Logo

সাদিয়া জামানের গল্প : ইলিশ মাছের ঝোল

অনিন্দ্য বাংলা
শুক্রবার, মে ১২, ২০২৩
  • শেয়ার করুন

“-কইতে পারবি মেম্বারের বাইত কি রানতাছে? “
রাবু চোখ বন্ধ করে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে চট করে বলে দেয়,
“- ইলশা মাছ! ইলশা মাছ ভাজা করতাছে”
“-ঠিক কইছস, আমিও এই গেরানই পাইছি” নয়ন উত্তর দেয়।
নয়ন, রাবু পিঠাপিঠি ভাই বোন। পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে নয়ন পড়ে ক্লাস টুতে আর রাবু ওয়ানে। তিনটে বই আর একটা খাতা বগলদাবা করে দুজনে ছুটতে ছুটতে যায় স্কুলে । স্কুল থেকে কয়েক পা এগুলেই মেম্বারের বাড়ি। রোজ স্কুল থেকে ফেরার সময় বারোটা কি সাড়ে বারোটার দিকে এ বাড়ির রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে মজার মজার খাবারের ঘ্রান। সকালে একটা আটার রুটি নয়তো লবণ মরিচ চটকে এক থালা পান্তা খেয়ে আসা ছোট্ট পেটে ততক্ষণে ইঁদুর দৌড়াতে থাকে। তার ওপর এত ভালো ভালো খাবারের ঘ্রাণ খিদে আরও বাড়িয়ে দেয় নয়ন রাবুর।
“-ভাইয়া, বাইত গিয়া আজকাই আব্বারে কমু ইলিশ মাছ আনতে। আম্মারে কমু মোল্লা জ্যাডার খেতের বাতরের কচুর মুহি দিয়া ইলিশ মাছের ঝোল রানতে। জানস না নাতো, মুহি দিয়া ইলিশ মাছ যে কি স্বাদ!
-তুই জানলি কেম্নে?
-নিলু কইছে। ওর মামা ওইদিন ইয়া বড় এক ইলিশ আনছিলো। জানস, ইলিশ মাছে ভাত মাখায়া খাইলে নাকি হাতও গেরান অইয়া যায়।
নয়ন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বোনের মুখের দিকে। ওর চোখে মুখে দেখে এক টুকরো ইলিশের জন্য জিভে জল চলে আসা আক্ষেপ। নয়ন জানে ওর বাবা জীবনেও ইলিশ বাড়িতে আনবেনা। কোনদিন আনেওনি।
“- আম্মা খিদা লাগছে। ভাত দেও। “
বাড়িতে না ঢুকে আজ দেউরি থেকেই ভাতের জন্য চিল্লাচ্ছে রাবু। ঘরের দুয়ারে আধাভাঙা মাটির চুলায় খড়ি পাতা ঠেলে কি যেন রান্না করছেন নয়নের মা জমিলা। মেয়ের ভাত চাওয়া দেখে গলা উঁচু করে জবাব দেয়,
“- বইপত্তর রাইখা ডুব দিয়া আয়, আমি খাওন বারতাছি। “
আজ রাবুর ভীষণ খিদে পেয়েছে। খেয়ে তারপর গোসলে যাবে। নাকে এখনও লেগে আছে ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ। চোখে ভাসছে এক থালা গরম সাদা ভাতের উপর লাল করে ভাজা ইলিশের পেটি।
ঘরে বই রেখে দুই ভাইবোন এসে খেতে বসেছে। জমিলা বেগম দুই থালা খিচুড়ি এনে ওদের সামনে দিলেন। শুধু হলুদ লবণে মাখানো ট্যালট্যালে খিচুড়ি দেখেই রাবু কেঁদে দিয়েছে। নয়ন রাগ করে উঠে গেছে খাওয়া ছেড়ে।
“- খামুনা আমি, ডেইলি ডেইলি এইতা পাইন্না খিচুড়ি আর খামু না “
জমিলা বেগমের মুখ কালো হয়ে আসে। গেলো দুই সপ্তাহ ধরে চাল আর লবণ ছাড়া আর কোন সদাই আনেনি বাড়িতে। এটা ওটা লতা পাতা সিদ্ধ খেয়ে চালিয়ে নিচ্ছে দিন। বাজারের অবস্থা আগুন। মাছ মাংসতো দূর, তয় তরকারি কিনে খাওয়ারও জো নেই গরীবের। নয়নের বাবা বাজার থেকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আগের মতো কামাই রোজগারও আর নাই তার।
মহাজনের চালের আড়তে বস্তা তোলার কাজ করেন নয়নের বাবা মকবুল মিয়া। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় যে কয় টাকা পান তাতে চাল ডাল আর লবণ কিনতেই পকেট ফাঁকা। বাচ্চাদের পরনে সেই এক কাপড়। নীল সাদা স্কুল ড্রেসটা বাড়ি স্কুল মিলিয়ে সমানতালে পরে। অবশ্য এ নিয়ে বাচ্চাদের কোন দুঃখও নেই। যেখানে তিনবেলা অন্ন জুটছে না, সেখানে আবার বস্ত্র!
