Logo

আফসারা জাহিন আঁকা’র গল্প : আঁড়বোলার জঙ্গল

অনিন্দ্য বাংলা
সোমবার, জুলাই ১৯, ২০২১
  • শেয়ার করুন

আঁড়বোলার জঙ্গল

-আফসারা জাহিন আঁকা
আজকের রোদের তেজ দেখা মনে হচ্ছে এই বুঝি মাঠ ঘাট,ঘরবাড়ি, গাছপালা সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। এমনকি রিনি যে গাছের ডালটাতে বসে পা দুলাচ্ছে তাও আগুনের শিখার মতো গরম ৷ কিন্তু রিনির সে দিকে কোন খেয়ালই নেই। রাগে আর জেদে তারএ উত্তাপখানি কোন প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারেনি। রিনির পেছন দিক দিয়ে ঝুনু পা টিপে টিপে আসছে। রিনি ঘাড়ের কাছে ভারী নিঃশ্বাস টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়েই ঝুনুকে দেখতে পেল। ইস্‌ কত সাবধানে আসছিলাম, এরপরও টের পেয়ে গেলি! রিনি থমথমে মুখ করে বসে রইল। কোন কথা বললনা। এই রিনি তোর কি হয়েছে,, এ গরমে বসে আছিস কেন? এমনি। চল ঘরে চল।। না যাব না মা বকেছে। তার রাগ পড়ুক পরে যাব। এতক্ষণ এখানে বসে থাকবি? আমার দীবস রজনী যাহার কথা ভেবে ভেবে কাটে সে পাশে থাকলে আর কি??
ঝুনু চোখ মুখ উজ্জল করে বললো এতো ভালবাসা বাপরে। যদি সত্যিই এতো ভালবাসা থেকে থাকে তবে কি আর সখীকে কি এভাবে এ গরমে পুড়তে দিতি?
 – আমি তো নিজেও পুড়ছি তোকে তো আর একা পুড়াচ্ছি না।
-পুড়ছিস কেন? চল ঘরে চল।
– মা বকেছে রাগ পড়ুক পরে যাব। ঝুনু চোখ বড় বড় করে বললো কখন  রাগ পড়বে?
 – জানিনা।
– ততক্ষণ এখানে বসে থাকবি?
– দোষ কি চল নদী তে ডুব দেই একবার।
– লাভ নেই পানিও গরম হয়ে আছে। ঠিক আছে তুই থাক। কথাটা শেষ করেই রিনি একহাত নিচে থাকা পানিতে লাফ দিয়ে নামল। এবার আস্তে আস্তে নদীর মাঝখানের দিকে এগোতে লাগল। ঝুনু সেভাবেই বসে রইলো হঠাৎ সে মনে পড়া ভংগীতে বলে উঠল এই তোকে খালাম্মা বকবে না? রিনি ঝুনুর কথাটা শুনে খানিক প্রকৃতস্থ হলো বটে তবুও সামলে নিল। সুন্দর মুহূর্তটাকে মাটি করতে চাইল না। খানিক বাদে সে উঠে এলো।
রিনি ঝুনু কে নিয়ে ভয় পাচ্ছে হয়তো খালাম্মা আজ ওকে আচ্ছা মতো শাসাবে।কিন্তু রিনির সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ ও নেই।সে কাক ভেজা হয়ে উঠে এসে চেপে চেপে চুলের পানি ফেলছে। এবার খুব ধেরী হয়ে গেছে মা বোধহয় আর সবুর করবে না, এখনই ফিরতে হবে।
– ঝুনু তুই চল আমাদের বাড়ি।
– না এখন যাব না, বিকেলের দিকে আসবক্ষণ।
