Logo

মোহনগঞ্জের লোকসাহিত্য

অনিন্দ্য বাংলা
রবিবার, এপ্রিল ১২, ২০২০
  • শেয়ার করুন

মোহনগঞ্জের লোকসাহিত্য
মূল : মো. সারোয়ার জাহান আরেফিন
সমন্বয় : মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন
কংশ-ধনুর পললে গঠিত বহু শতকের ঐতিহ্যের আঁধার মোহনগঞ্জ, যার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লোক সাহিত্যকে বাতাসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বাতাস যেমন আমাদের ঘিরে আছে, তেমনি লোকসাহিত্যও আমদের ঘিরে আছে। বাংলার লোকসাহিত্যের ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার বছরের এবং এর পরিধিও বৃহৎ।
লোকসাহিত্য মোহনগঞ্জের সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধশালী উপকরণ। সংস্কৃতি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবনাচরণের ওপর আলোকপাত করে। এখানকার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির পটভূমি হিসেবে চলে আসে হাওর, জঙ্গল, নদীনালা এবং খাল-বিলের কথা। এ প্রকৃতি ও মানুষের গভীর সম্পর্ক মিলে তৈরি হয়েছে লোকসাহিত্য। মোহনগঞ্জের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে লোকসাহিত্যের অনেক উপকরণ। এসব উপকরণের মধ্যে রয়েছে প্রবাদ বাক্য, ছড়াগান ও হাইর এবং হালকা জাতীয় নানা ধরনের গান।
গ্রামবাংলার অজপাড়াগাঁয়ের শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষের মুখেমুখে সৃষ্টি হয়েছে লোকসাহিত্য। বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন আসলেও এলাকার মানুষ মুখে মুখে এ সাহিত্যকে ধারণ করে আসছে। লোকমুখে সৃষ্টি হয়েছে বলেই এর নাম লোকসাহিত্য।
অবহেলা এবং অনাদরে মোহনগঞ্জের লোকসাহিত্য এখন লোককথার দলিলমাত্র, যা নীরবে-নিভৃতে বিলুপ্তির পথে। অথচ এক সময় লোকসাহিত্যই কর্মক্লান্ত ও অবসর মানুষের কাছে আনন্দসুধা হিসেবে বিবেচিত হতো। হারিয়ে যাওয়া লোকসাহিত্যের এই সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের জানা-অজানা কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এখানে। এ এলাকার লোকসাহিত্যের মূল উপাদানÑ ছড়াগান, গাড়–গান, আঞ্চলিক গান, জারিগান, হালকা গান, প্রবাদ বাক্য ইত্যাদি।
ছড়াগান
লোকসাহিত্যের প্রধান উপকরণ ছড়াগান। তাল, ছন্দ, ভাব ইত্যাদি ছড়াগানের অলংকার। একটি অঞ্চলের কৃষ্টি ও সভ্যতার নিদর্শন প্রকাশ ছড়াগানের মূল বৈশিষ্ট্য। কোন্ অঞ্চলে কী ধরনের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ছিলো, তা ছড়ায় সুন্দর ও সাবলীলভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ছড়াগানে মনোমুগ্ধকর জাদুর পরশ থাকলেও অনেক সময় কিছু শব্দের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। ছড়া আসলে অর্থের জন্য নয়, ছন্দ ও সুরের জন্য।
মোহনগঞ্জের প্রচলিত ছড়ার মধ্যে রয়েছেÑ
আবু নারে নারে
ধনু গাঙ্গের পাড়ে
আবু কইয়্যা ডাক দিলে
উইড়্যা আইয়া পড়ে।
এই ছড়াগানটি শুনিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ানো হয়। ধনু নদ ভাটি এলাকার গীত বা গানের প্রধান উৎস। গাগলাজুর গ্রামের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত এ নদীকে ঘিরে এখানকার মানুষ কল্পনার জাল বুনেছে। অন্য একটি ছড়ায় গ্রামের বধূর মনের আবেগ ফুটিয়ে তোলা হয়েছেÑ
কেলা কেলা যাওরে
গাঙ্গে বইডা বাইয়্যা
আমার আবুর নানারে কইও
নাইওর নিত আইয়্যা।
নাইওর যদি না নেয়
গলায় দিব দড়ি
পাতায় পাতায় লেইখ্যা যাইব
যাইতাম বাপের বাড়ি।
স্বামীর ঘরে যখন মেয়েরা একঘেয়েমিতে হাঁপিয়ে ওঠে, তখন বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য তারা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এই তাৎপর্যটুকুই ছড়ার মাধ্যমে ফুটে ওঠেছে। অন্য একটি ছড়ায় গ্রামের বাড়ির বর্ণনা ফুটে ওঠেছেÑ
