Logo

রাজীব উল আহসান এর রম্য গল্প : বলুন কবুল

অনিন্দ্য বাংলা
মঙ্গলবার, জুন ২, ২০২০
  • শেয়ার করুন

বলুন কবুল ( রম্য)

রাজীব উল আহসান
ফরিদ ভাইয়ের বিয়ের বয়স এক্সপায়ার হইছে আরো বছর পাঁচেক আগেই। কনে বাছতে বাছতে এখন আর সম্বন্ধ আসে না। কারন একটাই। একমাত্র ছেলের জন্য ফরিদ ভায়ের মা চায় সুন্দরী বউ!
কিন্তু দেখা যায় কনের গায়ের রঙ ঠিক আছে কিন্তু চুল ছোট। কারো আবার চুল ঠিক আছে কিন্তু দাঁত উঁচু। আবার সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু মেয়ের চোখ নাকি ট্যারা। ইত্যাদি অযুহাতে সব কনেই কাটা পড়ে চাচীর ধারালো চোখে।
এদিকে ফরিদ ভাই’যে পাত্র হিসেবে রসোগোল্লা টাইপের, সেটাও কিন্তু না। তাই ভালো কনে মেলা ভার। কিন্তু চাচির জেদ। বউ তবে হবে সেই রকম সুন্দরী। আগুন সুন্দরী।
বর্তমানে ফরিদ ভাইয়ের এমন অবস্থা, কনে একটা হইলেই হলো। বিয়েটাই মূখ্য। কিন্তু সেটাও জুটছে না তার।
অবশেষে একটা কনের খোঁজ  পাওয়া গেলো। ছাই ফেলতে ভাংগা কুলো টাইপের আরকি! এটাও যে চাচীর পছন্দ হবে না তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়।
কিন্তু ফরিদ ভাই এবার মরিয়া। ফরিদ ভাই এসে আমাদের পায়ে পড়লেন। আমরা বলি ছি  ছি ফরিদ ভাই। এসব কি করছেন। আমরা আপনার কত ছোট!
ফরিদ ভাই কেদেকেঁটে আকুতি জানান। এই মেয়ে হাতছাড়া হলে জীবনে আর বিয়ে হবে না রে!
আমরা ভাবি, তাহলে কি করা যায়? শেষে সবাই মিলে প্ল্যান করে ফেললাম। প্ল্যান হলো, বাজার থেকে সিনেমার নায়িকার একটা ভিউকার্ড আনা হবে। চাচীকে বলবো এটা কনের ছবি। নায়িকার ছবি দেখে চাচি নিশ্চয়ই অমত করবেন না।
যেই ভাবা সেই কাজ। বাজারে গেলাম। বাজারে এক ছোট ভাইয়ের ভিউকার্ডের দোকান আছে। তার দোকানের সামনে গিয়ে আমতা আমতা করছি। কিন্তু তার কাছে গিয়ে কিভাবে নায়িকার ভিউকার্ড কিনি? লজ্জা করছিল। কি না কি ভাবে!
তাই এক রিকশাওয়াকে বলে কয়ে দোকানে পাঠালাম। লিখে দিলাম কি আনতে হবে। রিকশাওয়ালা দোকানে গেল। মিনিট পাঁচেক পর ভিউকার্ড নিয়ে ফিরলো।
সে এনেছে ইন্ডিয়ান নায়িকাদের ভিউকার্ড।  কার্ড দেখে চক্ষু চরকগাছ। ভিউকার্ডের নায়িকারা পোষাক আষাকের বিষয়ে বিশাল উদার! বিপাশা বসুর কার্ডটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না পর্যন্ত ! আর একটা ভিউকার্ড ডুয়েট। ইমরান হাসমি আর মল্লিকা শেরোয়াতের খুব রোমান্টিক মুডের ভিউকার্ড!
ফরিদ ভাই খুব হতাশ হলেন। প্রায় কান্না কান্না অবস্থা। আমি সামলে নিলাম। আসলে ভুল আমারি হয়েছে। নায়িকার নাম লিখে দেয়া দরকার ছিল। এবার লিখে দিলাম। বাংলা সিনেমার নায়িকা ববিতা- শাবানার সিঙ্গেল ছবি চাই।
এইবার আমরা সফল হলাম।ববিতার ভিউকার্ড কিনে ঘরে আনলাম। রাতে আমরা চার পাঁচজন গিয়ে চাচীকে বলি –
— চাচী, এই মেয়ে তোমার পছন্দ হবেই হবে! এই দেখ।
ছবি দেখে চাচী খুব খুশি।
চাচী বলেন,
– আরে মেয়ে তো দেখি একেবারে ববিতার মত। আহা কি সুন্দর! এই মাইয়া আমার ফরিদের কাপালে ছিল আমি জানতাম! অথচ কতজন কত কথা বলছে এতদিন!