দুপুরবেলা পাতের খাবার ফেলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে রাবু। জমিলা চুলায় চাল ফুটিয়ে রেখে মুরগীর খোয়ার খুঁজে একটা ডিম পেয়েছে। দেউড়ির বেড়ায় লতানো কুমড়ো গাছের দুটো ফুল ছিঁড়ে ডিমের সাথে ফেলে ভেজে নিয়েছে। হলদে কুসুম আর হলদে ফুল মিলে বড়সড় একটা ডিমভাজা হয়েছে। ডিমভাজার ঘ্রাণ পেয়ে নয়ন দৌড়ে ঘরে গেলো। রাবুর কাঁধে হাত রেখে ডাকতে লাগলো,
“- এই রাবু, উঠ্ উঠ্! আম্মা ডিম ভাজছে। “
ভাইয়ের ডাক শুনে লাফ দিয়ে উঠে রাবু। চোখ কচলে নাক টেনে ডিমভাজার ঘ্রাণ নেয়। বারান্দায় ফেলে রাখা জলচৌকিতে গিয়ে বসে দুই ভাই বোন। জমিলা গরম ভাতের থালায় ডিমভাজা ভাগ করে সাজিয়ে দেয়। ততক্ষণে বাহির বাড়ির দিক থেকে মকবুল মিয়ার ডাক শোনা যাচ্ছে,
“- কইরে নয়ন, আগ্গায়া আয়। বাজারের ব্যাগটা ধর। “
হাত ধুয়ে দৌড়ে গিয়ে দেউড়ি পর্যন্ত আগায় নয়ন। বাবার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাগের তলায় পরে থাকা এটুকু সদাই টানতে আবার এত ডাকাডাকি করতে হয়? বারান্দার কোনায় ব্যাগটা রেখে খেতে বসে যায় নয়ন। জমিলা এক এক করে ব্যাগ থেকে সদাই নামাচ্ছে। কেজি দুই চাল, এক প্যাকেট লবণ, এক পোয়া সয়াবিন তেল আর এক কেজি কাঁচা পেপে এনেছেন মকবুল মিয়া। জমিলার বিষন্ন মুখ দেখেই মকবুল বলতে থাকে,
“বাজারো আগুন লাগছে রে জমিলা। কিচ্ছু ছুওন যায় না। একশো টেহার নোটটা যেন কাডলের পাতা। ভাঙ্গাইলেই মিলায়া যায়।”
জমিলার মুখ আরও কালো হয়ে আসে। সব বুঝতে পারে সে। তবুও মুখ ফুটে বলে ফেলে,
“আনাছ তরকারিও আনলাইন না, কোন একটা মাছও না। পুলাপানে ভাত খাইতে বইয়া কান্দে “
রাবু ততক্ষনে পাতের ভাত শেষ করে উঠে গেছে। বাবার কোল ঘেঁষে জলচৌকির কোনায় এসে বসেছে। মাথা তুলে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আব্বা, বাজারতে ইলিশ মাছ আনবা? আজ মেম্বরের বাইত ইলিশ রানছে, কি যে গেরান! “
মকবুল মিয়া ছলছল চোখে মাথা নেড়ে সায় দেয়। কিন্তু সে জানে মেয়ের আবদার রক্ষা করার ক্ষমতা তার নাই। গরীব হয়ে জন্ম নেয়া, আর গরীব হয়ে বেঁচে থাকার জন্য তার আবারও রাগ হয় নিজের প্রতি। তবে মনে মনে ঠিক করে, কাল মহাজনের কাছ থেকে ধার করে টাকা নিয়ে হলেও ইলিশ আনবে সে।
আজ অনেকদিন পর মাছ বাজারে ঢুকলো মকবুল মিয়া। ভিড় ঠেলেঠুলে ভেতরে আগায় সে। মাছের অভাব নেই দেখি। রুই, কাৎলা, মৃগেল, শোল, গজার, সহ কোন মাছই বাদ নেই। ইয়া বিশাল বিশাল মাছ সাজিয়ে রেখেছে। মকবুল মাছ ধরে উল্টে পাল্টে দেখে দাম জিগায়। শেষে গেলো ইলিশের দোকানে। বরফে ঢাকা সারি সারি চকচকে রূপালি ইলিশ। সেই কোন ছোটবেলায় খেয়েছিলো ইলিশ তা আর মনে করতে পারে না সে। জিহ্বা হয়তো ভুলেই গেছে ইলিশের স্বাদ। মকবুল মিয়া ছুঁয়ে দেখে ইলিশ। পেটমোটা ডিমভর্তি এক ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করে। মাছ বিক্রেতা পানের পিক ফেলতে ফেলতে জানায়,
“এই ডিমওয়ালা মাছটা নিলে আন্নের লাইগ্গা একদাম এক হাজার টেহা “
