Logo

মোমেনশাহী : একটি গৌরবোউজ্জল শহরের নাম-সামছুদ্দিন আহমেদ

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০
  • শেয়ার করুন

উপ-মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর জেলারূপে অভিহিত। এই জেলার প্রধান শহর ময়মনসিংহ পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর শহর ধন-ধান্নে পুষ্পাকীর্ণ  সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলীন, নদ-নদীন হাওর-পর্বত-বনানী পরিবৃত ময়মনসিংহ জেলা পাক-ভারতের অন্যতম। এ বছর এই ময়মনসিংহ পৌরসভার শতবর্ষ পূর্ণ হলো। আজ আমরা আমাদের এই গৌরব মন্ডিত পৌরসভার শত বার্ষিকী উৎসব উদযাপন কোরছি।

ময়মনসিংহ শহরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদ মহাপর্বত হিমালয়ের মানস সরোবর হতে নির্গত হয়ে আসাম ও পূর্ব-বাংলার ময়মনসিংহ শহরের উপকণ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুদূর দক্ষিণে পূর্ব বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। মনে হয় যেন এই মহা নদ ব্রহ্মপুত্র ময়মনসিহ শহরকে শত্রæর কবল থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত প্রহরা দিচ্ছে প্রতিহারী রূপে। ব্রহ্মপুত্র-নদের তীরে কাছারী সংলগ্ন উষর বালুকা স্তুপের উপর হজরত বুড়োপীর সাহেবের দরগাহ্ শরীফ। শহরবাসীদেরকে আশঙ্কিত বিপদ থেকে মুক্তি বিদার জন্য যুগ যুগ ধরে যেন এই তাপস মহাপুরুষ আধ্যাত্মিক ধ্যানে নিমগ্ন। ময়মনসিংহ শহরের পৌর এলাকার আয়তন দুই দশমিক চৌদ্দ বর্গ মাইল। বিগত আদম শুমারীর সংখ্যানুপাতে এই শহরের পৌর এলাকার লোক সংখ্যাছিল তিপান্ন হাজার। এখন মনে হয়, এই সংখ্যা ক্রমান্নয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে প্রায় আশি হাজারে দাঁড়িয়েছে। এবং সে তুলনায় শহরের কলেবরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু পৌর অঞ্চল বিস্তৃতি সাপেক্ষ। পৌরসভার বর্তমান আয়অন্যুন দশ লক্ষ টাকা। পৌর বিভাগের সাত সতাধিক বৈহ্যতিক আলোকমারায় সুসজ্জিত। এই ময়মনসিংহ শহর সম্পর্কে কিছু বোলতে গেলে তার পুরানো গৌরবময় ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে সর্বসমক্ষে তুলে না ধরলে বর্ণনা অসম্পুর্ণই থেকে যাবে। কেমন কোরে আলপিসিংহ পরগণার নাসিরাবাদ শহরটি ময়মনসিংহে পরিনত হলো ? এ সম্পর্কে বোলতে গেলে, এই শহরের দশ মাইল দূরে অবস্থিত মুক্তাগাছা উপশহর প্রসঙ্গে ও দুচার কথা বোলতেই হয়। আমি সেই ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায়েকে যথটা সম্ভব সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

দার্শনিক সুপন্ডিত ন্যায়দর্শনশাস্ত্রের অমূল্যরতœ কুসুমাঞ্জলী প্রণেতা শ্রী উদায়ানাচার্ষের পরবর্তী পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য মযমনসিংহ তথা মুক্তাগাছা রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। সুদর্শন সুকান্তিসম্পন্ন  বুদ্ধিমান যুবক শ্রীকৃষ্ণ আচার্য সুবেহ্ বাঙলার তদানিন্তন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় সতরশো চাঁর খ্রিষ্টাব্দে বাঙলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে গমন করেন। পুঠিয়া রাজবংশের আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুর এবং নাটোর রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা  রঘুনন্দন রায়ের সহায়তায় মুর্শিদকুলি খাঁর কৃপা অর্জন করেন।

আলেপশাহী পরগণার অপভ্রংশ আলাপসিং পরগণা। আইন-ই-আকবরীতে আলেপশাহী কে মোমেনশাহী নামে উল্লেখ করা হয়েছে। মোঘল সূর্য্য-সম্রাট আকবর শাহ্ রাজত্বকালে মোঘলমারীর যুদ্ধের পর বাঙলার বারোজন ভূম্যাধিকারী কিছুদিনের জন্য নিজ নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ময়মনসিংহ জেলার জঙ্গলবাড়ীর  দেওয়ানবংশের  আদিপুরুষ নবাব ঈশা খাঁ তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রন্য। এই স্বাধীনচেতা বীর পুরুষ মদন-ই-আলী উপাধী গ্রহণ কোরে বাইশটি পরগণায় নিজ অধিকার ও আধিপত্য বিস্তার কোরেছিলেন। এই বাইশটি পরগণার মধ্য তিনটি পরগণার নাম ছিল যথাক্রমে আলেপশাহী, মোমেনশাহী ও হোসেনশাহী ।