চাচী রাতেই মুরগী ধরে জবাই দিলেন। আমরা মনের সুখে ভাত খেলাম। চাচী হাত তুলে খাস দিলে আমদের জন্য দোয়া করলেন। আমরাও যেন ববিতার মত সুন্দর বউ পাই (দোয়া একশো পারসেন্ট বিফলে গেছে)।
এরপর ফরিদ ভায়ের বিয়ে হলো। বউ দেখে তো চাচী ফিট।জ্ঞান ফিরলে শুধু আমাকে নাকি খুঁজতেন। আমার নামে কিছুক্ষণ খিস্তিখেউড় করে আবার নাকি ফিট হয়ে যেতেন।
যাক, পরে আর কি হলো তা আর না বলি! একজন আই’বুড়ার খেদমত করতে গিয়া না হয় এক বুড়ির স্বপ্ন ভেঙেছি। তাই মনে তেমন কষ্ট নেই।
তবে চাচী ধোঁকা খেলেও একদিন ছেলের সুখে নিশ্চয়ই সুখী হবেন।
কিন্তু, মলি আপার স্বামীর কি হবে? হুম,বলছি। মলি আপার কথা বলছি।
আমার বন্ধু ওলি। ওলির বড় বোনের নাম মলি। ওলি আমার সাথে পড়ে। সেই সূত্রে ওদের বাসায় যাই। মলি আপার সাথেও খাতির আছে আমার। সেদিন হঠাৎ করেই ওলি ফোন করে বলে- বাসায় আয় জলদি। আজ মলি আপাকে বরপক্ষ দেখতে আসবে। সব ঠিকঠাক থাকলে আজ বিয়ে পড়ানো হবে। আমি একা সব সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। জলদি চলে আয়!
আমি পড়িমরি করে ওলিদের বাসায় চলে গেলাম।
গিয়ে দেখি ডইং রুমে বিশাল দরবার। অনেক মহিলা – পুরুষে সাজসাজ রব। সবাই সুন্দর করে সেজেছে। তারমধ্যে মাথায় হাফ ঘোমটা দিয়ে সুন্দর মতন কে যেন বসে আছে বিয়ের সাজে।
আমার মনে খটকা লাগে। মলি আপার বিয়ে। অথচ মলি আপা কই? বউ সেজে বসে আছে যে ভদ্রমহিলা,  তিনি কে?
আমি ওলিকে গিয়ে বলি
-কিরে মলি আপা কোথায়?
ওলি বলে, ড্রইংরুমে। দেখিস  নি? বউ সেজে বসে আছে?
আমি আবার উকি দিয়ে ড্রইংরুমে দেখে আসি। কিন্তু মলি আপাকে পাই না।
পরে ওলির ঝাড়ি খেয়ে আবার যাই। গিয়ে আবিষ্কার করি সেই ভদ্র মহিলাই আমাদের মলি আপা। যিনি বউ এর সাজে বসে আছেন। ভারী সাজসজ্জার জন্য মলি আপাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
আমি ওলির কাছে আবার ফিরে আসি। বলি,
– এসব কি ওলি? মলি আপার মোটা চশমা কোথায় ?
ওলি বলে,
–মলি আপা চশমা ফেলে দিয়েছেন। চোখে লেন্স লাগিয়েছেন। লেন্স লাগিয়ে “নীল নয়না” হয়েছেন। কালো চামড়ায় ফাউন্ডেশন মেরেছেন। যা ভালো করে দেখে আয়।
এত কিছু জানার পরোও মলি আপাকে আমার চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি তাকে চিনিলাম। ভালো করেই চিনিলাম। যখন তিনি সোফা থেকে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। হাই হিল জোড়া মলি আপাকে পাঁচ ইঞ্চি উঁচুতে তুলিলেও  তার আশি কেজি ওজনকে বদলাইয়া পঞ্চাশ করিতে পারে নাই! আফসোস!
কিন্তু মলি আপাকে খুব মিষ্টি লাগছে। এই মিষ্টি চেহারা দেখেই বরপক্ষ পটে গিয়েছে। তাদের ধৈর্যের বাঁধ আর মানতে চাচ্ছে না। তাই পাত্রের ইচ্ছায় বিয়েটা আজকেই হচ্ছে। দেরি করলে যদি এই মেয়ে হাতছাড়া হয়?
কিন্তু এ যে মলি আপার আসল চেহারা নয় তা তো তারা জানে না। পাত্রের জন্য আমার মন খারাপ হচ্ছে। আহা বেচারা!
