Logo

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফাদার উইলিয়াম ইভান্স

অনিন্দ্য বাংলা
শনিবার, নভেম্বর ১৪, ২০২০
  • শেয়ার করুন

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফাদার উইলিয়াম ইভান্স : রাজু রোজারিও

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐ সময়ে অনেক বিদেশি যাজক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় সেবা দিতেন। আমাদের ঢাকা জেলার নবাবগন্জ উপজেলাতে অনেক খ্রিস্টান ধর্ম অনুসারীদের বাস। আমাদের চার্চে ধর্মীয় সেবা ও পরিচর্যা করতেন একজন বিদেশী যাজক। খুবই স্বাভাবিক যে, যুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিটি বাংলাদেশী এক একটি মহাসংকটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের অত্যাচারে ও হুমকিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, মানসম্মান সম্ভ্রম, জীবিকা সবকিছুই ছিলো চরম ঝুকিতে। ঐ বছরই আমার বাবা মা এর বিয়ে হয়। এই বিদেশী যাজক আমাদের বাড়ীতে মা বাবার বিয়ে সম্পাদন করেন। মা বলছিলেন, পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে উনারা ওই সময় গীর্জায় যাওয়াও বন্ধ রেখেছিলেন।
এই যাজক ছিলেন নির্ভীক, নিবেদিত। যিনি একজন আমেরিকান হয়েও এই বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উনি প্রায় প্রতিটি বাড়ী ঘুরে ঘুরে ধর্মীয় পরিচর্যা করে যাচ্ছিলেন। উনি পারতেন মহাসংকটে এই বাংলা ত্যাগ করে, নিজের দেশে ফিরে যেতে। আর এইজন্যই উনি পাকিস্তানি হানাদারদের নজরে চলে আসেন, উনি কিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছেন, তা পাকিস্তানি হানাদাররা হয়তো খুবই নিবিড় ভাবে নজরে রেখেছিলেন।
সেই দিন ছিলো ১৩ নভেম্বর ১৯৭১ সাল। এই যাজক জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে, প্রার্থনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে (খ্রীষ্টযাগ দিতে), খুব সকালে একটা দূরের গ্রামে যাচ্ছিলেন। এলাকার অনেকেই উনাকে না করেছিলেন, উনি ভয় পান নি। হয়তো বলেছিলেন যে উনি অন্যায় কিছু করতে যাচ্ছেন না। নদীপথে দেড় ঘন্টার উপরের পথ। নৌকা উপজেলা সদরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলো, মাঝি ছিলেন মোহন চাচা। পাকিস্তানি শয়তানরা মোহন মাঝিকে বললো নৌকা ঘাটে নিতে। মোহন মাঝি নৌকা ঘাটে ভিড়ালেন। পাকিস্তানি হানাদাররা যাজককে নিচে নেমে আসতে বললো। উনি নিচে নেমে আসলেন। উনাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো মাঠে। ধর্মীয় উপাসনা সামগ্রী গুলো চরম অমানুষিকতায় নষ্ট করলো। যাজকের কাছে জানতে চাইলো, মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য, জানতে চাইলো, কিভাবে বা কেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছেন। অনেক প্রশ্নের মাঝে প্রতিটি উত্তর পাকিস্তানি হানাদারদের পচ্ছন্দ হওয়ার কথা নয়। তাই শুরু হলো শারীরিক নির্যাতন, শক্ত বুটের লাথি, মুঠির ঘুষি, বন্দুকের নাল দিয়ে মারধোর। অনেক নিরবে উনি সহ্য করার পরও কিছু আর্তনাদের শব্দও শোনা যাচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর, সকালের নিরব নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে, ঠাস ঠাস গুলির আওয়াজ, বুলেটের শব্দ। নিমেষেই পাখির কলকাকলি বন্ধ হয়ে গেলো, নীরব নিস্তব্ধ হলো নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর। একজন আমেরিকান যাজকের দেহ লুটিয়ে পরলো বাংলার মাটিতে, বুলেটে বিদ্ধ বুকের পাঁজরের রক্ত ফিনকি দিয়ে বেড়িয়ে ছিটকে পরলো সেই মাটিতে, যে মাটি অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে সিক্ত, যে মাটিতে অনেক মা বোনের অশ্রু ফোটা। সেখানে উনার স্মরনে শহীদ মিনার নির্মিত করা হয়েছিলো, যা আজ ইছামতি ভাংগনে আজ বিলুপ্ত প্রায়। নিমেষেই নিথর হয়ে গেলো নির্ভীক দেশপ্রেমীর দেহ। হত্যা করা হলো একজন মানবিক মানুষকে। রচিত হলো দেশপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত । লাল সবুজের বাংলার জন্য জীবনাবসান হলো মানবপ্রেমী, সেবার অহংকার একজন ভিনদেশী যাজকের। বাংলার স্বাধীনতার জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ হলো আরেকজন দেশপ্রেমের রুপকারের।
তিনি একজন মানবপ্রেমী, মহান মানুষ- ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। আজ ১৩ নভেম্বর, এই মানবপ্রেমীর ৪৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি শায়িত আছেন আমাদের চার্চ এর কবরস্হানে। আমার ও আমাদের মৃত আত্মীয় স্বজনদেরই সাথে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, গভীর কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় এই দিনটি এলাকা বাসী বিশেষ ধর্মীয় গাম্ভীর্য, পুষ্পস্তবক অর্পন, স্মরন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করেন। আমরাও করেছি যখন ছাত্র ও যুব সংগঠনের সাথে ছিলাম। প্রচলিত থাকুক বহুদিনের এ স্মরণ অনুষ্ঠান, প্রচলিত ধারা। কারন ফাদার উইলিয়াম ইভান্স আমাদের প্রেরণা, আমাদের উৎসাহ উদ্দীপনা, আমাদের ভালবাসা, যিনি এদেশের মানুষের জন্য স্বার্থহীন ভালবাসার নিদর্শন রেখে গেছেন।
আমি সবসময়েই কৃতজ্ঞতায় স্মরন করি, যারা জীবনের ঝুকি নিয়ে ফাদার এর মৃত দেহ ক্যাম্প থেকে চার্চে এনে সমাধি দিয়েছিলেন। আজ অবশ্যই শহীদ যাজক উইলিয়াম ইভান্সের সমাধি স্হান ফুলে ফুলে সজ্জিত। আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিঃদ্রঃ এই সত্য ঘটনাটি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শোনা। অনেক সাহস নিয়ে এই গর্বের ইতিহাস লিখলাম। ভুলত্রুটি মার্জনীয়। আমার বন্ধু তালিকায় অনেক সিনিয়ররা আছেন, এবং সিনিয়রসহ সবার প্রতিই অনুরোধ, ফাদার উইলিয়াম ইভান্স কে নিয়ে আপনার অনূভুতি কমেন্টস এ লিখুন, যদি আরো কিছু তথ্য আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারি।
আরেকটি বিষয়, ফাদার উইলিয়াম ইভান্স আমাদের বাড়ীতে অনেক যেতেন। আমার দাদু ও আমার যুবক বাবার সাথে সখ্যতার কারণেই। তাই পরবর্তীতে উনার স্মরনেই আমার নাম রাখা হয় উইলিয়াম। তাই এই মহান মানুষকে প্রতিনিয়তই গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।
আরো জানতে….