নবাব ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর কালক্রমে এই তিনটি পরগণা মিলে এলাকা হয়ে যায় এবং সতরশো পঁচিশ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর এই বিশাল রাজ্য বিভিন্ন জমিদারীতে বিভক্ত হয়। ঐ সময় শ্রীকৃষ্ণ আচার্য মুর্শিদাবাদ রাজধানীতে ছিলেন এবং দরবার তাঁর প্রতিপত্তিও ছিল। যেহেতু নবাব তাঁকে খুব স্নেহ কোরতেন। উক্ত সতরশো পঁচিশ খ্রিষ্টাব্দে নবাব বাহাদুর তাঁর কানুন গো গঙ্গারাম রায়কে জমিদারীর তদন্ত সংক্রান্ত ব্যাপারে আলেপশাহী পরগনাতে পাঠালেন। সুচতœর শ্রীকৃষ্ণ আচার্য উত্তম উৎকোচ প্রধান করে কানুন গো  মহাশয়কে হাত করে ফেললেন। কানুন গো গঙ্গরাম রায় নবাব দরবারে রিপোর্ট দিলেন ; আলেপশাহী পরগনা অরন্য সংকুল, অনুর্বর পার্তব্য ভূমি। এখানকার আদিবাসীগন অত্যন্ত দুর্দান্ত ও দরিদ্র। নবাব কর্মচারী দ্বারা এখানকার রাজস্ব আদায় করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে নবাব সুজাউদ্দিন ও মির্জা মহম্মদ আলীর মধ্যে বাঙলার মসনদ নিয়ে বিবাদ বাধে। এই সুযোগে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য নবাব সুজাউদ্দিনের সংগে বিশ্বাস ঘাতকতা কোরে মির্জা মহম্মদ আলীর গুপ্তচরের কাজে লিপ্ত হলেন। অবশেষে ইতিহাসের পট পরিবর্তন হলো অনেক। মীর্জা মহম্মদ আলী আলীবর্দী খাঁ নাম ধারণ কোরে বাঙলার মসনদে উপবেশন কোরলেন।

আঙ্গুলে ফুলে কলাগাছ হলো। শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের কৃত উপকার স্বরূপ আলীবর্দী খাঁ তাঁর প্রার্থনা অনুসারে আলেপশাহী পরগনার জমিদারী তাঁর নামে বন্দোবস্ত করেছিলেন। সতরশো সাতাইস খ্রিস্টাব্দে জমিদারী বন্দোবস্ত নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য বাড়ী ফিরলেন। ওই সময় মুক্তারাম কর্মকার তাঁর এক দরিদ্র প্রজা পিতলের এক সুবৃহৎ সুন্দর গাছা অর্থাৎ দীপাধার তৈরি করে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য কে নজর প্রদান কোরে স্বীয় ভূস্বামীকে  অভিনন্দন জ্ঞাপন করলো। রাজভক্ত প্রজা মুক্তারামের নামানুসারে তাঁর জমিদার বাড়ীর গ্রামের নাম রাখলেন মুক্তাগাছা। সতরশো সাতাশি খ্রিস্টাব্দে রাজ্য শাসনের সুবিধার জন্য মযমনসিংহ জিলা প্রতিষ্ঠিত হয়।

কালেক্টার মিষ্টার বটন এই জেলার প্রথম কালেক্টার নিযুক্ত হন। তখন কালেক্টার অফিসের কোনো নির্দিষ্ট স্থান ছিলনা। অধিকাংশ সময় ময়মনসিংহ শহরের প্রায় সাত আট মাইল দূরে অবস্থিত বেগুনবাড়ীর ইংরেজ কোম্পনীর কুঠিতে কালেক্টারের অফিস বসতো। শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের চতুর্থ অর্থাৎ কনিষ্ঠ পূত্র রঘুনন্দন অত্যন্ত ধার্মিক এবং ন্যায়পরায়ণ জমিদার ছিলেন। সতরশো উনসত্তর খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাঙলা এগারোশো ছিয়াত্তর সনে যে মহামারী দুর্ভিক্ষ হয় এবং যে দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্তন্তর নামে ইতিহাস বিশ্রæত ওই সময় রঘুনন্দন মুক্ত হস্তে দান করে লক্ষ লক্ষ নর নারীর জীবন রক্ষা করেছিলেন। এই পূন্যাত্মা জমিদার রঘুনন্দনই তাঁর জমিদারীর মধ্যে সতরশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দে নাসিরাবাদ শহর” স্থাপন করেন।

