৌনতার ধারনা এবং চর্চার মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য বা ব্যবধান রয়েছে। আমাদের সমাজে বা আমাদের মতো সমাজ ব্যবস্থাগুলোতে যৌনতা হচ্ছ নিষিদ্ধ বস্তু। এইটা এমনই নিষিদ্ধ যে এইটা নিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক মানে ১৮ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা এইটা চর্চা তো দূরের আলাপ, এইটা নিয়ে কথা বলাটাও শোভন মনে করি না। যৌনতা নিয়ে কথা বলা আমাদের সমাজে অশ্লীল ব্যাপার, নিষিদ্ধ ব্যাপার। যারা কথা বলে তারা অশ্লীল এবং সমাজের প্রেসক্রিপশনের বাইরে যেয়ে যারা যৌনতা চর্চা করে তারা সমাজে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত আছে বলে ধরে নেয়া হয়। তার মানে যৌনতা ব্যাপারটার সাথে আমাদের সমাজের নৈতিকতার মানদণ্ড ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনেক সমাজ ব্যবস্থায় যখন ধরে নেয়া হয় যৌনতা একটি ব্যক্তিগত বিষয়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় তখন নির্ধারিত করে দেয়া আছে কে কখন কার সাথে যৌন মিলনে যেতে পারবে, কে পারবে না। কোন কোন পন্থায় যৌন প্রক্রিয়া অনুমোদিত, কোন পন্থায় যৌন প্রক্রিয়া অনুমোদিত না; তা আমাদের কালচারের মধ্যে কোড আনকোড ঢুকিয়ে দেয়া আছে। আমাদের সমাজে যৌনতার ব্যক্তিগত বিষয়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। আমাদের সমাজ সিদ্ধান্ত নেয় কোন যৌন সম্পর্ক ঠিক আছে কোন যৌন সম্পর্ক ঠিক নাই। আমাদের সমাজে দুইজন ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিলেই তারা নিয়মিত যৌন সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে না। যৌন সম্পর্কে যেতে হলে সামাজিক নেতা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিতে হয়। যৌন ক্রিয়ার জন্য আইনগত বৈধতা না হলেও চলে কিন্তু সামাজিক এবং ধর্মীয় নেতাদের অনুমতি এইখানে জরুরি। এই পুরো প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছি আমরা বিয়ে। আমাদের যৌনতার ঠিক-বেঠিকের মানদণ্ড মূলত বিয়ে নামক একটি এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি দ্বারা শর্তবদ্ধ। এই মুহূর্তে ১১ বছরের একটি কিশোরী এবং ৩৩ বছরের একটি পুরুষের মধ্যে নিয়মিত যৌন সম্পর্ক বৈধ হতে পারে, যদি তারা বিয়ে নামক চুক্তিটি সেরে ফেলতে পারে! কিন্তু ৩৩ বছর বয়স্ক দুইজন অবিবাহিত নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন ধরনের কোন যৌন সম্পর্ক বৈধ হবে না যদি তারা বিয়ে নামক চুক্তিতে আবদ্ধ না হয়। অর্থাৎ বিয়ে নামক চুক্তিপত্রের ফলে অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক, যা আসলে ধর্ষণ, সেটাও বৈধ হয়ে যায়! একই চুক্তিপত্রের ফলে স্বামী যদি স্ত্রীকে ধর্ষণও করে সেটাও বৈধ হয়ে যায়! আবার এই চুক্তিপত্রটি না থাকার ফলে সম্পূর্ণ প্রাপ্ত বয়স্ক দুইজন নরনারী তাদের ভালোবাসার অংশ হিসেবে যৌন সম্পর্কে যুক্ত হতে পারে না, সেইটা সমাজের মানদণ্ডে অনৈতিক/অনুচিত হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন নরনারী শুধু বিবাহ-চুক্তিতে সম্মত হওয়ার ফলে কেবল  প্রজননের অংশ হিসেবেও যৌন ক্রিয়া করতে পারে। এসব হচ্ছে আমাদের সমাজের বিয়ে এবং যৌনতার ডাইমেনশন।

এ-রকম একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে যৌনতা আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর জানা এই সমাজের যেকোনো সদস্যের জন্য আসলে কঠিন হয়ে যায়। সামাজিক নিয়মনীতি ও নৈতিকতার মানদণ্ডের বাইরে গিয়ে যৌনতাকে শুধু জানতে চাওয়া বা বুঝতে চাওয়াও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে এবং সমাজের চোখে সেটা অনৈতিক ও নিষিদ্ধ হিসেবে ধরা দেয়। যৌনতাকেন্দ্রিক নীতি-নৈতিকতার সামাজিক যেসব মানদণ্ড প্রচলিত, সমাজের সদস্য হিসেবে সেসব মানদণ্ডেই আমরা যৌনতাকে দেখি  ও বুঝি।

আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ার ফলে পুরো বিষয়টিতে পুরুষ নারীর চেয়ে অনেক বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। কিন্তু এই সুবিধা সে ততক্ষণই ভোগ করতে পারে, যতক্ষণ পুরুষ সমাজের চাহিদা/নিয়মমাফিক যৌনচর্চায় যুক্ত থাকে। সমাজ যা অনুমোদন করেনি সেই চর্চা সে করতে পারে না। বিবাহপূর্ব যৌন-সম্পর্ক চর্চাকারী পুরুষ, ‘খারাপ পুরুষ’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়। এক্ষেত্রে নারীর  মাশুল গুনতে হয় বেশিই।  কারণ, পরবর্তীতে বিয়ে করতে গেলে পুরুষটিকে খুব বেশি সমস্যায় হয়ত পড়তে হয় না, অন্যদিকে একই দোষে দুষ্ট  একজন নারীকে বিয়ে করতে গেলে অবশ্যই অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু এই সমাজে একটা বিষয় নিশ্চিত, নারী এবং পুরুষ দুজনের জন্যই, সেইটা হচ্ছে বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক খারাপ, অনৈতিক এবং এটাকে গোপন করতে হবে সমাজের কাছে। এই গোপনীয়তা সমাজের কাম্য, চাহিদাও!

আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় আমাদের সমাজের পুরুষেরা নারীর চেয়ে বেশি যৌন স্বাধীনতা ভোগ করে তা সর্বজনবিদিত। যৌন চাহিদা মেটানোর জন্য যৌনকর্মীর কাছে সে যেতে পারে, কিন্তু এ-সমাজে নারীর জন্য এমন সুযোগ নেই। তবে এই বাড়তি সুবিধা পুরুষকে নিতে হয় গোপনীয়ভাবে।  যে তথ্যটা সমাজ থেকে নারী/ পুরুষ পায় সেটা হচ্ছে, যৌনতা একটি নিষিদ্ধ ও গোপন বিষয়–একে অবদমন করে রাখতে হয়। যৌনতার কোনো ধরনের কোনো বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশই আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিসম্মত নয়।