মকবুল আৎকে উঠে। কি বলে এসব! এক মাছ এক হাজার! এদিকে মহাজনের হাতে পায়ে ধরে তিনশো টাকা ধার এনেছে। মাছের দাম শুনে হা হয়ে তাকিয়ে আছে মকবুল।
“আরে মিয়া লইয়া যাও। এরুম মাছ আর পাইতা না। পেডিগুলা পটল দিয়া ঝোল ঝোল করতে কইবা ভাবীসাবরে। আর ডিমগুলা কড়া কইরা ভাইজ্জা দিবা পুলাপানরে। “
মকবুলের চোখে ভাসে রাবু, নয়ন ইলিশের ডিম পাতে নিয়ে কত্ত খুশিমনে খাচ্ছে।
“কি মিয়া নিলে কও “
মাছওয়ালার ডাকে ভাবনায় ছেদ পরে মকবুলের। শুকনো হাসি মুখে ঝুলিয়ে জানায়,
“আইজ আর নিতাম না। সামনের আডো নিমুনে “
একশো বিশ টাকায় এক কেজি ওজনের পাঙ্গাসের গলায় দড়ি ঝুলিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় মকবুল। ইলিশ না হোক, এতদিন পর মাছ ভাত পাতে উঠবে এতেই খুশি হবে বাচ্চারা।
মহাজনের আড়তে হালখাতা আজ। মকবুলরে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো সকাল সকাল কাজে আসতে। হালখাতার উৎসবে মহাজনের মন মেজাজ খুব ফুরফুরে আজ। মকবুল হাতের কাজ সেড়ে মহাজনের পাশে এসে হাত কচলাতে কচলাতে মাথা নিচু করে বলে,
“ভাইজান, এক হাজার টেহা দিতে পারবেন? মাইয়াডা ইলিশ মাছ খাইতে চাইছিলো”
খুশি খুশি মহাজন মুহুর্তেই রাগে আগুন হয়ে গেলেন। কটমট করে মকবুলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হেদিন তিনশো নিলি, শোধ করার নাম গন্ধ নাই। আজ আবার হাজার টেহা চাস? কিয়ের ইলশাডা খাওয়া লাগে তর মাইয়ার? ভাতই পায়না আবার ইলিশ মাছ! যা যা কামে যা। “
নিজেকে সামলানোর বহু চেষ্টার পরও গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো মকবুলের। দ্রুত হেঁটে আড়তের ভেতরের ঘরে চলে গেলো সে। সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় মুজুরি নিতে মহাজনের ক্যাশের টেবিলের পাশে দাঁড়ালো। পাঁচশো আর হাজারের নোটে ক্যাশ বাক্স ভরে উপচে পরছে হালখাতা শেষে। মহাজন নিচু হয়ে পানের কৌটা থেকে পান তুলতেই মকবুল ঝড়ের গতিতে একটা হাজার টাকার নোটটা পকেটে ভরে ফেলে।
হাজার টাকার নোট পকেটে নিয়ে মকবুল হাঁটছে বাজারের দিকে। না না কোন রকম অপরাধবোধই আজ কাজ করছে না তার। শুধু বাচ্চা মেয়েটার তৃপ্তি নিয়ে ইলিশ খাওয়ার দৃশ্যই চোখে ভাসছে।
বাজারে পৌঁছেই আজ আর কোন দরদাম করেনি। ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে ভরে নেয় ডিমওয়ালা ইলিশ। সাথে মনে করে কচুর মুখী নিতেও ভুলে না। মেয়েটা কচুর মুখীতে ইলিশের পেটি খেতে চেয়েছে যে। বাজার শেষে বেশ খুশি মনে দ্রুত পায়ে হাঁটছে মকবুল। না আজ আর হেঁটে বাড়ি যাবে না। রাস্তার ওপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা ডেকে থামালো। হাট বারের ভিড় ঠেলে বড় রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ডান পাশ থেকে শা শা করে এগিয়ে আসা এক ট্রাক মুহুর্তেই পিষে দিয়ে গেলো মকবুলকে। মুহুর্তেই হাতের বাজারের ব্যাগটা ছিঁটকে পরলো দূরে, পিচঢালা কালো রাস্তায় চকচকে রুপালি ইলিশটা ভিজে গেলো টুকটুকে লাল রক্তে……
ইলিশ মাছের ঝোল>
#সাদিয়া জামান