রঘুনন্দন অপুত্রক ছিলেন। দত্তকপূত্র রূপে গ্রহণ কোরলেন শ্রীগৌরীকান্ত.ক এবং সেই অবধি এই রাজবংশে দত্তকপূত্রগণই পুরুষানুক্রমে জমিদারী শাসন কোরেছেন। আটারশো সাতান্ন খ্রিস্টাব্দে সমগ্র পাক ভারত উপমহাদেশে ঈষ্ট্র ইÐিয়া কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে যখন এদেশের বীর সিপাহীরা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে তখন সেই আন্দোলনের জোয়ার ময়মনসিংহের বুকেও এসে লেগেছিল। ওই সময় এই আচার্য রাজবংশের রাণী লক্ষীদেবী ময়মনসিংহের বহু ইংরেজ পরিবারকে মুক্তাগাছা রাজবাড়ীতে গোপনে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই সময় ময়মনসিংহের কালেক্টার ছিলেন মিষ্ট্রার এ, ডি, এইচ. স্কেল। কুমার শ্রী সূর্যকান্ত আচার্য কে রাণী লক্ষী দেবী দত্তক পুত্ররূপ গ্রহণ করে আটারশো তেষট্টী খ্রিষ্টাব্দে পরলোক গমন কোরলেন। জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য রাজশাহী জেলার কলম গ্রাম নিবাসী ভবেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তীর প্রথমা কন্যা সুন্দরী বুদ্ধিমতী রাজ রাজেশ্বরী দেবীকে পত্মী রূপে গ্রহণ করেন। লক্ষী দেবীর মৃত্যুর পর রাজ বংশের জমিদারী কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে চলে যায়। কাল ক্রমে নাসিরাবাদ শহর মোমেনশাহী শহরে রূপন্তরিত হয়। এই মোমেনশাহীকে ইংরেজ কালেক্টারের কলমে লিখিত হয় ময়মনসিংহ (ময়মনসিংহ) সূর্যকান্ত সাবালক হয়ে জমিদারী ফিরে পেলেন আটারোশো সাতষট্টী খ্রিস্টাব্দে। সূর্যকান্ত প্রথম যৌবনে অতি চরিত্রহীন এবং বেহিসাবী যুবক ছিলেন। নারী সঙ্গীত ও সুরানিয়ে দরবার মশগুল করে রাখতেন। এজন্য তাঁর একজন বন্ধু তাঁকে উপহাস বোলেছিলেন গরীব যদি কম্বলে বসে, সে নিতম্বচুলকায় আর হাসে। এরপর থেকে সূর্যকান্তের চেতনা হয় এবং জীবনের গতিধারা ফিরে যায়। সূর্যকান্ত জমিদারী পান আটারোশো সাতষট্টী খ্রিস্টাব্দে। আর ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যালিটি স্থাপিত হয় আটারোশো উনসত্তর খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যালির্টির চেয়ারম্যান মিষ্টার আর, পোট এবং প্রথম নন অফিসিয়্যাল চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন শ্রীচন্দ্রকান্ত ঘোষ আটারোশো ছিয়াসী খ্রিস্টাব্দে। তারপর উনিশ শো চল্লিশ এবং পয়তাল্লিশ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্যর পৌত্র অর্থাৎ মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর মধ্যম পুত্র কুমার সুধাংশু আচার্য চৌধুরী চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

ময়মনসিংহ পৌরসভার প্রথম মুসলিম নন অফিসিয়েল চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন মহুরম খাঁন বাহাদুর গিয়াসউদ্দিন পাঠান উন্নিশশো আটচল্লিশ খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ পৌরসভার প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান রূপে অধির্ষ্ঠিত হয়েছিলেন মিষ্ঠার ও, এস, ষ্ট্রাক্ এবং প্রথম বাঙালী হিন্দু ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আটারোশো চুরাশি খ্রিস্টাব্দে স্বর্গীয় শ্রীচন্দ্রকান্ত ঘোষ মহোদয়। এই পৌরসভার সর্বপ্রথম  মুসলমান ভাইস চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন উনিশ শো বার খ্রিস্টাব্দে মৌলভী সাহেব আলী। পরে তিনি খাঁন সাহেব উপাধী প্রাপ্ত হয়ে দ্বিতীয় বারও  এই পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ময়মনসিংহ পৌরসভার সর্ব শেষ হিন্দু ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন বাবু বিনয় চন্দ্র রায়। তিনি ইংরেজি উনিশ শো আটচল্লিশ সালের জুন মাসে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ময়মনসিংহ পৌরসভায় এ যাবত পয়ত্রিশ জন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন উনিশ শো উনসত্তর সনের জানুয়ারী মাসে এই ময়মনসিংহ শহরের অধিবাসী এ্যাডভোকেট শামশুদ্দিন আহম্দে; এই প্রবন্ধের লেখঁক।

আপনি যদি ময়মনসিংহ শহরে কোনদিন না এসে থাকেন তবে একবার এসে দেখে যাবেন এ শহরটি আছে সুরম্য সার্কিট হাউস, ডাক বাংলা এবং সুন্দর সুন্দর আবাসিক হোটেল খাবার অসুবিধে হবেনা। দেখবেন আগের দিনের সেই জীর্ণ শীর্ণ শহর নেই। শহরে রূপের বাহার খুলেছে। শহরের সুপ্রশস্ত রাস্তাগুলো সিমেন্ট ও পিচ দিয়ে ঢালাই করা। পূর্বে এই শহরে ছিল জনগণের বাহন গরু ও ঘোড়ার গাড়ী। এখন ঐ স্থান দখল করেছে রিক্সা, বেবী ট্যাক্সি, ট্যাক্সি,মোটর বাস। প্রভাত ও সান্ধ্য ভ্রমণের জন্য পৌরসবার সৌজন্যে শহরের নানা স্থানে পার্কনির্মিত হয়েছে। পার্কগুলো নানান ফুলের কেয়ারীতে আকীর্ণ। যেমন ব্রহ্মপুত্রের  রিভার ভিউ ন্যাশন্যাল পার্ক” ও বিপিন পার্ক, জিল্লাহ্ লেডিজ পার্ক প্রভৃতি।

কোর্টকাচারীর দালানগুলোতেও রূপের লাবণি লেগেছে। পুরানো দালানগুলো সংস্কার করে এবং নোতুন নোতুন প্রাসাদোপম অট্রালিকা নির্মাণ কে অফিস আদালতের শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ কালেক্টরী অফিস, ফরেষ্ট অফিস, পুলিশ অফিস, ডিষ্ট্রিক্ট কাউন্সিলর অফিস, পুলিশ লাইনস, জেলখানা, হেড্ পোষ্ট অফিস, ফরেষ্ট অফিস, সি, এগু বি, অফিস, পাকিস্তান কাউন্সিল, ইউ, এস, আই, এস, পাঠাগার, মুসলিম ইনষ্টিটিউট, সার্কিট হাউস প্রভৃতি। যে শহরে দু একটি ব্যাঙ্ক ছাড়া কোনো ব্যাঙ্কই ছিল না ; সেখানে এখন কতো সুন্দর সুন্দর বিল্ডিংএ যে দেশী বিদেশী ব্যাঙ্ক গুলো কাজ কোরছে, তা ভাবতে অবাক লাগে। আযাদী উত্তরকালে শহরে কতো সুন্দর সুন্দর মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এই সব মসজিদগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা দর্শনীয় মসজিদ হলো ময়মনসিংহ কোতওয়ালী থানার কম্পাউন্ড সংলগ্ন সুউচ্চ গুম্বজ বিশিষ্ট জামে মসজিদ।