যৌনতার ক্ষেত্রে এরকম একটি রক্ষণশীল সামাজিক পরিবেশে আমাদের ছেলেমেয়েরা বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে বড় হয়। মানুষের চিন্তা তৈরি করে প্রধানত পরিবার এবং সামাজিক পরিবেশ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা ও তথ্য; এর সাথে যুক্ত হয় কৃত্রিমভাবে পাওয়া তথ্যভাণ্ডার। কৃত্রিম তথ্যভাণ্ডার মানে বই, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বর্তমানে ইন্টারনেট। এই সমস্ত তথ্যভাণ্ডারের সংমিশ্রণে একজন ব্যক্তির চিন্তা গঠিত হয়। কাজেই যৌনতাকেন্দ্রিক ধারণা এবং চিন্তারও আসলে তথ্যভাণ্ডার এগুলোই। এইখানে এসেই নারী এবং পুরুষের যৌনতার ক্ষেত্রে চিন্তা এবং চর্চার পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়। আমাদের পরিবার ও সমাজ নারীকে যৌনতাকেন্দ্রিক যে ধারণাটি দেয় সেটি হচ্ছে, যৌনতা প্রধানত পুরুষের চাহিদা, নারী এখানে নিমিত্তমাত্র। মানে যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষ চাইবে, নারী সেই চাওয়ায় সাড়া দিবে অথবা সাড়া দিবে না। এইখানে নারীর শরীরকেন্দ্রিক কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই। যৌনআকাঙ্ক্ষা শুধু পুরুষের বিষয় । নারীকে যৌনতার ক্ষেত্রে সংযমী হতে হয়, সাবধানী হতে হয় এবং বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্কে অবশ্যই যাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র যার সাথে বিয়ে হবে তার সাথেই যৌন সম্পর্কে যাওয়া যাবে, এ ছাড়া যৌন সম্পর্কে যাওয়া যাবে না। সম্পর্কের নামে পুরুষেরা মেয়েদের সাথে আসলে শুতে চায়। শরীর পাওয়াটাই বেশিরভাগ পুরুষের আসল উদ্দেশ্য। এর বাইরে যে সমস্ত পুরুষেরা শরীর পেতে চায় তাদের কাছে আসলে প্রেম ভালোবাসা বিষয়গুলোর কোন মূল্য নাই। নারীর শরীর বিশেষ করে স্তন এবং যোনী আরাধ্য ধন, এই জন্য যত্ন করে এক পুরুষের জন্য তা সংরক্ষণ করতে হয়। যার সাথে বিয়ের ফুল ফোটে একমাত্র তার সাথেই শোয়া যায। যৌনতা বলতে আমাদের মেয়েরা মোটামুটি এটুকুই বোঝে, এটুকুই চর্চা করে। কোন নির্দিষ্ট পুরুষের সাথে শুতে চাওয়ার ক্ষেত্র মেয়েদের যে স্বাধীন ইচ্ছা থাকতে পারে আমাদের বেশির ভাগ মেয়েরা এইটা ভাবতেই পারে না। যৌন চর্চায় যাওয়া তো পরের ব্যাপার! মেয়েরা যৌনতাকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে, যৌন চাহিদা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে, যৌন ভাষা ব্যাবহার করার ক্ষেত্রে এমনকি যৌনতা চর্চা করার ক্ষেত্রে, সমস্ত ক্ষেত্রেই পুরুষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান ধারণ করে। ধরা যাক বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে বিরাট একটা অংশের ছেলেরা চটি বই পড়ে, ব্লু ফিল্ম দেখে, এখন অনলাইনের যুগে এগুলো আরো সহজলভ্য হওয়ায় একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরেই ছেলেরা যৌনতার সাথে পরিচিতি হয়। চটি বা নীল ছবি দেখে যৌন শিক্ষা কতখানি স্বাভাবিক এবং সুস্থ এই আলোচনায় পরে যাচ্ছি। আপাতত যেটা বলতে চাচ্ছি যে আমাদের সমাজের ছেলেদের যৌনতা বিষয়ে জানার জন্য, বোঝার জন্য তথ্যভাণ্ডার আছে। আগের চটি বই, এক টিকিটে দুই ছবি আর এখন অনলাইনের বদৌলতে ছেলেরা যৌনতা বিষয়ক তথ্য পায়। যদিও হাতে কোন গবেষণা না থাকায় শতকরা কতজন ছেলে এই প্রক্রিয়ায় যৌন তথ্য সংগ্রহ করে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। সেইখানে মেয়েদের জন্য চটি বই পড়া বা এক টিকিটে দুই ছবি দেখা মোটেও কোনও চর্চিত বা স্বাভাবিক বিষয় না। বয়ঃসন্ধিতে পড়লেই বা পার হয়েই কিন্তু ছেলেরা মাস্টারবেশন করে কিন্তু মেয়েরা যেটা কল্পনাও করতে পারে না। ধরা যাক আজ থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগে আমরা যখন স্কুলে ছিলাম তখন অনেক ছেলেরা চটি বই দেখত, পড়ত। কিন্তু কখনো কোন মেয়েকে পাই নাই যে আনন্দলাভের জন্য চটি বই পড়ছে বা পড়েছে।

এটাও আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয়, ছেলেরা যৌনতাকেন্দ্রিক যেরকম আলোচনা করে, মেয়েরা সেটা করে না। ছেলেদের আড্ডায় যেমন যৌনতাকেন্দ্রিক আদিরসাত্মক আলোচনা স্বাভাবিক, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এরকম না। মেয়েদের আড্ডায় যৌনতা বিষয়ে যদি আলোচনা হয় সেগুলো খুবই অভিজ্ঞতা-নির্ভর, শিক্ষণীয় পর্যায়ের । ধরে নেয়া যায়, অনলাইনের যুগে  মেয়েদেরও কিছু যৌনতা-তথ্যের ক্ষেত্রে খানিকটা এক্সেস বেড়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ বলে, তারপরও যৌনতা নিয়ে কথা বলা খুব চর্চিত কোনও বিষয় না।