আমেনা বেগম বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছিলেন। রিনিকে কাকভেঁজা হয়ে আসতে দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। ইচ্ছে করছে এ ঝাঁটা দিয়েই আচ্ছামতো তাকে পেটাতে। কিন্তু মেয়ের বাপের নিষেধ, তার গায়ে হাত তোলা যাবেনা, তাই কিছু করতে পারে না। কিন্ত মনের জ্বালা মেটান জিহ্বা দিয়ে। রিনি ভয়ে ভয়ে বারান্দায় উঠে আসতেই ক্ষুরধার জিহ্বা চলতে শুরু করল। দামড়া মেয়ে নেচে গেয়ে ভিইজ্জে সপসপ হইয়া কই ত্থেকে আসা হইতাছে শুনি? খালি মনের সুখে নাচন না!  ঘরের কোন কামে হাত না দিয়া রাজেন্দ্রানীর মতোন ঘুরা-ঘুরি ! আরে ও দামরী তোর কাম বাইরে নারে ঘরে? যে ভাতের ফেন গালতে জানে না, তারে দিয়া অইবোডা কি!  যাও গিয়া গলা ডুবাইয়া খাইয়া আমারে এহন উদ্ধার কর বাপু।
রিনি থমথমে মুখ করে তার ঘরে ঢুকেই দরজা আটকিয়ে দিয়েছে। কোথায় যেন পড়েছিল কিশোরীরা কাঁদে লুকিয়ে, আর যুবতীরা প্রকাশ্যে, আর মধ্য বয়সী থেকে বৃদ্ধারা আশেপাশে কেউ না থাকলে কাদঁতেই পারে না। যেমন সে কাদঁছে লুকিয়ে। তবে এখন কেন কোন কালেই সে কারো সামনে কাদঁতে পারবেনা।চোখের জল তো নিজের এতো অন্য কাউকে দেখাবার নয়।
শিউলি আপা  আমেরিকা যাবার আগে যখন শেষ এসেছিল সেবার যাওয়ার সময় সবাইকে হাত নেড়ে বিদায় দিতে গিয়ে তার চোখে জল চলে এসেছিল। সে জল লুকাতে হাতের সানগ্লাস টা তাড়াতাড়ি চোখে দেয়। সবার কাছ জল আড়াল করার জন্য এ  তৎপরতা।
রিনির শিউলি আপার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। এ মানুষটি তার জীবন আলোকিত করেছে। বাপ, ভাই, মা পড়াশোনার মর্ম বুঝে না। জীবনে তারা স্কুলে পড়েনি সেখানে কি হয় তাও ঠিক জানে না সেখানে রিনির পড়ালেখা করাতো প্রায় অসম্ভব। তারা ঘুম আর খাওয়া ছাড়া আর কিছু জানে না। খাবার জুগানোই যেখানের মূল কাজ সেখানে ঐ অজপাড়াগাঁয়ে পড়ালেখা না করতে পারাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু শিউলি আপা তাকে আর ঝুনুকে পড়িয়েছে। নানান দেশের বিখ্যাত সব বই এনে পড়িয়েছে। রিনির শিউলি আপার কথা মনে পড়তেই মন ভালো হয়ে যায়। এখনো তাই হয়েছে।
সে এখনো ভিজে শাড়ি পড়ে দাড়িঁয়ে আছে। শাড়িটা বদলাতে ইচ্ছে করছে না, আবার এখানে এভাবে দাড়িঁয়ে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। বাইরের ঘরে ভাইজান এর গলা শুনা গেল।
– মা, রিনি কই? হে কালগা আমারে হাঁস আনবার কইছিন। আজগা ফিরার পথে দেহি আবু দুইডা হাঁস লইয়া বাজারও যাইতাছিন। আমি কিছু কম দাম দিয়া লইয়া আইছি। আজগাই রাঁনবা কিন্তু, রাইতে  সবাই মিইল্লা   এক লগে খাইয়াম।
আমেনা বেগম  হাঁসটার দিকে চেয়ে বললো কত দিয়া আনলি? ভাইজান বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, দাম দিয়া কাম কিতা। ওহন ভাত দেও দেহি। রিনি কই?