আপনি যদি ময়মনসিংহ যাদুঘর দেখতে চান, তবে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে এসে কাচারী মসজিদের নিকট রাস্তার মোড়টা ঘুরে সোজা করপোরেশান ষ্ট্রিট বরাবর এগিয়ে যান। আপনার হাতের ডানদিকে পড়বে শশীলজ। শশীলজের কথা পরে বোলছি। আপনি চলতে থাকুন। চলতে চলতে পথের বাঁদিকে পাবেন একটি পুরাতন বিল্ডিংবাড়ী বারান্দাওয়ালা। এটা হচ্ছে ময়মনসিংহ শহরের পৌর অফিস। এখন অফিসের কলেরব বৃদ্বি পেয়েছে। এই ষ্ট্রিটের সোজাসুজি করোনেশান ষ্ট্রিটের দক্ষিণে একবার মুখ ফিরান। দেখবেন একটি সুদৃশ্য ফুল বাগিছা সমন্বিত দোতলা সুরম্য অট্টালিকা। এইটি ময়মনসিংহ পৌরসভার নোতুন বিল্ডিং। এই বিল্ডিংটি তৈরি হয়েছে উনিশ শো চৌষট্টী সালের জানুয়ারী মাসে। ঢাকা বিভাগের ভূতপূর্ব কমিশনার জনাব গিয়াসউদ্দিন আহম্দে, এস, কিউ, এ সাহেব এই প্রসাদের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। এই নোতুন বিল্ডিং এ পৌরসভার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং সেক্রেটারীর অফিস, এছাড়া অন্যান্য দপ্তরও আছে। মিউনিসিপ্যাল অফিসের পরেই দেখতে পাবেন মোমেনশাহী যাদুঘর। এই যাদুঘরটি শহরের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু।

ময়মনসিংহ শহরে টাউন হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আটারোশো ছিয়াশি খ্রিস্টাব্দে। তখনকার দিনে ত্রিশ হাজার টাকা ব্যায় কোরে এই টাউন হল  নির্মাণ করেছিলেন। রাজা সূর্যকান্ত আচার্য। এই টাউন হলের সংগে তিনি একটি মূল্যবান পাঠাগারও সং-স্থাপন কোরেছিলেন। সত্য কথা বোলতে গেলে ময়মনসিংহ শহর সূর্যকান্ত আচার্য বাহাদুরের দানে সুসমৃদ্ধ। তিনি ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এককালীন সারে ছয় হাজার টাকা দান কোরেছিলেন। আটারোশো উন নব্বই কিংবা নব্বই খ্রিস্টাব্দে  সূর্যকান্তের পত্নী রাজ-রাজেশ্বরী দেবীর স্মৃতি রক্ষার্থে সূর্যকান্ত আচার্য এক লক্ষ সারে বারো হাজার ব্যয় কোরে রাজ রাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস নামের পানির কল স্থাপন কোরেছিলেন।

কথিত আছে ; রাণী রাজ-রাজেশ্বরী তৃষ্ণার্ত অবস্থায় প্রান ত্যাগ কোরেছিলেন। রোগ, বৃদ্ধির আশঙ্কায় চিকিৎসা করা রাণীকে জলপান কোরতে নিষিদ্ধ দিয়ে ছিলেন। আটারোশো অষ্ট্রাশি খ্রিস্টাব্দে গঙ্গাসাগরের পথে ভাগীরথী নদীর বক্ষে রাজ রাজেশ্বরী প্রানত্যাগ কোরেন। মৃত পত্মীর নামে পানির কল স্থাপন কোরে সূর্যকান্ত তার স্বর্গগতা স্ত্রীর বিরহ শোক কিঞ্চিত লাঘব কোরতে পেরেছিলেন। শহরের জলনিস্কাষণের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দান করেছিলেন। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেলওয়ে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য দু লক্ষ টাকা মূল্যের জমিদান কোরেছিলেন কোম্পানীকে। প্রতিবৎসর শহর জুবলী উৎসবের জন্য তিনি আট বিঘা জমি দান কোরেছিলেন এবং পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা নগদ ব্যয় কোরে ভূতপূর্ব ভারত সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড এবং তাঁর পত্মী সম্রাজ্ঞী আলেকজান্ডার তৈলচিত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। এই স্থানের নামকরণ কোরলেন আলেকজান্দ্রার ক্যাশ্ল এবং শহরের মধ্যে ইহা উল্লেখ যোগ্যভাবে দর্শনীয়। এখন এই আলেকজান্দ্রা ক্যাশল রূপান্তরিত হয়েছে টিচার্স ট্রেনীং কলেজ।