এই যে দেখা যায়
তাল গাইছ্যা বাড়িডা
সেই তাল পাকিব
মায়া আমার কান্দিব
চাচি আমার রসের চান
ডাইক্যা আইন্যা বুঝাইব।
এখানে তাল পাকার সাথে মেয়ের কান্নার যেমন একটি যোগসূত্র রয়েছে, তেমনি এক রসিক চাচির ভূমিকাও বলা হয়েছে। এরকম আরো অনেক ছড়া রয়েছেÑ
সই গো সই, নাইল্যা ক্ষেত বই
নাইল্যা ক্ষেত বইয়া দুঃখের কথা কই।
এই ছেরিরে ধর
টুলির ভিতরে ভর
টুলি গেছে ভাইঙ্গা
ছেরি দিছে কাইন্দা।
মাথা ছোলা হিয়ারি
আন্ডা পারে ভুরভুরি
একটা আন্ডা নষ্ট
হিয়ারির মার কষ্ট।
গাডুগান
লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ গাডুগান। এক সময় মোহনগঞ্জের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ছিল গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু। সেই খুশির বাতায়নে এখানে গাডুগান বেশ প্রভাব লাভ করেছিল। গাডু শব্দের উৎপত্তি হয়েছে কৃষ্ণের বাঁশির অষ্টম ঘাট থেকে। ছয়টি ঘাট বাঁশি এবং একটি রাঁধার ও অপরটি কৃষ্ণের। এই আটটি ঘাটের সমন্বয়ে ঘাটু। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলা হয় গাডু। এ গানে শ্রীকৃষ্ণ ও রাঁধার প্রেমলীলা মূর্ত হয়ে ওঠে। লম্বা চুল রাখা দশ-বার বছরের ছেলেদেরকে মেয়েদের পোশাক পরিয়ে গাডু সাজানো হতো। এক সময় স্থানীয় মোড়ল বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অধীনে গাডু ক্রয়-বিক্রয়ের প্রথাও ছিল।
গাডুগানে প্রেমিক কৃষ্ণ ও প্রেমিকা রাঁধার বিরহের গান গেয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হতো। কৃষ্ণের বিরহে সমাজ কলঙ্কিনী রাঁধার কাহিনী শুনে শ্রোতারা চোখের জলে বুক ভাসাতো। আজ অবহেলা এবং অনাদরে গাডুগান প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। মোহনগঞ্জের প্রচলিত গাডুগানের মধ্যে রয়েছেÑ
আজিকে স্বপনে দেখেছি সখী
প্রিয়া আমার শিয়রে
জাগিয়া না পাইলাম গো তারে।
স্বপনে যারে দেখেছি গো সখী
ভুলি কেমনে তারে
প্রিয়া আমার শিয়রে।
এ গানে রাঁধার মনে কৃষ্ণকে ঘিরে দিবানিশি প্রেম-বিরহের ভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছে।
ওহে শ্রীকান্ত, শীত গেল বসন্ত এল
কোকিল পাখি করে গান।
মধুর লোকে মধু করে মধুর ঝংকার
শীত গেল বসন্ত গেল এল
কোকিল পাখি করে গান।
শীত-বসন্ত অতিক্রান্ত হলেও কৃষ্ণের দেখা না পেয়ে রাঁধার আকুল পিয়াসী মন থেকে এই গানের প্রকাশ ঘটে। অন্য একটি গানেÑ
আমি তোমায় নিতে আমি নাই
দেখা দাও হে জীবন কানাই
………………………….
দেখা দাও হে জীবন কানাই।
রাঁধার অন্তরের কথা কৃষ্ণকে বলার জন্য তার পথপানে চেয়ে থাকার আকুতি ব্যক্ত হয়েছে। এ রকম আরো অনেক গানের মাধ্যমে কৃষ্ণ-রাঁধার প্রেমকাহিনী বিধৃত হয়েছে।
ধাঁধা
ধাঁধা লোকসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। গ্রামবাংলার যুবক, কিশোর, আবালবৃদ্ধবণিতা অবসর সময়ে ধাঁধার আসর বসায়। আধুনিক শিক্ষিত সমাজেও ধাঁধা যথেষ্ট সমাদৃত। এসব ধাঁধার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা যাচাই করা হয়। উদাহরণস্বরূপÑ
তিন অক্ষরে নাম যার জলে বাস করে,
মাঝের অক্ষর কেটে দিলে আকাশেতে উড়ে।
উত্তর : চিতল, চিল।
সবুজ বুড়ি হাঁটে যায়,
হাঁটে গিয়ে চিমটি খায়।
উত্তর : লাউ।
প্রবাদ বাক্য
লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ প্রবাদে একটি গভীর, প্রশস্ত এবং অন্তর্নিহিত ভাব থাকে। এর মধ্যে থাকে মানুষের জন্য দিকনির্দেশনা। আবার কখনো থাকে কারো প্রতি অবজ্ঞা বা হুশিয়ারি। এসব প্রবাদ বাক্যের মধ্যে রয়েছেÑ সবুরে মেওয়া ফলে, অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় ইত্যাদি।