ঐ হারামিডা কইলো আর তুইও লইয়া আইলি, ও জানে না ভাইয়ের মাছের কারবার বন্ধ হইল হইল! আর বাপেওযে এই ভাইয়ের দিকে চাইয়া আছে। এ দিয়াই কোনোরকম ভাত জুটে। ওতো পুড়ারমুঁখী।
-মা.. বেশি হইয়া যাইব কিন্তু।
– হ,হ বেশি তো হইবই। আমার পোলাপান এহন লায়েক হইয়া গেছে। আর তারার বাপ তো আরো ভালা। কামাই এর নাম নাই পুতের দিকে খালি চাইয়া থাহে। মরণ হইছে আমার! উচ্ছনে যাওয়া সংসারটার সব আমার দেহা লাগে। পুড়া কপাল আমার।
– তুমার কিতা হইছে, কইবা? এতো কথা কেরে কইতাছ? ভাইজান অর্থা্ৎ ফরিদ আঁচ করতে পেরেছে রিনির সাথে নিশ্চয়ই মার একদফা হয়ে গেছে। তাই প্রশ্নটি শেষ করেই রিনির ঘরের দিকে এগোল। রিনি ততক্ষণে কাপড় বদলে ফেলেছে। তার বিছানার মাথার পেছনে একটা লম্বামতো দড়ি টানানো। সে ভিজা শাড়িটি সেখানেই মেলে দিলো। ভাইজান এর ডাক শুনে চুপচাপ অপেক্ষা করছে তার এ ঘর আসা অব্দি। দরজায় মৃদু করে একবার কড়া নাড়লো,  এরপর আবার জোরে নাড়তে যাওয়ার আগেই রিনি দরজা খুলল।
পাশের ঘর থেকে  আমেনা বেগমের  গলা শুনা যাচ্ছে। দামড়া মেয়ে এখন ফ্যানফ্যানিয়ে ভাইকে শুনাবে। ছি… লজ্জা ও করে না। রিনি ভাইজানকে টেনে বিছানায় বসালো। দুজনই পাশাপাশি চুপচাপ বসে। মায়ের কথা শুনছে। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে ভাইজান জিজ্ঞেস করলো মায়ে হঠাৎ রাগলো কেন?
– জানিনা।
– ও তুই মার কথা হুনে আমারে এহন কিছু কইবি না, না?  রিনি চুপ করে থাকলো। সে তো কখনোই কিছু বলে না। খুব ছোট বেলা যখন তখন মায়ে বকা দিত কিংবা মার দিলে তখন বলতো;  এখন বড় হওয়ার পর সে আর কিছু বলে না।
 – ভাত খাইছস?
– হু, তুমি গিয়া খাও গা।
– হাছা কইছস?
রিনি মুখ তোলে ভাইজান এর দিকে চাইলো, মুখে কিছু বললো না।
ফরিদ কোন কথা না বলে রান্না ঘরে ঢুকলো।আমেনা বেগম পান্তা ভাত খায় আর সামনে দুটো প্লেট এ পান্তা ভাত। সাথে পেয়াঁজ আর শুকনো মরিচ। ফরিদকে একা দেখে রিনির মা জিজ্ঞেস করলেন, রাজেন্দ্রাণী কই?  তারে কও ভাত খাইতে। ফরিদ অবাক হয়ে মার মুখের দিকে চেয়ে বললো মা, রিনি খাইছে না!
 – সময় থাকলে তো খাইব।
– ওযে কইছে খাইছে।
– খায় নাই, মান ঢেড় হয়েছে বাপু আর পারছিনা।
ফরিদ চুপচাপ খাওয়া শেষ করে রিনির প্লেট টা হাতে নিয়ে তার ঘরে ঢুকলো। রিনি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছিল ভাইজানকে দেখেই বলে উঠল আমি খাইতাম না আমার ক্ষিধা নাই, খাইতাম না।
– রাগ করিছ না খাইয়া নে।
– আমার ক্ষিধা নাই কইলাম তো।
ফরিদ রিনির হাত ধরে টেনে বসালো। এরপর নিজের হাতে খাওয়াতে লাগল। রিনি আর প্রতিবাদ করতে পারল না।
রিনির মা নদীর ঘাটে শাক ধুতে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে ভেতরে তাকাতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল।তার ঠোঁট এ বাঁকা হাসি।
বাপে নদী থেকে পোনা মাছ ধরে এনেছে। এগুলো কাটতে হবে, রান্না করতে হবে। একা আমেনা বেগম আর কত দিক সামলাবে!  রিনি যদি কোন কাজে হাত না লাগায় …
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। রিনি কুপির আলোয় বই পড়ছে। তিনি ডাকবেন না ডাকবেন না করে ও ডাকলেন।
– রিনি বই থুইয়া আমার সাথে আয়। আমি একলা পারতাম না। তোর বাপে মাছ আনছে। রিনি চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
-বাপে কি মাছ আনছে মা?