সূর্যকান্ত মহারাজার সুযোগ্য পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামানুসারে শহরের বুকে মনোরম শশীলজ (আবাসিক রাজপ্রসাদ) প্রতিষ্ঠিত করেন। এই শশীলজ কালক্রমে মহিলা ট্রেনীং কলেজে প্রবর্তিত হয়েছে। এইসব মহামূল্যে দর্শনীয় প্রাসাদ অবলোকন কোরে চিত্ত সার্থক কোরতে পূর্বে কতো দেশ বিদেশ  থেকে ভ্রমণকারীগণ আসতেন এই শহরে। এই সব দর্শনীয় প্রাসাদের প্রতিষ্ঠাতা লক্মীর বর-পুত্র সূর্যকান্ত আচার্যকে ভারত সম্রাট আঠারো শো সাতাত্তর খ্রিস্টাব্দে প্রথমে রায় বাহাদুর এবং পরে আঠারোশো আশি খ্রিস্টাব্দে রাজা উপাধীতে ভূষিত করেন। রাজা সূর্যকান্ত আচার্য মহারাজ উপাধী প্রাপ্ত হন আঠারোশো সাতানব্বই খ্রিস্টাব্দে লেফ্টন্যণ্ট গভর্ণর স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকিঞ্জির দরাবার থেকে। মহারাজা সূর্যকান্ত হস্তী ও ব্যাঘ্র শিকারের প্রতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিলেন। তারই সৌজন্যে এই ময়মনসিংহ শহরের বুকে দেশ বিদেশের বহু সুপ্রসিদ্ধ শিকারী এবং মহামান্য অতিথিগণ আগমন কোরেছিলেন। ইংল্যান্ডের প্রসিদ্ধ শিকারী স্যার স্যামুয়েল  বেকার মহারাজার প্রাসাদে অবস্থান কোরে এখান থেকেই হতি ও বাঘ শিকারে গমন কোরেছিলেন পার্বত্য অঞ্চলে। মহারাজা সূর্যকান্তের আতিথ্য স্বীরোকের বিভিন্ন সময়ে এই শহরে স্বনামধন্য অতিথিগণ আগমন কোরেছিলেন। তঁদের মধ্যে ভারতের তদানিন্তন প্রধান সেনাপতি স্যার জর্জ হোয়াইট ভূতপূর্ব প্রধান বিচারপতি স্যার ক্রোমার প্যাথারাম ও স্যার ফ্রান্সিস ম্যলকম, রাশিয়ার যুবরাজ গ্র্যাÐ ডিউক মরিস, এবং ভারতের ভূতপূর্ব বড়লাট লর্ডকার্জন।

মুসলিম বাঙলার গৌরব মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাতা ঢাকার নবাব স্যার সলিম উল্যা  বাহাদুর (জি, সি, আই, ই, কে, সি, এস, আই,) প্রথম ডেপটি ম্যাজিষ্ট্রেট রূপে সরকারী চাকুরী গ্রহণ কোরে ময়মনসিংহ শহরে শুভাগমন করেন। তাঁর সংগে মহারাজা সূর্যকান্তের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। সে জন্য উনিশশো তেরো খ্রিস্টাব্দে নবাব স্যার সলিমউল্যা বাহাদুরের সহায়তায় মহারাজা সূর্যকান্তের পালক পুত্র মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। আজকের যুগের জনপ্রিয় ক্রিকেট খেলা ময়মনসিংহ শহরে সর্ব প্রথম প্রবর্তন কোরেন মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি,এ, ও এল, এল, বি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বদেশে প্রতোবর্তন করেন। উনিশ শো কুড়ি খ্রিস্টাব্দে বাঙলার গভর্ণর লর্ড রোনাল্ড সে তাঁর ঢাকার দরবারে রাজা শশকিান্তকে মহারাজা উপাধী দান করেন। গভর্ণর তাঁর সনদে বলেন ;

On 1913 my Predeoessor Lord Charmaichel at a similar Darbar handed over to you the sanad of the title of “Raj Bahadur” It now gives me great pleasure to hand over to you the sanad of the high title of Maharaj May You live long to enjoy the title and to convey on the high traditions of your family.

গভর্ণর লর্ড রোনাল্ডসে মহারাজা শশীকান্তর আতিথ্য গ্রহণ কোরে ময়মনসিংহ শহরে আগমন করেন। তাঁর পূর্বে শশীকান্তের পিতা মহারাজা সূর্যকান্তের আমন্ত্রণে তেরোশো সতর বঙ্গাব্দের এক বসন্ত ঋতুতে আয়ারল্যাণ্ড ভূতপূর্ব লর্ড ও লেডি উইম্ বোরন্ এবং স্পেনের ডিউক-অব-পেনা সেন্ডা ময়মনসিংহ পার্বত্য অঞ্চলে শিকারের উদ্দেশ্যে মিশরের যুবরাজ ইউসুফ কামাল পাশা এই শহরে শুভাগমন করে শশীলজ রাজ প্রাসাদে সম্মানীয় মেহমান রূপে অবস্থান করেন।

পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম বৃহং চিকিৎসা ভবন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রমনীর ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। পূর্বে এই কলেজ হাসপাতালের নাম ছিল সূর্যকান্ত হাসপাতাল। মহারাজা শশীকান্ত বাহাদুর একলক্ষ দুহাজার টাকা ব্যয় কোরে তাঁর পিতা সূর্যকান্তের স্মৃতি রক্ষার্থে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত কোরেন। বর্তমান সরকার নোতুন কলেজ হাসপাতালটি শহরের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে ত্রিশাল রোডের পাশে নির্মাণ কোরেছেন। এই শহরের সেণ্টমাইকেল হাসপাতাল ও সুপ্রসিদ্ধ।