এই যে মেয়েরা যৌনতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলে না বা এই অভিজ্ঞতা থাকলেও শেয়ার করে না তার একটা প্রধান কারণ সমাজ নির্ধারিত এবং সমাজে প্রচলিত সেইন্ট বা নিষ্পাপ-ধারণা। যৌনতা শব্দটার সাথে পাপের(!) সম্পর্ক আছে। আমাদের মূল্যবোধ অনুযায়ী মেয়েরা নিষ্পাপ থাকতে চায়, নিজেকে সেইন্ট হিসেবে দাবি করতে চায়, এজন্যই নিজের প্রেমিকের সাথে যদি যৌন সম্পর্ক হয়ও মেয়েরা সচরাচর খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবীকেও তা বলে না। এমনকি যে নারী যৌনতার চর্চা করে, সেও মনে করে সে একটি পাপকাজ করছে, অনৈতিক কাজ করছে। যৌনতা চর্চা করা নারীও যৌন মিলনকে নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য মনে করে চর্চা করে না। সে একটা অনৈতিক পাপ কাজ, নিষিদ্ধ কাজ হিসেবেই এটা চর্চা করে, গোপন করে। সম্পর্ক বা বিয়ের বাজারে সেইন্ট বা সতী হিসেবে মেয়েদের মূল্য যাচাই করা হয়। এই জায়গায় ছেলেদের সেইন্ট প্রমাণ করতে হয় না। বেশির ভাগ মেয়েরাই এই জন্য বিয়ে ছাড়া প্রেমিকের সাথে যৌন সম্পর্কে যেতে চায় না তার একটা প্রধান কারণ সামাজিক ডিভ্যালুয়েশন, বা সামাজিক অবমূল্যায়ন, সামাজিক অসম্মান।

যৌন প্রক্রিয়াটি সম্পাদন করার ক্ষেত্রেও নারী পুরুষের দুই ধরনের মনস্তত্ত্ব কাজ করে। পুরুষের জন্য যৌনতা আনন্দ লাভের বিষয়, নারীর জন্য যৌনতা আনন্দ দেয়ার বিষয়। পুরুষের জন্য চাওয়া নারী জন্য সমর্পণ করা। সর্বজন চর্চিত যৌন প্রক্রিয়া হচ্ছে মিশনারী প্রক্রিয়া যেখানে পুরুষ উপরে থাকবে নারী নীচে থাকবে। নারীটি নিশ্চুপ হয়ে নীচে অবস্থান করবে পুরুষটি তার সম্ভোগ প্রক্রিয়া জারি রাখবে। পুরুষ চাইবে, নারী লজ্জা পাবে। এমনকি আমাদের বিবাহিত নারীটিও মুখ ফুটে তার পার্টনারের কাছে তার যৌন আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করতে পারে না। যৌনতা একটি খারাপ, নিষিদ্ধ ও লজ্জার বিষয় এইটা আমাদের নারীর মনস্তত্ত্বে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া আছে শরীরের ক্ষিদায় মন ফাটলেও মুখ ফোটে না। নারী এইখানে আকর্ষিত করবে, পুরুষ আকর্ষিত হবে। যেন নারীরা পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভবই করতে পারে না। পুরুষ চাইবে, নারী দিবে। মদ্দা কথা যৌনতার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষ নারী তাতে সাড়া দেয়। যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষ মুখ্য, নারী গৌণ।

যৌনতার শব্দ চয়ন এবং চর্চা এই দুইটারই শ্রেণীগত ডাইমনেশন আছে। নিম্নবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মাঝে মধ্যবিত্তের তুলনায় যৌনতা কেন্দ্রিক কম ট্যাবু কাজ করে। শব্দ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে বা যৌন চাহিদা বা যৌন অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণিই মধ্যবিত্ত শ্রেণির তুলনায় খোলামেলা।

আমাদের সমাজ যেহেতু যৌন জীবনের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল, এর সরাসরি ছাপ আমাদের সাহিত্যে, নাটকে এবং চলচ্চিত্রে আছে। ৮০র দশকে প্রেমিক প্রেমিকার যৌন সংগম দৃশ্য বোঝাতে দেখাতো দুটি গোলাপের টোকাটুকি। এক দশক পরে এসে আরেকটু সাহসী পরিচালক দেখিয়েছে নায়িকার ঠোট কাঁপছে, নায়ক নিজের ঠোট চাটছে। এই দশকে আরেকটু সাহস করে দুইজন মিলে বিছানায় গড়িয়ে পরছে দৃশ্য দেখায়। এখন রক্ষণশীল সমাজে খোলামেলা যৌন দৃশ্য দেখাতে গেলে বিপত্তি একটা বাধবেই এবং সেটা বাধেও। আমাদের উপন্যাসগুলো মলাট-বদ্ধ হওয়ার ফলেই বোধহয় তুলনামূলক ভাবে নাটক সিনেমার চেয়ে এই খানে যৌন আকাঙ্ক্ষার, শরীরে বর্ণনা তুলনামূলকভাবে আরেকটু বেশি  পাওয়া যায়। যায় মানেই এইটা না যে প্রেক্ষাপটের প্রয়োজনে খোলামেলা যৌন আলোচনা এইখানে করা হয়। উপন্যাস, চলচ্চিত্র বা নাটকে যে কারণে প্রেম ভালোবাসা বলতে আমরা যা পাই তা প্রধানত প্লেটোনিক লাভ মানে শরীর বিহীন দুইটি মনের আদান প্রদান। ওই জন্যই আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রেমের ধারনা হচ্ছে মন দেয়া নেয়ার, প্রেমের সাথে শরীরের কোন সম্পর্ক নাই, এই রকম একটি পাপহীন(!) প্রেম ধারনা নিয়েই আমরা বয়ঃসন্ধিকাল থেকে প্রেমের দুনিয়ায় প্রবেশ করি।