যাই হোক মলি আপার বিয়েটা হয়েছিলো। অতপর তারা সুখে শান্তিতে বাস  করেছিলো বলেই  জানি।
কিন্তু এত সব দেখার পর আমি কান ধরলাম। জীবনে আর বিয়ে নয়। আম্মা পইপই করে আমার পিছে ঘুরে।  বিয়ে করাতে চায়। কিন্তু আমি রাজি হই না।
বিয়েতে রাজি করাতে তাই আম্মা আমার বড় বোনকে হায়ার করে এনেছেন। সাথে এসেছে তামান্না। তামান্না আমার ভাগনি। বয়স চার বছর।
বাসায় সারাদিন বিয়ের আলাপ হয়। এদিকে তামান্না আম্মার সাথে সারাদিন কাজ করে। ঝাড়ু নিয়ে ঘর ঝাড়ু দেয়। ফ্রিজ থেকে কাঁচামরিচ এনে দেয়। আম্মার ঔষধ এনে দেয় ইত্যাদি। সবাই খুব উৎসাহ দেয়। সে নিজেও খুব উৎসাহ নিয়ে এটা সেটা করে।
একদিন আম্মা আদর করে বলেন, আমার নাতনি সব কাজ করতে পারে। অনেক বুদ্ধিমান।
আম্মা আমাকে দেখিয়ে বলে, তুই বিয়ে করতে চাস না। অথচ তামান্নাকে এখন বিয়ে দিলে সংসার করতে পারবে।
আম্মার কথা শুনে তামান্নার তরিৎ জবাবে আমরা হতভম্ব।
তামান্না বলে “আমি যে ভাত রাধতে পারি না নানু”।
তাম্মানার কথায় সবাই হোহো করে হেসে উঠে।
যেন শুধু ভাত রান্নার জন্য তামান্নার বিয়েটা আটকে আছে।
তামান্নার কথায় হতববাক হলেও জহিরের প্রেমিকা মিমের কথায় হতবাক হই নি।
তিন বছর প্রেমের পর বিয়ের আলাপ চলে জহিরের সাথে মিমের।
জহিরের মা, মীম কে বলেন- মা তুমি কি কি রাঁধতে জানো?
মীম জবাব দেয়- আমি নুডুলস, ডিমভাজি আর ব্ল্যাক টি খুব ভালো করতে পারি আন্টি।
–আর কোন রান্না করতে পারো না মা?
— ব্ল্যাক টি’ র সাথে নুডুলস কিন্তু খুব জমে আন্টি। একেবারে ফাটাফাটি।
মিমের এ কথায় বিয়েটা কাটাকাটি হয়ে গেলো।
এখন জহির দেখি উদাস মুখে সারাদিন ঘুরে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম। এ জীবনে আর বিয়ে নয়। পাক্কা সিদ্ধান্ত। তবু আমার এই সিদ্ধান্তে যদি বিন্দুমাত্র ফাঁক থাকে তবে একটি ঘটনায় তা আর থাকলো না। সেই ঘটনার ফলে আমি ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিলাম, আর বিয়ে নয়!
সে ঘটনা দিয়েই গল্প শেষ করছি।
কয়েকদিন আগে গ্রামে গিয়েছি ঘুরতে। গ্রামে জুলু পাগলার সাথে দেখা। গরুকে খাবার দিচ্ছে। জুলু পাগলা আমাদের গ্রামের বিখ্যাত এক পাগলা। কথায় কথায় পরনের লুঙ্গি খুলে মাথায় বেঁধে ফেলে এমন অবস্থা।
জুলু পাগলাকে দেখে জিজ্ঞেস করি-
–কেমন আছো জুলু ভাই?
–ভালো না।
–কেন?
–কেন আবার? রাতে ঘুমাতে পারি না।
–কেন কি হয়েছে? ঘুমাতে পারো না কেন?
–বউ এর শরীরে বেজায় গন্ধ। তাই ঘুমাতে পারি না।
আমি নিচু স্বরে বলি- জুলু ভাই, এসব কি বলছো? মানুষ শুনলে কি বলবে?
জুলু পাগলা বলে – বললে বলুক। আমার যে ঘুম হয় না। তার কি বিহিত হবে। ওর গায়ে কাঁচা গোবরের গন্ধ।
–মানে?
আমার প্রশ্ন শুনে জুলু পাগলা এক খামচি গোবর তুলে নিয়ে আমার কাছে এলো। এসে আমাকে বলে দেখ, এমন গন্ধ।
আমি নাক কুঁচকে বলি- আহ, বাদ দাও তো। ভাবি সারাদিন কাজ কর্ম করে। ভাবীকে তুমি একটা বাসনা করা সাবান কিনে দিও! দেখবে কোন গন্ধ থাকবে না।
জুলু পাগলা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে-
–হুম,  তুমি তো এসব বলবেই। তুমিতো আর ওর সাথে থাকো না? থাকিতো আমি!
— মানে? এসব কি বলছো জুলু ভাই। মানুষ শুনলে কি বলবে?
— বললে বলুক। এক রাত ওর সাথে  ঘুমায়ে দেখ। তখন বুঝবা কাঁচা পায়খানা কারে বলে!
আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলাম। জুলু পাগলা লুংগির গিটে হাত দিয়ে আলগা করে নিল। এখন খুলে-তখন খুলে অবস্থা।
অবস্থা বেগতিক দেখে আমি উল্টো দিকে দৌড় লাগালাম।
জুলু পাগলাও  আমার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছে। হাতে তার এক খামচি গোবর।  আর মুখে বলছে-
এক রাত থাইকা দেখ
এক রাত থাইকা দেখ।
বি: দ্র:- গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক। কাকতালীয়ভাবে কোন চরিত্র কোন বর্ন, ধর্ম, বা গোত্রের সাথে মিলে গেলে তাহবে একান্তই অনভিপ্রেত।