Logo

রাজীব উল আহসান এর ছোট গল্প : সহযাত্রী

অনিন্দ্য বাংলা
রবিবার, মে ১০, ২০২০
  • শেয়ার করুন

একটু আগে আমি একটা খুন করেছি। আমাকে জামগাছের সাথে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমার খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কার্তিক মাসের দুপুরে পেট ভরে ভাত খাবার পর যেমন ঘুম পায়, তেমন ভাত ঘুম পাচ্ছে।
কার্তিক মাসে রায়মঙ্গল নদীতে সকালে মাছ ধরতে যেতাম আব্বার সাথে। সারাদিন মাছ ধরতাম। জাল বিছাতে বিছাতে দুপুর হয়ে যেত। দুপুরে আব্বার সাথে নৌকায় ভাত খেতাম। ভাত খেয়ে আমার ঘুম পেয়ে যেত।  আব্বা আমাকে নৌকার গুলইয়ে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। আরামে আমার চোখ খুলতে ইচ্ছে করতো না৷
আজ আমার চোখে তেমনি ঘুম পেয়েছে। কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করছি না। চোখ বন্ধ করা মানে সামনের সুন্দর দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হওয়া। আমার সামনে আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। আমার চাচার লাশ পড়ে আছে।
একটা শাবল বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে আছে। লাশের পাশে রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে। চাচার মুখ হা করা। হা করা মুখে রক্তের দাগ। মুখের পাশে কতগুলো নীল মাছি ভনভন করছে।
মৃত মানুষের চোখ বন্ধ করার নিয়ম। যেহেতু মার্ডার কেস, তাই চাচার চোখ কেও বন্ধ করে নাই। চাচার চোখ খোলা, তবে চোখের মনি ঘোলাটে। খোলা চোখে চাচা যেন অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। জীবনে এই প্রথম আমি চাচার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছি!
আমাকে ঘিরে কিছু উৎসুক গ্রামবাসী ভীড় করেছে। দু’একটা দুষ্টু ছেলে সুযোগ বুঝে মাটির ঠেলা দিয়ে আমাকে ঢিল দিচ্ছে। আমার ভালোই লাগছে। ঢিল আমার শরীরে লাগতেই ওরা খিলখিল করে হেসে উঠছে। ওদের সাথে আমিও হেসে উঠছি। আমার হাসি থামছেই না। আজ আমার আনন্দের দিন।
আমাকে আমাদের বাড়ির বৈঠক খানার সাথের জামগাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। বৈঠকখানার দেউড়ি দিয়ে কয়েকজন মহিলা উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে।
আমাদের বাড়িটি বেশ বড়। বৈঠকখানা পার হয়ে বিশাল উঠান। উঠানের একপাশে আমার বাবার ছোট্ট টিনের ঘর। তার উল্টোপাশে বড়চাচার একতালা বড় পাঁকা দালান। পাঁকাদালানের ছাদেও বাড়ির মহিলাদের দেখা যাচ্ছে। সবার দৃষ্টি আজ আমার দিকে নিবদ্ধ। অথচ এ বাড়িতে কত অবহেলা আর অনাদরেই না বড় হলাম আমি!
আমার চাচাতো ভাই মবিন আমাকে গাছের সাথে বেঁধেছে। সাথে ছিল মবিনের বড় ভাই ইসাহাক আর চাচার কামলা রাজ্জাক। আমি বলেছিলাম একটু ঢিলা করে বাঁধতে। কিন্তু তারা শোনে নি আমার কথা। অবশ্য বাবার খুনির কথা কে-ই বা সহ্য করতে পারে! মবিনও সহ্য করতে পারে নি। আমার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে মবিন বলেছিল,
— চুপ কর্  হারামির বাচ্চা।
মবিন আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট। সেও আজ আমার গায়ে হাত তুললো! আমার পিঠে, পেটে, মাথায়, মুখে কোথায় মারার বাকি আছে? ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তের স্বাদ আমার কাছে নোনতা লাগছে। রায়মঙ্গল নদীতে যখন জোয়ার আসতো তখন পানি নোনতা লাগতো। আমি আব্বাকে বলতাম,
– পানি এত নোনতা হয় আব্বা?