– পোনা মাছ। আয় আমার লগে আয়।
রিনি ফুঁ দিয়ে কুপি নিভিয়ে উঠে আসলো।খোলা চুল খোঁপা করতে গিয়ে মনে পড়ল কতদিন ধরে তেল দেয় না মাথায়। কেমন রুক্ষ হয়ে আছে। ভাইজান কে বলা লাগবে প্যারাসুট তেল আনতে, তেলটা অনেক ভালো ।
মা হারিকেন এর আলোয় মাছ কাটছে। সেও পাশে রাখা বটি নিয়ে মাছ কাটা শুরু করে দিল। দ্রুত আর সুন্দর করে মাছ কাটার তার সুনাম আছে।
মাছ কাটতে কাটতে রিনি প্রশ্ন করে,  মা বাপে কই গেছে?
কই আর নদীর ঘাটও মনে অয় বইয়া আছে। তার মনো তো কত ফুর্তি। খালি গান গায়। এমন বেখেয়ালি বাপ মানুষ জন্মেও দেহিনি! মাইয়া আইবুড়া হইতাছে বাপের কোনো চিন্তাই নাই। সব চিন্তা আমার করন লাগে।আছে এমন দামড়ি কোন মাইয়া ? পুরা গাঁ খুইজ্জা বার করবার পারব নি,ঐ ঝুনু ছাড়া।
-আমরার গাঁয়ে নেই ঠিক কিন্তু শহরে মেলা আছে আমার বয়স ১৬ আর শহরে ২৫,২৬ এও বিয়া হয়।
-দুই পাতার বই পইড়া আমারে গীত হুনানি হইতাছে। ঐ বই হলো সয়তান এর আখড়া। বই তোরে আর ঝুনুরে পাগল কইরা দিছে। কোন কালে দেখছিনা কাওরে বই পড়তে আর এহন কিনা আমার পেটের সন্তান,, কি আর কই সব আমার কপালের দোষ।
বাইরের দরজায় টোকা পড়ছে। রিনি পাশের মগে রাখা পানি দিয়ে হাত কোনোরকম ধুয়ে ছিটকিনি খুলল। ছিটকিনি খুলেই থ মেরে গেলো। মুখে তার কথা বেরুচ্ছে না!  বাপের পাশে এক জোয়ানমর্দ ছেলে।
কিছু বলার আগে রিনির সবুজ মিয়া মেয়েকে বললো, বেটি সর দেখি।  এক বালতি নিয়ে আয়।
রিনি কিছু বুঝতে পারছে না। বাপের সাথে এ মানুষ টি কে?  প্রশ্নটা করেই ফেলল কে উনি শহরে.. !
সবুজ মিয়া  রিনির অবাক হওয়া দেখে বুঝতে পারলো আগে পরিচয় করিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু তাকে চান্স দিতে হলো না। ছেলেটি নিজেই গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করলো, আমার নাম অয়ন। আমি শহর থেকে এসেছি আপনাদের অজপাড়াগাঁ সম্পর্কে রিসার্চ করতে ৷ আপনাদের এখনে সপ্তাহ খানিক থাকব। আর যতটুকু সম্ভব ততটুকু আপনাদের আমার ঝামেলা থেকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করব। আমায় দয়া করে কিছুদিন আশ্রয় দিন। খাবারদাবার এর ব্যবস্থাও আমি করব।
রিনি বললো  আপনি তো শহরের ছেলে আমাদের  এ ঘরে থাকবেন কি করে?