শিক্ষাদীক্ষার উন্নতিকল্পে ময়মনসিংহ কোনোকালেই প্রদেশের অন্যান্য জেলা শহর থেকে পশ্চতে থাকেনি। শহরের বিদ্যাময়ী স্কুল, এডওয়ার্ড স্কুল, মুক ও বধির বিদ্যালয়,জিলা স্কুলমৃত্যুঞ্জয় হাই স্কুল, সির্টি কলেজিয়েট স্কুল, মুসলিম হাই স্কুল, মুসলিম গার্লস হাই স্কুল, মহকালী পাঠশালা, উপেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, নাছিরাবাদ হাই স্কুল, নাছিরাবাদ গার্লস হাই স্কুল, রেবেয়া মেমোরিয়্যাল রেসিডেন্সিয়াল গার্লস হাই স্কুল তাঁর উজ্জলতম স্বাক্ষর বহন কোরেছে। এই শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চারটি ডিগ্রি কলেজ। যথা আনন্দ মোহন কলেজ, আখতারুজ্জামান মেমোরিয়্যাল কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ এবং মুনিমুন্নেছা গার্লস কলেজ। এই চারটি কলেজের মধ্যে সুপ্রাচীন ও দর্শনীয় কলেজ হচ্ছে আনন্দ মোহন কলেজ। বাঙলার বৃহত্তর ও প্রাচীনতম সুপ্রসিদ্ধ কলেজগুলির অন্যতম এই আনন্দ মোহন কলেজ। এই কলেজের  প্রতিষ্ঠাতা হলেন এই জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার জয়সিদ্ধি গ্রাম নির্বাসী র‌্যাঙরার স্বর্গীয় আনন্দ মোহন বসু মহোদয়। পূর্ব বাঙলার এই প্রথম শ্রেণীর কলেজটির প্রতিষ্ঠাকল্পে মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী এককালীন পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা আনন্দ মোহন বসুর হস্তে প্রদান করেছিলেন। এখন এই আনন্দ মোহন কলেজটি সরকারী পর্যায় উন্নীত হয়েছে। মযমনসিংহ শহর আধুনিক-কালে পাকিস্তানের শিক্ষা কেন্দ্রগুলির অন্যতম। শহর ছাড়িয়ে মাত্র দু মাইল দূরে উন্নুক্ত সুবিস্তীর্ণ প্রান্তরে অবস্থিত পাকিস্তানে সর্ব প্রথম সুবৃহৎ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট” ও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

শিক্ষার পরেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ক্রীড়া কৌতুক এবং আমোদ প্রমোদের সর্বতোভাবে প্রয়োজন। এই প্রয়োজন মেটাতে শহরে বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি বৎসর এইসব ক্রীড়া সংস্থা প্রতিযোগীতামূলক খেলাধুলার প্রদশনী কোরে থাকেন। সেজন্য শহরে ক্রীড়াপ্রতিযোগী অনেকগুলি সুপ্রশস্ত মাঠও রয়েছে। তাদের মধ্যে ময়মনসিংহ ষ্টেডিয়াম এবং সার্কিট হাউস ময়দান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এইসব খেলার মাঠে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রসিদ্ধ টিমগুলো এসে ফুটবল, ক্রিকেট প্রভৃতি খেলা খেলে যায়। এই ধরণের ক্রীড়া বাতিরোক শহরের বিভিন্ন ক্লাবে, টেনিস, ভলি, হাডুডু এবং ইনডোর গেমেরও সুব্যবস্থা রয়েছে। ক্রীড়া সংস্থাগুলোর মধ্যে মোহামেডান স্পোঠিং ক্লাব  পন্ডিতপাড়া ক্লাব এবং ষ্টেশন কোয়াটার ক্লাব প্রাচীন।

আধুনিক যুগ আমোদ উপভোগের অন্যতম বহন হচ্ছে সিনেমা। পূর্বে এই শহরে অলকা ও ছায়াবাণী নামে দুটো সিনেমা হল ছিল। বর্তমানে সংখ্যা তিনটে এবং আরো একটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠার পথে। এই তিনটি প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে অধুনা নির্মিত পুরবী প্রেক্ষাগ্রহটি প্রদেশের প্রথম শ্রেণী সুবৃহৎ ও আধুনিকতম ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম এবং ইহা সুদর্শনযোগ্য। এই সুদর্শনযোগ্য পূরবী প্রেক্ষাগ্রহের সর্ব্ব স্বাত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠাতা এই শহরের অধিবাসী ইনকাম ট্যাক্স প্রাকটিশনার জনাব জমমরুদ্দিন আহম্দে। তিনি তাঁর একক প্রচেষ্টায় এই সুরম্য প্রেক্ষাগ্রহটি নির্মাণ করেন। শহরের দর্শনীয় প্রাসাদগুলির মধ্যে ইহা অন্যতম। ছায়াবাণী, অলকা প্রেক্ষাগৃহদ্বয় অতীব সুপ্রাচীন।  ছায়াবাণী প্রেক্ষাগৃহের বুনিয়াদীবিল্ডিং অমরাবতী নাট্য মন্দিরের বিশেষ এক কমিটি দ্বারা পরিচালিত। পূর্ব এই নাট্যমন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল মহারাজা শশীকান্ত, রামগোপালপুরের জমিদার এবং অন্যান্য জমিদারগণের সমবেত প্রচষ্টায় কালক্রমে এই  শহর নিবাসী চারুঘোষ মহাশয় কমিটির নিকট হতে ভাড়া নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে রূপান্তরিত কোরলেন এই নাট্যমন্দিরটিকে। প্রেক্ষাগৃহের নামকরন কোরলেন লক্ষী নারায়ণ পিকচার প্যালেস। চারুঘোষ  ক্ষিতিশ বাবু লক্ষী নারায়ণ পিকচার প্যালেস নামটি পরিবর্তন কোরে ছায়াবাণী নাম রাখলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই আমরাবতী নাট্যমন্দি কমিটির কাছ থেকে বছর বছর টাকা দিয়ে ভাড়া হিসেবে নিতেন ছায়াছবি প্রদর্শনের জন্য। তখন কোলকাতায় এই নামে ছায়াবাণী ডিষ্ট্রীবিউশানও প্রতিষ্ঠিত হয়।