আমার কথা শুনে আমার আধাপাগল আব্বা মিটমিট করে হাসতেন।
সেই আব্বা আজ সকালে মারা গেলেন। আব্বা অসুস্থ মানুষ। চিকিৎসা নাই, পথ্য নাই, মারা যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। শেষ দিকে মাথাটাও মনে হয় পুরোপুরি গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে আমাকেও চিনতে পারতো না।
আজ আমি সকলে পানতা নিয়ে বসেছিলাম। খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম।এর মধ্যেই আমার বউ সমিরনের চিৎকার..
– এইদিক আসেন একবার, আব্বা যেন কেমুন করতাছে।
পান্তার থালা রেখে উঠতে মন চায় না আমার। তবু উঠে গেলাম। গিয়ে দেখি সমিরন আব্বার মুখে পানির গ্লাস ধরে আছে। আব্বা শেষ বারের মত পানি খেতে চেয়েছিল মনে হয়। কিন্তু পারলেন না। তার আগেই মারা গেলেন৷ আব্বার ঠোঁটের কোনা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে গেল। আমার আর পানতা খাওয়া হলো না। পোড়া শুকনা মরিচ দিয়ে মেখেছিলাম। পান্তার থকথকে লাল রঙ এখনো আমার চোখে লেগে আছে।
সূর্য যখন জামগাছটার ঠিক উপরে তখন কয়েকজন পুলিশ এলো। জামগাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে পড়া আলো মাটিতে নকশা তৈরি করেছে। সে নকশা মাড়িয়ে একজন দারোগা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে বললেন,
– তুমি সাবান আলী?
আমি বললাম
–  জি স্যার, আমি সাবান আলী।
— তুমি তোমার চাচাকে খুন করেছো?
— জি স্যার। আমি খুন করেছি। উনি আমার আব্বার সৎ ভাই।
— সৎ ভাই বুঝলাম। কিন্তু কেন খুন করেছো?
— মাথায় রক্ত উঠছিলো স্যার। সহ্য করতে পারি নাই স্যার।
— তাই বলে মানুষ খুন করবে? সাহস তো তোমার কম না!
— আমিও বুঝতেছিনা স্যার, এত সাহস কই থেকে আসলো। আসলেই আগে আমার এত সাহস ছিলো না। আমি ছিলাম ভীতুর ডিম। সাহস থাকলে….
দারোগা সাহেবের মনে হয় আর কিছু জিজ্ঞাসা করার নাই। আমার কাছ থেকে তিনি চাচার লাশের কাছে চলে গেলেন। লাশ খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা করলেন। এরপর চাচার ছেলে মবিন আর ইসহাকের স্বাক্ষ্য নিলেন। আশেপাশের আরো কয়েকজনের স্বাক্ষ্য নিয়ে  ভেতর বাড়িতে চলে গেলেন তারা। একজন কনস্টেবলকে আমার পাহারায় বসিয়ে দিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জোহরের আযান  হলো।
আল্লাহু আকবার
আল্লাহু আকবার, ….
আযান শেষে আমি ইশারায় সেই কনস্টেবলকে ডাকলাম।
– পুলিশ ভাই আমার হাতের বাঁধনটা একটু ঢিলা করে দিবেন? চিন্তা করবেন না,  আমার কোমরে রশি বাঁধা আছে। তাছাড়া ওরা মেরে আমার পা মনে হয় ভেঙে দিয়েছে। আমি চাইলেই আর পালাতে পারবো না।
কনস্টেবলটি আমার দিকে এগিয়ে এলো। তার নাম দুলাল। মায়ামায়া চেহারা। বয়স বেশি না। মনে হয় নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। আমার আবদারে হয়তো মায়া লেগেছে। আমার হাতের বাঁধনটা একটু ঢিল করে হাতকড়া পড়িয়ে দিল।
আমি বললাম – স্যার, একগ্লাস পানি খাবো, দেয়া যাবে?
দুলাল আমার কথায় বিরক্ত হবার ভান করলো। আসামীর কথায় পুলিশ বিরক্ত হবে, প্রয়োজনে দু চারটা কিল বসিয়ে দিবে এটাই নিয়ম। দুলাল সেই নিয়ম রপ্ত করতে প্রাণপণে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। তার মায়ামায়া চেহারায় কাঠিন্য ফুটে উঠছে না।
এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলে গেল। আমি আলাপ জমানোর জন্য দুলালকে বললাম, চাচাকে কেন খুন করেছি জানতে চান?