-মানিয়ে নেব। এটাও একরকম অ্যাডভেন্জার।
রিনির পেছনে দাড়িঁয়ে আমেনা বেগম ও সব কথা শুনলেন কিন্তু তিনি আগামাথা কিছু বুঝতে পারছেন না।
রিনি এইখানে দাঁড়াইয়া থাহিস না, যা পানি আন, পোলাডা হাত মুখ ধৌক।
এখানে পানি না এনে আমি বরং তারে কলপাড়ে নিয়ে যাই। রিনির কথাটা সবুজ মিয়ার মনে ধরেছে। আচ্ছা যা, আর তোর ঘরডা ওরে তৈয়ার কইরা দে সে ওখানেই থাকব আর তুই তোর মায়ের ঘরও আইয়া পড়।
রিনি, নরম কন্ঠে বললো, আচ্ছা।
অয়ন  রিনির দিকে ফিরে বললো একটু কষ্ট করুন দয়া করে।
রিনি প্রতিবাদ করে বললো কষ্ট কিসের!  এসব কি বলছেন। আসেন এদিকে। রিনি কুপি ধরে কলপাড়ে এগোতে লাগল।
অয়ন হঠাৎ মুখ খুললো,  আচ্ছা আপনাকে দেখে আমার সব এলোমেলো লাগছে দয়া করে আমায় সাহায্য করুন।
রিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো- এম্মা কেন?
 -আমি বুঝতে পারছি না কিভাবে আপনি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছেন!  তার উপর কোন লাজুকতা নেই। একদম শহুরে মেয়েদের মতো।
-আসলে আমার এক আপা আছে যে আমায় শুদ্ধ ভাষা শিখিয়েছেন। বই পড়া শিখিয়েছেন। আমার এক বান্ধবী আছে ঝুনু সেও আমার মতো। আমরা দুজন দুজনের সাথে সবসময় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি। কিন্তু আপনি শহুরে মানুষ আপনাকে দেখেই আমার মুখ দিয়ে কেবল শুদ্ধ ভাষা বের হচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত।
পড়াশুনা করেছেন স্কুলে?
না, এখান থেকে পাঁচ কিলো দূরে স্কুল । কে যায় সেখানে তাও ওপর কেউ  এখানে পড়াশোনা নিয়ে মাথা ঘামায় না।তাদের মতে এটা এক উটকো ঝামেলা।
-খুব দুঃখজনক ব্যাপার।
-হ্যা।  আপনি ফ্রেশ  হয়ে নেন। এই যে মগ আর বালতি।  ওহ ! আমাদের তো সাবান নেই।
আমি নিয়ে এসেছি। অয়ন ব্যাগ থেকে সদ্য কেনা সাবানটা বের করে দেখাল। এরপর আস্তে আস্তে হাতমুখ ধুয়ে এগিয়ে এলো৷ রিনির হঠাৎ মনে পড়ল তার হাত ভালো করে ধোঁয়া হয়নি। সে মাটিতে হাত ঘষে কিছুক্ষণ হাত কচলিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে নিল।এরপর নিজের ঘরে অয়ন এর সব ব্যাগ রেখে অয়নকে নিয়ে বাইরের ঘরে এলো।আমেনা বেগম ইতোমধ্যে মাছ কাটা শেষ করে ফেলেছেন। রিনি ভাত দে ওদেরকে। তোর ভাইজান এহুনি আইয়া পড়ব। রিনি একটা কাঁচের প্লেট নামাল। তাদের এ একটাই আছে।সবুজ মিয়া  শহর থেকে এটা এনেছে।রিনি প্লেট, গ্লাস ধুয়ে রাখার সাথে সাথে অয়নকে নিয়ে বাপে রান্না ঘরে ঢুকলো। শুনছ রিনির মা এ পোলা কয় কি? রিনির মা উৎসুক দৃষ্টি তে চেয়ে আছে। কি কয়?