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। যিনি মানবসেবার ব্রত নিয়ে ধর্মযাজক হিসেবে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ জাহাজ মালঞ্চে ভারতবর্ষে আসেন। ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ঢাকার নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ইছামতী নদীর পাড়ে পাকিস্তানি সেনারা এই মহান মানবসেবীকে হত্যা করে।

যুদ্ধের সময় নবাবগঞ্জের বক্সনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। এটাই ছিল ফাদারের অপরাধ। সেদিনও তিনি কর্মস্থল গোল্লা থেকে নৌকায় কয়েক মাইল ভাটিতে বক্সনগর যাচ্ছিলেন। পথে তিনি শহীদ হন।

ফাদারকে বহনকারী নৌকার মাঝি মোহন মোল্লা পরে গোল্লা ধর্মপল্লিতে সেদিনের নৃশংস ঘটনার বর্ণনা করেন, যা এখনো গির্জার রেকর্ড বইতে লেখা রয়েছে:
‘১৩ নভেম্বর শনিবার ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে বেলা ১: ১৫টায় ফাদারকে নিয়ে গোল্লা গীর্জা থেকে বক্সনগর উপ-ধর্মপল্লির উদ্দেশ্যে নৌকাযোগে মোহন মাঝি যাত্রা করেন। পথিমধ্যে নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালে পাক সৈন্যরা তাঁর নৌকা পাড়ে ভিড়ানোর নির্দেশ দেয়। ফাদারকে ডেকে ক্যাম্পের ভিতর কমান্ডারের কাছে নেয়া হয়। সেখানে ১৫ থেকে ২০ মিনিট জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর নদীর পাড়ে এনে সৈন্যরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে পেটাতে শুরু করে। বেয়নেটের খোঁচায় তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করা হতে থাকে। ভীতসন্ত্রস্ত মোহন মাঝি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। মাঝিকে লক্ষ্য করে দুইটা গুলি করা হলেও ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তিনি সাঁতার কেটে নদী পার হন। ততক্ষণে সৈন্যরা ফাদারকে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। মোহন মাঝি বিকেল ৪টায় গোল্লা গির্জায় পৌঁছে এই খবর জানান।’

পরদিন ভোরে ঘটনাস্থলের কয়েক মাইল ভাটির গ্রাম বাহরা নদীর ঘাটে ফাদারের মরদেহ পাওয়া যায়। গোল্লা গির্জার রেকর্ড বই থেকে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ও ময়নাল হোসেন ফাদারের মরদেহ উদ্ধার করে গোল্লা গির্জায় সংবাদ পৌঁছে দেয়। পরে গির্জা থেকে আরও ১০-১২ জন যুবককে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ফাদারের মরদেহ গির্জায় নিয়ে আসেন।

আর্চবিশপ গাঙ্গুলী ফাদার ইভান্সের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। গির্জার রেকর্ড বইতে তা সংরক্ষিত আছে। তিনি লেখেন, ‘ফাদার ইভান্সের মুখে গভীর ক্ষত ছিল, বেয়নেটের আঘাতে তাঁর নীচের ঠোঁট কেটে যায় এবং মুখের ভিতর দু-একটি দাঁত ভাঙা, দুইটি গুলি, একটি বাম দিকের পাঁজর দিয়ে ঢুকে ডান হাতের কাঁধের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে। অপরটি ডান দিকের কোমরের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে এবং দুটো হাতেরই ভিতর দিকে কাটা, হাত ও পায়ে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ।’ সেদিন রোববার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে গোল্লা কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

বক্সনগর গির্জার পাশেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। ফাদার ওই ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। তা ছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। এই খবর রাজাকারের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা জানতে পেরেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফাদারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

ফাদার উইলিয়াম ইভান্স ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ম্যাসাচুসেটসের পিটসফিল্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা চার্লস ও মা রোজ ইভান্স। তিনি ১৯৪১ সালে হলিক্রস মিশন সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৫ সালের ১০ জুন যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন। মানবসেবার ব্রত নিয়ে ফাদার উইলিয়াম ইভান্স ১৯৪৫ সালের ভারতবর্ষে আসেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে অবস্থিত সিলেটের শ্রীমঙ্গল, ময়মনসিংহের বালুচড়া, ঢাকার হলিক্রস ক্যাথিড্রাল, নবাবগঞ্জের তুইতাল, বান্দুরা অবশেষে ১৯৬৭ সাল থেকে গোল্লা গির্জায় পুরোহিতের কাজ করেন।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ও https://issuu.com/jeromedcosta/docs/the_story_of_father_william_evans__c.s.c._-__missi