দুলাল বললো, চুপ করে বসে থাকেন। আজ আপনার বড় বিপদ। আল্লা-খোদার নাম নেন।
আমি বললাম, বড় বিপদ আমি জানি। জেল খানায় কথা বলার লোক পাবো না। তাই এখনি দু চারটা কথা বলে মন হালকা করতে ইচ্ছে করছে।
দুলাল ফের আমার দিকে কড়াচোখে তাকায়।
আমি আবার হেসে বলি,  সারাদিন জেলখানায় একা থাকবো। সারাদিনই বসা। তখন আল্লা খোদার নাম নেয়া যাবে। কি বলেন?
দুলাল আমার কথায় স্পষ্ট বিরক্ত হলো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। একটা চেয়ার নিয়ে আমার কাছাকাছি জাম গাছের ছায়ায় বসলো।
আমি বললাম, খুনটা আমি কেন করছি একটু শোনেন!
আমার কথা শুনে দুলাল কড়া চোখে আবার তাকায় আমার দিকে। ঠিক যেমন করে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে আমার চাচার লাশ। কিন্তু আজ আমি কারো চোখ রাঙানীকেই ভয় পাই না! কারুর না!
কিছুক্ষণ পর আব্বার কথা মনে হলো। আচ্ছা, আব্বার লাশের কি অবস্থা? গোসল কি দেয়া হয়েছে? আত্নীয় স্বজনকে কি খবর দেখা হয়েছে? জানাজা কখন? কবর কখন?
কবরের কথা মনে হতেই আবার মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। উহু, মাথায় আবার রক্ত উঠে গেল আমার।
আজ সকালের ঘটনা। সকাল সকাল আব্বা মারা গেলেন। আব্বার এমন কপাল, মারা গেলেন অথচ কান্নাকাটির লোক নাই। আমি ছেলে মানুষ আব্বার লাশ নিয়ে কতক্ষণ কান্নাকাটি করা যায়? আমার বউ সমীরণ পরের মেয়ে হয়ে যতটুকু পারছে, কাঁদছে। আব্বার নিজের মেয়ে জুলেখাকে আনতে লোক গেছে। আসুক জুলেখা। জুলেখা আসলে না হয় কান্নাকাটি ভালো জমবে! কিছুই করার নাই। আব্বার মন্দ কপাল!
অবশ্য আজ দিয়ে না। আব্বার কপালটা জন্ম থেকেই খারাপ। আম্মা মারা যাবার পর থেকেই মাথাটা একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে। শুধু কি মাথা? সারাজীবনের অর্থকষ্টে শরীরটাই তার ঠিক ছিল কখোনো ? অথচ দাদার সন্তান হয়েও চাচা আর আব্বার জীবন যেন দুই মেরুর জীবন। হায়,  সম্পত্তির লোভ চাচাকে অমানুষ করে দিল!
আজ সকালে বাবার লাশ রেখে  ঘর থেকে বের হলাম যোগাড়- যন্তরের জন্য। কাজ তো আর কম না। কাফনের কাপড় আনো রে, বাঁশ কাটো রে, কবর খোড়ে রে…
কবর! হুম। কবর।
এই কবর খোঁড়া নিয়েই তো ঘটলো ঘটনাটা। আমি চাচাকে গিয়ে বললাম,
– চাচা, আব্বাতো মারা গেলেন। এখন কবর দেয়া দরকার। কবর কোথায় দেই বলেন?
চিবানো পান আরো চিবাতে চিবাতে চাচা বললেন,
 – হারামজাদারে বাড়ির পিছনে কবর দে। বাঁশঝাড়ের পিছনে যে পাকুড়্গাছ আছে না সেখানেই ভালো হবে।
আমি বললাম, এটা কি বলেন চাচা? বাড়ির পেছনে কেন?
আমাদেরতো জমি জমা কম না। এত খালি জমি রেখে সেখানে কেন? বৈঠকখানার সামনে কবর দেই চাচা।
চাচা বললেন, না। পাগল মানুষের আবার ভালো মন্দ কি? আমি যেটা বলেছি সেটাই করো! শুধু মুখে মুখে তর্ক করে। বেয়াদব ছেলে।
আমি আমতা আমতা করে বলি, চাচা সেখানেতো খুব জংলা। জায়গাটাও ভালো না। শিয়াল কুকুরের আড্ডা। দিনের বেলাতেও মানুষ সেখানে যেতে ভয় পায়। এছাড়া কিছুদিন আগেও সেখানে কাঁচা পায়খানা ছিলো। সেখানে কিভাবে আব্বার কবর দিই বলেন?