কয় আজগা কষ্ট কইরা আমরা যা খামু তাই যেন তারে দেওয়া ওয়। বিশেষ কিছু যেন না করি। কাইল সহালে হে বাজার কইরা আনব ।
রিনি প্লেট এ ভাত তুলতে বললো তা উনি তো ঠিকই বলেছেন। আমরা যা খাই তা কি আর তিনি খেতে পারবেন। বরং তিনি টাকা দিয়ে বাজার করলে উনার খাওয়ার কোনো অসুবিধা হবে না।
-আপনি বেশ বুদ্ধিমতি।
-আসলে আমরা তিনবেলা ভাত খেতে পারি না। এক দুবেলা খাই তাও আবার পেয়াজ,পোড়া শুটকি দিয়ে। এসব দিয়ে তো আর আপনি খেতে পারবেন না। কিন্তু আজ আপনার ভাগ্য ভালো। ভাইজানে আজ  হাঁস এনেছিল তাই মা রেঁধেছে।
– আপনার কথা শুনে আমার দুঃখ হচ্ছে। আমি বড় হয়েছি বিলাসীতার মধ্য দিয়ে। অভাব কি কখনো বুঝিনি। যা চেয়েছি তা না চাইতেই পেয়েছি। আমি আমার জায়গায় থেকে জানতাম না, আমি যা না চাইতেই পেয়েছি তা কিছু মানুষের অনেক শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে পেতে হয়।  এসব আমি রিসার্চ করতে গিয়ে জানতে পেরেছি। আমার খুব খারাপ লাগে।
রিনির মা এতক্ষণ সংকোচে ছিলেন কিন্তু অয়নের কথা শুনে সংকোচ চলে গিয়েছে।তাই এবার সহজ গলায় বললেন বাবা তুমি ঐ পিড়িটাতে বও।
অয়ন পিড়ি টেনে বসলো। তার পাশে বাপে মাদুর পেতে বসেছেন। রিনি অয়নের প্লেট এ নিঃসংকোচে হাঁসের তরকারি তুলে দিল। অথচ বেচারী জানে বড় লোকেরা অনেক রকম খাবার খান কিন্তু এ মুহুর্তে তার মাথায় এসব আসছে না। তার কাছে তো এটাই পরম সুখাদ্য। বাপের প্লেট এ শুরুতেই শুকনো দুটা মরিচ আর পোড়া শুটকি  দিল। তা দেখে অয়ন বললো আমায় ও দিয়েই দিতেন। খুব করে খেয়ে উঠে পরতাম।
রিনি মুখ ফিরিয়ে বললো এটাও আপনি অ্যাডভেন্জার হিসেবে নিতেন তাই না??
অয়ন রিনির মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটা কি বিদ্রুপের সুরে বলেছে?  হঠাৎ যেন সামনের  কুপির শিখাটা কেঁপে উঠল।
পেছনে পায়ের ভারী আওয়াজ দরজার কাছে এসে হালকা করে থেমে গেল। রিনির দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো ভাইজান বিস্ময় নিয়ে এদিকে চেয়ে আছে। চেহারায় বোকা বোকা ভাব। তাই দেখে রিনি ফিক করে হেসে দিল। তার হাসির শব্দে অয়ন আর বাপ মুখ তোলে রিনির দিকে তাকাল। ভাইয়া এদিকে আইও।ওখানে দাঁড়াইয়া আছো যে। ভাইজান ইতস্তত করে বাপের পাশে বসলো। রিনি আঙুল দিয়ে অয়নকে দেখিয়ে বললো, এ বাবু শহরের। আমাদের এখানে থাকবে কিছুদিন। কাজে এসেছেন কাজ শেষ করে চলে যাবেন।
অয়ন ভাইজান এর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো, আমি আপনাদের  এখানে ঝামেলা করব কিছুদিন। দয়া,করে…
আহ বাপ থামো। রিনির মা ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠলেন। তুমি বারবার এক কথাই কইতাছ। আমরারে খুব পর ভাবতাছ তুমি।
অয়ন লজ্জিত মুখ করে বললো আরে না না তা ভাবছি না। তাছাড়া আপনাদের আন্তরিকতা  আমায় আপন করে নিচ্ছে।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই রিনির চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে গেল। তার পাশে ঝুনু বসে আছে। এই উঠবি এত বেলা করে ঘুমাচ্ছিস যে,,,। তাড়াতাড়ি উঠ এক জায়গায় যাব।
কই যাব??
পড়ে বলবো, যা আগে মুখ ধুয়ে আয় দেখিনি।
রিনি বারান্দার কোণে রাখা বালতির পানি দিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে, লেবুর ডাল দিয়ে খুব মতন দাঁত ঘষে কুলি করল। এরপর ঘরে ফিরে এলো। বিছানায় বসে ঝুনু পা দুলাচ্ছিল ছেলেমানুষ এর মতো। এই রিনি তাড়াতাড়ি কর না
যাবি কই বলবি তো?