তাহলে প্রেম কি? সেই প্রশ্নে আসা যাক। প্রেমের প্রাকৃতিক যে সংজ্ঞা তার সাথে আসলে নারী পুরুষের প্রক্রিয়েশন বা প্রজনন তাড়না ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এইটার আসলে শুধু মন দেয়া নেয়ার কিছু নাই শুধু শরীর দেয়া নেয়ারও কিছু নাই। প্রেম মানে শরীর এবং মন দুইটাই। প্রেমে মন আসলে তার সাথে সাথে অবধারিত ভাবে শরীরও আসবে। আগে মন আসতে পারে, পরে শরীর অথবা শরীর আগে আসতে পারে, পরে মন। এবং শরীর এবং মনের এই সংযুক্তিটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক অবস্থায় প্রেমের এমন এক শরীরবিহীন সংজ্ঞায় আমরা অভ্যস্ত যে প্রেমের যে কোন পর্যায় যে কোন একজন যখন শরীরের প্রতি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে তখন আমরা ধরেই নেই ও খারাপ। ও খারাপ কারণ আমার কাছে ও প্রেমের নামে শরীর চায়। সাধারণত আমাদের সমাজে পুরুষেরা শরীর কেন্দ্রিক চাওয়াকে অকপটে না হলেও প্রেমিকার কাছে প্রকাশ করে। এবং এই চাওয়াকে সামাজিক সংস্কার এর কারণেই আমাদের মেয়েরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। ধরেই নেয় ও আমার সাথে যৌনতার জন্য সম্পর্কে জড়িয়েছে। আবার উল্টাও হয় কোন মেয়ে যদি তার প্রেমিকের সাথে যৌন সম্পর্কে যায়, তখন ওই পুরুষটাই সামাজিক নৈতিকতার মানদণ্ডে নারীটিকে পরিমাপ করে এবং তাকে খারাপ মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত করে।

এই রকম একটি মিশ্র নৈতিকতার সমাজ এর উপর দাঁড়িয়ে আমরা যৌনতাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করি। এই সমাজে শুধু নারী পুরুষ ভেদে যৌনতার সংজ্ঞা, আকাঙ্ক্ষা ও নৈতিকতার মানদণ্ড ভিন্ন রকম হয় তা-ই না, বরঞ্চ গ্রাম, শহর, অর্থনৈতিক অবস্থান এবং জেনোরেশন ভেদেও এই মানদণ্ড ভিন্নরকম হচ্ছে। যৌনতা চর্চার সামাজিক মানদণ্ড এর সাথে ব্যক্তির যৌন চর্চার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা দিচ্ছে। সমাজ প্রত্যাশা করছে ব্যক্তি সমাজের চাহিদা এবং গাইডলাইন মেনে চর্চা করবে, অন্যদিকে ব্যক্তি তার প্রয়োজনে অথবা ইচ্ছায় তার মতো করে সেটা চর্চা করতে চাচ্ছে। যৌনতার ক্ষেত্রে সমাজের সাথে ব্যক্তির নৈতিকতার মানদণ্ড যখন মিলছে না তখনই দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। এবং এই দ্বন্দ্বে যৌনতা বিষয়ক সমাজের প্রচলিত ধারণা এবং তার পক্ষে গোষ্ঠীবদ্ধ অবস্থান সব সময়ই ব্যক্তিকে পরাজিত করে যাচ্ছে।

 সৌজন্যে: দিলশানা পারুল # শুদ্ধস্বর