ক্ষিতিশ বাবু পাকিস্তানে কয়েক বছর থেকে এই প্রেক্ষাগৃহটি পরিচালনা করেন। পরে তিনি সপরিবারে হিন্দুস্থানে চলে গেলেন। ছায়াবাণীর ভাড়া এবং মেসিনারীর ইত্যাদির স্বত্ব সব বিক্রি কোরে গেলেন সৈয়দ মাহাবুব হোসেনকে। সেই অবধি জনাব সৈয়দ মাহাবুব হোসেন এই ছায়াবাণী প্রেক্ষাগৃহের পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছেন। তিনি আমরবতী নাট্যমন্দির কমিটির সম্মতিক্রমে ছায়াবাণী প্রেক্ষাগৃহের আদি অট্টালিকার সংস্কার সাধন কোরে প্রদেশের অন্যতম আধুনিক প্রেক্ষাগৃহরূপে রূপান্তরিত করেন। ছায়বাণী বর্তমান প্রেক্ষাগৃহটি উল্লেখযোগ্যরূপে দর্শনীয়। এই প্রেক্ষাগৃহটি সৈয়দ মাহাবুব হোসেনের পিতা পাকিস্তানের ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মেছবাহ্ উদ্দিন সাহবের নামে ভাড়াটিয়া স্বত্বরূপে প্রতিষ্ঠিত। অলকা সিনেমা হলের মূল স্বতাধিকারী এই জেলার পয়ারী গ্রামের জমিদার মহোদয় বাবু নটুকর এবং মরহুম জনাব সৈয়দ মেছবাহ্ উদ্দিন হোসেন যৌথভাবে ভাড়াটিয়া স্বত্বে স্বত্ববান। অলকা প্রেক্ষাগৃহটি শহরের প্রথম রাস্তার পাশ্বেই প্রতিষ্ঠিত এবং ইহা সম্পূর্ণ সুচারুরূপে পুনঃ নির্মাণ সাপেক্ষে দুর দুরান্তর থেকে নাট্য অপেরা (যাত্রাপাট) এবং সার্কাস পার্টি এসেও শহরবাসীকে আনন্দ বিতরণ করে থাকে। প্রতি বছরে শীত মৌসুমে শহরে শিল্পকলা ও কৃষির প্রদর্শনী উৎসবও হয়ে থাকে। পূর্বে এই শহরে অমরাবতী নাঠ্য মন্দিরের’ রঙ্গমঞ্চ পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী পাহাড়ী সান্যাল ছবি বিশ্বাস এবং অভিনেত্রী রাণীবালা, সরযুবালা প্রভূতি অনেকেই অভিনয় করে গেছেন। এখন এই নাট্য মন্দিরে রঙ্গমঞ্চ এবং টাউন হলে ঘুণীয়ামান রঙ্গমঞ্চ শহরের বিভিন্ন সংস্থার প্রচেষ্ঠার এ্যামেচার অভিনেতা দ্বারা নাটক অভিনীত হয়ে থাকে। এই ময়মনসিংহ শহরে কতো দেশ বিদেশের নামজাদা সংগীত শিল্পীগণ তাঁদের সংগীত পরিবেশের কোরে গেছেন, সে সব আজ বিস্মৃতির অস্তাচলে। তাঁদের মধ্যে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ এনায়েত খাঁ, বিলায়েত আলী খাঁর নাম বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। আযাদী উত্তরকালের পাকিস্তানের প্রখাত সংগীত শিল্পীগণ তাদের কণ্ঠের সুর দান করে শহরবাসীকে মুগ্ধ করেছেন। তাঁদের ওস্তাদ নাজাকাত খাঁ পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠ শিল্পী এবং ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী ও ভাটিয়ালী প্রভ’তি পল্লী সংগীতের একনিষ্ঠ সেবক আব্বাসউদ্দিন, আব্দুল আলীম, নীনা হামিদ, ফেরদৌস রহমান, নজরুল সঙ্গীতজ্ঞা ফিরোজা বেগম। এই শহরের বিশিষ্ট ওস্তাদ বিপিন দাস, বিজয় ভট্যাচার্য এবং ভীষ্মদেব ভট্যাচার্যের নামও উল্লেখযোগ্য।

মোমেনশাহী এককালে ইংরেজি সাহেবদের উচ্চরণে ময়মনসিংহ (Mymensingh) নাম ধারণ কোরলো। এই নামের ও একটা বিশেষত্ব আছে Mymensingh । অথ্যাৎ আমার মানুষগুলো গান করে। এই নামে যথার্থতা এককালে ছিল এবং আজো সেগুলো কালের পাতায় চির-ভাস্বর হয়ে রয়েছে। এই ময়মনসিংহে ছিল গোলাভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ। মানুষ সামান্য পরিশ্রম কোরেই রাজার হালে খেতে পরতে পারতো। আর মনের আনন্দে গান গাইতো। তাইতো ময়মনসিংহ গীতিকা আজো পৃথিবীর সঙ্গীতকাব্যকে চির সমৃদ্ধ কোরে রেখেছে। ময়মনসিংহের মানুষ আজো মনের আনন্দে বাউল, মুর্শিদী, জারি, ভাটিয়ালী ও ঘাটুগান গায়। কিন্তু আগের দিনের গানের মতোন সে দরদ যেন আর এখন তাদের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় না।