ওহ হো সবুর করো বাপু। নাও মাথা বাঁধ।
রিনি বিছানার পাশ থেকে আয়নাটা উঠিয়ে নিজের দিকে ফিরে ঝুনুর হাতে ধরিয়ে দিল। এরপর চিরুনি দিয়ে মাঝখানে সোজা সিঁথি টানছে। এমন সময় অয়ন এসে এ ঘরে ঢুকলো। কারো এতো ছোট আয়না থাকতে পারে সে জানত না। কৌতুহল চেপে জিজ্ঞেস করলো কোথাও যাচ্ছেন?
হে, এই বান্ধবীর সাথে বের হচ্ছি।
উনি কি আপনার সেই বান্ধবী?
জ্বি। এই হলো ঝুনু। আচ্ছা আমায় দিয়ে কি আপনার কোনো দরকার আছে?
না আমি এখন বের হব।  আপনার ভাইজান বাজারে গিয়েছেন। তা আমিই  যেতে চেয়েছিলাম। উনি শুধু শুধু কষ্ট করলেন।
ভাইজান ভালো করেছে। আচ্ছা আমরা এবার যাই। ঝুনু চল।।
ঝুনু ছেলেটার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করছে না দেখে রিনি খানিক অবাক হয়ে ঝুনুকে জিজ্ঞেস করলো কিরে তুই তো ছেলেটা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলি না?
কি জিজ্ঞেস করব??
বারে তুই তাকে চিনতি নাকি?
আরে আমারতো ঘরে ঢুকেই খালাম্মার সাথে কথা হয়েছে। তিনিই তো আমায় সব বললেন।
ও,তাই বল। আচ্ছা আমরা এবার কোথায় যাব?
” ন ঘাটাইল ” পাড়া পেরিয়ে আঁড়বোলার জঙ্গল। ওখানে যাব। ওখানে যে পুকুরপাড়টা আছে সেখানে ইয়া বড় বড় দুটা আম গাছ। জানিস তো..!
আঁড়বোলার জঙ্গল!  রিনি মুখ হাঁ করে ঝুনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঝুনু তার এ অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করল। আরে বাবা এত বড় করে মুখ হা করিস না। মশা এবার ঢুকলে হবে তোর সপ্তম মশা ভক্ষণ।
-এতো দূর যাব৷ মা জানতে পারলে গলা কেটে ফেলবে।
-যখন ব্যাগ ভর্তি করে আম আনবি তখনি বুঝি তিনি তাই করবেন!
-ব্যাগ ভর্তি আম আনতে পারব তার নিশ্চয়তা কি?
– আঁড়বোলার জঙ্গলে ভুতের ভয়ে সহজে কেউ ঢুকে না। আর সেখানে অনেক পুরোনো গাছ-গাছালি। তুই জানিস না ! পুকুর পাড়ের দুটো গাছেই প্রচুর আম হয়। আর ওখানে কেউ যায়ও না,  আমগুলো অযথা পঁচে পঁচে নিচে পড়ে কেউ খাওয়ার নেই।
-ঐ জঙ্গুলে ফাঁকা পথে বিপদ হতে পারে…!
-যাবি না তাহলে তুই?
-রিনি কিছুক্ষণ ভাবলো,  তারপর বললো ঠিক আছে,  চল যাই, খুব মজা হবে।
– “ন ঘাটাইল ” পাড়া যেখানে শেষ হয়েছে, তারপর থেকেই গভীর বন। জায়গাটি লোকালয় হতে অনেক দূরে। ন ঘাটাইল পাড়ার শেষে লোকালয়ের কোন আভাস নেই। পাক্কা ২০ মিনিট হাঁটার পর আঁড়বোলার জঙ্গল। সেখানে পৌঁছে তারা দেখল গাছে অনেক আম আছে বটে তবে তা অনেক উঁচুতে। ঝুনু দেরী না করে দ্রুত গাছে উঠতে লাগল। রিনি গাছের নিচে পড়ে থাকা একটা আম ছিলিয়ে মুখে দিল। এক কামড় দিয়েই উপরে ঝুনুর দিকে তাকিয়ে বললো এই দ্যাখ দিকি খেয়ে,কি মিষ্টি !