হালকা গান
কৃষিপ্রধান গ্রামের কর্মক্লান্ত মানুষ আনন্দ করতে রাতে হালকা গানের আসর বসায়। সাধারণত পৌষ-মাঘ মাসেই এ আসর বেশি বসে। তবে কোথাও কোথাও বর্ষার রাতেও আসর বসে। এ জাতীয় বেশির ভাগ গানের গীতিকার শিল্পী নিজে। এ আসরের জন্য খুব দামী বা দুর্লভ যন্ত্রপাতির দরকার হয় না। বেহালা, জুরি, ঢোলক আসরের প্রধান যন্ত্রপাতি। চাটাইয়ে বসে শিল্পীকে ঘিরে লোকজন গানের সুরে মেতে ওঠে। রাতের নির্জনতাকে ছাপিয়ে গানের সুর গ্রামীণ জনপদ এবং মাঠ-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
জারি গান
জারি গান একপ্রকার স্তুতিবাদক গান। কোনো অঞ্চল বা ব্যক্তিবিশেষের ঐতিহ্য বা মহিমা কীর্তন করে এই গান রচিত হয়। গানের মূল বক্তব্য দলনেতা নেচে নেচে গেয়ে শোনায়; পেছনে একটি অনুসারি দল গানের একটি বিশেষ পংক্তিতে সুর বুলিয়ে যায়। অনুসারী দলের সবার পোশাক একরকম থাকলেও দলনেতার পোশাক থাকে একটু ব্যতিক্রম। সবার পায়ে থাকে ঘুঙুর। এই গানের সাথে নাচ খুব আকর্ষণীয়।
নৌকা বাইচ
গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে নৌকা বাইচ। মোহনগঞ্জের লোকসংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ নৌকা বাইচ। ভাটি অঞ্চলে একসময় নৌকা বাইচের খুব প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্ত। এ এলাকার মানুষের বর্ষায় সাধারণত কোনো কাজ থাকে না। তখন তারা নৌকা বাইচের আয়োজন করে। আকর্ষণীয়ভাবে এসব নৌকা সাজানো হতো এবং পঙ্খীরাজ, ময়ূরপঙ্খী ইত্যাদি নাম দেয়া হতো। সে সব নৌকার নাম লোকমুখে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো। কোনো কোনো গ্রামে সবাই মিলে চাঁদা তুলে নৌকা বাইচের যাবতীয় খরচ বহন করতো।
প্রতিটি নৌকাকে বিভিন্ন রঙে সাজানোর পাশাপাশি বৈঠাগুলোকেও রং দিয়ে সাজানো হতো। যে জায়গায় নৌকা বাইচ হতো, তাকে বলা হয় আড়ং। প্রতিযোগিতার আগের দিন নৌকাকে সোনা-রূপার পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়া হতো এবং নৌকায় আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালানো হতো। নৌকায় বাইচের লোকজন ছাড়াও দু’জন বয়াতি থাকতো এবং দু’জন ঢোল ও করতাল বাজাতো। একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংকেত ধ্বনির সঙ্গে নৌকাগুলো যাত্রা করতো। যাত্রা শুরুর পর বয়াতীরা যে সব হাইর গান গাইতো তার মধ্যে রয়েছেÑ
আল্লা নবীর নাম নিয়ে
ছাড়িলাম দৌড়ের নাও
নাওরে শূন্য ভরে
উড়াল দিয়া যাও।
আবার কেউ কেউ গাইতোÑ
রঙিলা ভাবি গো
মাথায় কবজ দিল কে
আমার ভাইসাব বনতিশিরী
মধু খাইল কে
রঙিলা ভাবি গো
মাথায় …… কে।
এবং
অতি আদরের বউ
মশায় খাইল রে
শীতল হাডি মশুর কিইন্যা দে
…………………………..
মশায় খাইল রে।
এ জাতীয় নানা হাইর গানের মধ্য দিয়ে নৌকাগুলো পাল্লা দিয়ে ছুটতো। যে নৌকা প্রথম নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতো, সেটিই হতো প্রথম।
মোহনগঞ্জের লোকসাহিত্য এবং সংস্কৃতি এখন আর আগের সেই ধারায় নেই। আধুনিক, নাগরিক এবং বিদেশি সাহিত্যের ছোঁয়া লেগেছে এখানে। আকাশ-সংস্কৃতিও থাবা বাড়িয়েছে। তাই এখানকার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি অবহেলা ও অনাদরে বিলুপ্তির পথে। এই অমূল্য সম্পদ এভাবে হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের অতীতের ভিত হারানো। অতীতকে অস্বীকার করে কোনোকিছুরই পূর্ণ বিকাশ হতে পারে না। তবুও এই আশায় বুক বাধি যে, অপসংস্কৃতির অশুভ মেঘ একদিন কেটে যাবে। আমরা ফিরে পাবো আমাদের মোহনগঞ্জের অমূল্য লোকসাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে। প্রয়োজন শুধু সযতে সংরক্ষণ এবং অনুশীলন।