শহরে বেশ কয়েকটি সংষ্কৃতি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে ময়মনসিংহ একাডেমী অব ফাইন আর্টস অর্থ্যাৎ সংক্ষেপে MAFA (মাফা)ও নাম উল্লেখ্যযোগ্য মাফা এখন নাম পরিবর্তন কোরে নজরুল একাডেমী নাম ধারণ কোরেছে। শিল্প ও সাহিত্য ময়মনসিংহের শহর প্রদেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় কোনো অংশেই নগন্য নয়। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর মেঘনাথ সাহা এই শহরের আনন্দ মোহন কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। পাকিস্তানের তথা পৃথিবীর অন্যতম প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন এই ময়মনসিংহ জেলারই সুসন্তান এবং এই শহরে থেকেই তিনি অধ্যায়ন করেন। মৃ শিল্প নির্মাণে এই শহরের বাসিন্দা শিল্পী আব্দুর রসিদ সুনাম অর্জন কোরেছেন। কবি সাহিত্যিকদের লীলাক্ষেত্র এই ময়মনসিংহ শহর। উনিশ শো উনত্রিশ খৃষ্টাব্দে  ব্রতচারী, নৃত্যের প্রবর্তক সাহিত্যিক শুরুসদয় দত্ত, আই সি এস মহোদয় এই জেলার প্রশাসক ছিলেন। তাঁর পরবর্তীকালে সুপ্রসিদ্ধ সাহিত্যিক বরকতউল্লাহ সাহেব এই জেলার এ্যাডিশনাল ডিষ্ট্রিক ম্যাষ্ট্রিট ছিলেন। তাঁরা উভয়েই এই শহরে বাসকোরে নিরলস সাহিত্য সাধনা কোরে গেছেন।

সুপ্রসিদ্ধ কথা সাহিত্যিক ও নাট্যকার জরাসদ্ধ এই শহরের সেন্ট্রাল জেলখানার ডেপুটি জেলার ছিলেন। তাঁর এই শহরের অবস্থিতিকালে তিনি অমরাবতী নাট্যমঞ্চে থিয়েটার অভিনয় করেন এবং তাঁর লৌহকপাট উপন্যাসটি ময়মনসিংহ জেলখানারই অধিকাংশ উপাদানে সমৃদ্ধ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই ময়মনসিংহ শহরের দশ মাইল দূওর কাজীর সিমলা গ্রামে বাস করিয়া দরিরামপুর হাই স্কুলে অধ্যায়ন করেন এবং তাঁর কাব্যেও প্রধান অংশের স্ফুরণ হয় এই ময়মনসিংহের জলবায়ুতে পরিপুষ্ট হয়ে। মহাকবি কায়কোবাদ কবি গোলাম মোস্তফা কবি জসিমউদ্দিন, কবি সুফিয়া কামাল, প্রভাবতী দেবী স্বরস্বতী, ডক্টর শহীদুল্লাহ, সৈয়দ মুজতবা আলী, কবি হাবীবুর রহমান শুভ পদাপর্ণ কোওর ময়মনসিংহের সাহিত্যের পাতাকে চির-ভাস্বর কোরে রেখে গেছেন।

এই জেলার কবি সাহিত্যেকগণও ময়মনসিংহ শহরের কাব্য-সাহিত্যকে সাহিত্য সমাজে চির পরিচিতি কোরে গৌরববর্ধন কোরেছেন। তাঁরা হলেন সুসাহিত্যিক প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ অনুধনালুপ্ত ইত্তেহাদ সম্পাদক আব্দুল মনসুর আহমেদ ভূতপূর্ব আজাদ সম্পাদক এবং বর্তমান দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক গোপেশ দত্ত, সুসাহিত্যক সৈয়দ আব্দুস সুলতান, আজহারুল ইসলাম, মোফখখারুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, মীর আবুল খায়ের, সিরাজুউদ্দিন কাশেমপুরী, নয়া যমানা সম্পাদক মুহিউদ্দিন খাঁ, কবি রওশন ইজদানী, কবি শেখর জহির-বিন-কদ্দুস খান সাহেব আব্দুল্লাহ, অধ্যাপক আজিজুল হক চৌধুরী, তাহেরুদ্দিন মল্লিক, কবি আশুতোষ পাল, আশীষ কুমার লোহ, অধ্যাপক যতীন্দ্র সরকার, খালেকদাদ চৌধুরী, কবি খলিলুর রহমান এবং আলহাজ্ব আলেক উদ্দিন শ্রীপরীর নাম উল্লেখযোগ্য। বহিরাগত কবি সাহিত্যিক মধ্যে ছান্দাসক কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক কবি মোজহারুল ইসলাম, ডাক্তার অবনী নন্দি, কাজী মহম্মদ মহসীন, এ,কে মকবুল আহম্মদ, অধ্যাপক মাহাবুবুল আলম এবং অধ্যাপক গোলাম মোশের্দের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

স্বর্গীয় মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য শিকারে কাহিনীৎ নাম গ্রন্থ লিখে সে যুগে খ্যাতি অর্জন কোরেছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় ‌’শহরে নির্মল্য’ নামক একখানি সাহিত্য মাসিক পত্রিকাও প্রকাশিত হতো।

ফটোগ্রাফি : শেখ অনিন্দ্যমিন্টু

সামছুদ্দিন আহমেদ, এ্যাডভোকেট, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান,ময়মনসিংহ পৌরসভা

তথ্যসূত্র : ময়মনসিংহ পৌরসভার শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকা থেকে