চাচা বলেন, কাঁচা পায়খানা থাকলো তো আরো ভালো। তোর বাবাতো কাঁচা পায়খানার যোগ্য। যোগ্য লোকের যোগ্য জায়গা, হি হি হি।
চাচার কথা শুনে মবিন, ইসাহাক হাসতে থাকে হা হা হা করে।
আমি বললাম, চাচা এটা কি বলেন? আব্বা তার ভাগের জায়গা জমি কিছুই পায় নাই। দাদার সবকিছুই তো আপনিই নিলেন। কোন দিন কিছু বলতে পারি নাই। আব্বা আমার সারাজীবন কম কষ্ট করে নাই। এই টিনের বাড়ি ছাড়া আর কি পাইছে আব্বা? কবরটা অন্তত বাড়ির সামনে দিতে দেন।
আমার কথা শুনে, চাচা খুব মেজাজ খারাপ করলেন। বললেন, এখানে আমি আর আমার দুই ছেলে চারতলা বিল্ডিং বানাবো। একপাশে গ্যারেজ থাকবে। সামনের বছর কাজে হাত দিবো। এখানের কোন জমিতে হাত দেয়া যাবে না।
আমি বললাম, ঘর বানাবেন বানান। বাবার কবরের জন্য  তিনহাত জায়গা হয় না!
চাচাকে এত করে বললাম, তবু শালা মানে না। আমারে মারতে আসে। মানুষ চিনে নাই? সেই ছোটবেলা থেকেই চাচার হাতের মার খাইছি। চাচাকে কোন কিছু বলার সাহস পাই নাই। চাচা আমার আব্বাকেও যা তা বলতো। কিন্তু আব্বা মুখ তুলে কোনদিন কিছু বলে নাই। চাচার শত অবিচারের কথা আব্বাকে ধরিয়ে দিলেও আব্বা নিশ্চুপ থাকতেন। বলতেন, বড় ভাই হয়। মুরুব্বি মানুষের সাথে বেয়াদবি করতে নাই।
তাই কোনদিন বেয়াদবি করি নাই। আজ আব্বা নাই। বেয়াদবি দেখার লোক নাই। তাই দিলাম গাইরা।
হাতের কাছে কবর খোড়ার দা-কোদাল ছিল, শাবল ছিলো। শাবল দিয়ে দিলাম ভুড়ি গালায়া। হি হি হি। কোপ খায়ে পেসাব কইরা দিসে। একেবারে ছ্যারাবেড়া অবস্থা।
এখন বুঝ শালা!
চাচার লাশ এখনো আমার সামনে পড়ে আছে। একদলা থুথু চাচার দিকে ফেলতেই দেখি আমার বোন জুলেখা এলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দিল। আমার হাত বাঁধা। আমি আমার এতিম বোনকে ছুঁয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না।
ছোটবেলায় এই জামগাছের ডালে বসে আমি জাম খেতাম। আমি জুলেখাকে কখনো দিতাম, কখনো দিতাম না।
নিচে জুলেখা জাম চেয়ে চেয়ে কাঁদতো। আজ জুলেখার কান্না শুনে ছোট জুলেখার কান্না মনে পড়ছে। আমি জামগাছের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ ভিজে উঠে।
একটুপরে জুলেখা বাড়ির ভেতরে চলে গেল। বাড়ির ভেতরে জুলেখার কান্নার শব্দ আসছে। আর আসছে বিরানীর গন্ধ। মড়া বাড়ি থেকে আসবে আতর নোবানের গন্ধ। কিন্তু বিরানীর গন্ধ কেন? পরে শুনলাম, পুলিশের জন্য হোটেল থেকে খাবার আনা হয়েছে।
এখন রায়মঙ্গল নদীতে ভাটা চলছে। থানায় যেতে হলে উজানে যেতে হবে। ভাটা ঠেলে উজানে কিভাবে যাবে? তাই পুলিশ নৌকা নিয়ে যেতে পারছে না। তবে ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যেই জোয়ার আসবে। এত সময় পুলিশকে খালি মুখে বসিয়ে রাখে কিভাবে? তাই আমার চাচাতো ভাই মবিন খাবারের ব্যবস্থা করেছে।
মবিন ছেলেটা ছোট খাটো হলেও বেশ করিৎকর্মা। কিভাবে যেন সব ম্যানেজ করে, একেবারে বড় চাচার মত। বড় চাচার অবর্তমানে সব দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। অদৃশ্যভাবে সে-ই সবকিছুর নেতৃত্ব দিচ্ছে। মবিনের বড় ভাই ইসাহাককে দেখলাম মবিনের হুকুম তালিম করছে। পুলিশ আসার পর থেকেই ওদের ম্যানেজে ব্যস্ত মবিন। একটু আগে জোর করে পুলিশের পকেটে কি যেন গুজে দিল।
মবিনকে যতটুকু চিনি তাতে আমি নিশ্চিত, বড় চাচার চারতলা ঘর উঠবে ঠিকই, কিন্তু সেখানে ইসাহাকের জায়গা হবে না। ভাবতেই আমার প্রচন্ড হাসি পেল। আমি হি হি হি শব্দ করে হাসতে থাকলাম। আমার হাসির কারন কিংবা অর্থ কিছুই বুঝতে পারলো না কনস্টেবল দুলাল। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
একটু আগে আসরের আযান হয়েছে। তারমানে এখন রায়মঙ্গল নদীতে জোয়ার চলে এসেছে। কনস্টেবল দুলাল  এসে আমার হাত খুলে হাতকড়ার সাথে শিকল পড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আমাকে নিয়ে রওনা হবে। আমার বউ সমিরণ আর বোন জুলেখা সুর করে কাঁদছে।
জুলেখাকে দেখলাম, পুলিশকে কি যেন বলছে।
জুলেখা আরো কাছে এসে বললো, আর একটু থাকেন পুলিশ ভাই। তাহলে আমার ভাইটা আব্বার কবরে মাটি দিয়ে যেতে পারতো। একমাত্র ছেলে সে..
দারোগা সাহেব জুলেখাকে ধমক দেন।
– মার্ডার কেসের আসামী তোমার ভাই। সেই হিসাব তোমার আছে? কখন আবার ভাটা শুরু হয়। দিনে দিনে দ্রুত থানায় যাওয়া দরকার। সরো সামনে থেকে!
আমি দারোগা সাহেবকে বলি, আমার একটা কথা রাখবেন স্যার?
— কি কথা? বলো।
— আব্বার কবরে তো মাটি দিতে পারলাম না। যদি অনুমতি দিতেন কবরটা একটু দেখে যেতাম?
আমার কথায় দারোগা সাহেবের  মন নরম হলো। কনস্টেবল দুলালকে বললো, সাবধানে  নিয়ে যাও। কবর দেখায়ে নিয়ে আসো। বেশি দেরি করবে না। দেখো, পালিয়ে যেন না যায়!
কনস্টেবল দুলাল আমাকে বাড়ির পেছনে নিয়ে এলো। বাঁশবাগান আর ঝোপঝাড়ে জায়গাটা চাপচাপ অন্ধকার। ছোটছোট ঝোপঝাড় পাড় হয়ে সামনে এগুলাম আমরা। আর একটু এগুলেই সেই পাকুর গাছ। যেখানে কিছু বছর আগেও কাঁচাপায়খানা ছিল।
এসে দেখলাম কবর খোড়া শেষ। কবর দেখে আমি খুব চমকে গেলাম।
কবর একটি নয়। পাশাপাশি দুটি কবর খোঁড়া হয়েছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে কবর দুটি কেন?
ঠিক তখনি আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। বুঝলাম একটা কবর বাবার জন্য, অন্য কবরটা চাচার জন্য।
আমি হা হা হা  হাসিতে বাঁশবাগান কাঁপিয়ে তুললাম। হায়, মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। চাচা চেয়েছিলেন বাবাকে এ নোংরা জায়গায় কবর দিতে। আর নিজে চার তলা পাকা বিল্ডিং করে ছেলেপুলে নিয়ে সেখানে থাকবেন। অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার ছেলেরাই তাকে কাঁচা পায়খানার জায়গায় কবর দিচ্ছে।
আমি আবার হা হা হা করে হাসতে থাকি।
আমার হাসির চোটে ভয়ে কনস্টেবল দুলালের হাতের শিকল শিথিল হয়। ছাড়া শিকল পেয়েও আমি দৌড়ে পালাই না। দুলাল খুব অবাক হয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
আমি কবর দুটোর দিকে তাকিয়ে একটানা হেসেই যাচ্ছি হা হা হা…..
———-
সহযাত্রী
রাজীব উল আহসান
————