আমি আরো আগে খেয়েছি একবার। জামি আমগুলো খেতে খুব মিষ্টি। এই নে আরেকটা। এই বলে ঝুনু উপর থেকে আরেকটা আম নিচে ফেললো। আর সে আরেকটা আম ছিলিয়ে মুখে পুরতে লাগল। সন্দেশ, মিটাই কিনে পরিতৃপ্ত হওয়ার কোন সুযোগ ওদের কখনই ছিলো না। পৃথিবীর অসংখ্য সম্পদের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তি মালিকানাহীন এ ফল বিধাতা দরিদ্র ঘরের মানুষদের প্রতি করুণা করে দান করেছেন।
ঝুনু বাজারের দুটা ব্যাগ এনেছে। রিনি সেই ব্যাগগুলোতে উপর থেকে ফেলা আমগুলো ভরছিল। হঠাৎ ঝুনু বললো এই রে বৃষ্টি আসবে।
ঝটপট নেমে আয় ঝুনু ঢের হয়েছে। ঝুনু পড়িমরি করে দ্রুত নামলো। এরপর হঠাৎ চারদিক অন্ধকার করে ঝড় এল। একেবারে হঠাৎ ঝড়ের এ আগমন তাদের ভড়কে দিল। দুজনই ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রাণপণ ছুটল। ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ তীব্রভাবে নাকে ঠেকছে। একটু পরই বড় বড় ফোঁটায় চড়বড় করে গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। ঝড় বাড়তে শুরু করল। রিনি আর ঝুনু দ্রুত বড় মতো একটা গাছে আশ্রয় নিল। ঝুনু এখন সত্যিই ভয় পাচ্ছে পাছে রিনি বকা দেয় তাই প্রকাশ করে সাহস পাচ্ছে না। রিনি উসখুস করে বললো খুব যে বৃষ্টি এলো মা চিন্তা করবে।
এ বৃষ্টি আর কতক্ষণ থাকবে এই ধরে গেল বলে।
চারধারে শুধু বৃষ্টি পড়ার হুস্- স্- স্ একঘেয়ে শব্দ। মাঝে মাঝে গুম – ম – ম চাপা ধ্বনি। দুজনই জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের একমাথা থেকে তীব্র  আলে বিকট শব্দ করে  আরেক মাথার দিকে ছুটে গেল। শীতে রিনির ঠকঠক করে দাঁতে দাঁত লাগছিলো। ঝুনু তা টের পেয়ে রিনিকে তার দিকে টেনে নিল। রিনি পরম ভালবাসার শেষ আশ্রয় পেয়ে ঝুনুর বুকে মুখ লুকালো। ঝুনুর রিনির এ প্রতিক্রিয়া এমন পরিবেশ এ দেখে তার নিজের ও গলা ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসছিল।
ঝড়- বৃষ্টি খানিক বাদেই থেমে গেল। রিনি উঠোনে জমে যাওয়া বৃষ্টির পানিতে ছপ্ ছপ্ শব্দ করে বারান্দায় দাঁড়াতেই আমেনা  বেগ বলে উঠলেন ওমা আমার কি হইব, এযে  ভিইজ্জে শেষ।
 রিনি আমের ব্যাগটা বারন্দায় ঢেলে দিলো।
– এতো আম ! কই থাইকা আনলি?
-হাছা কথা কইলে তুমি রাগ করবার পার। তাই কইতাম না।
রিনির একথাটা শুনে মায়ের আদ্র মন আবার তেতে গেল। কি ! তুই  কি কইলি ?
রিনি ভিজে শরীর এ তার ঘরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ল ঐ ঘরে অয়ন থাকে। সে ঘুরে যাওয়ার পরপরই অয়ন হালকা গলায় বলে উঠল আপনার একি হাল হয়েছে। তাড়াতাড়ি শুকনো কাপড় পড়ুন নয়ত ঠান্ডা লাগবে।
-আপনার কাজ কেমন হলো?
-ভালো, আপনি পরে কথা বলবেন, এখন বরং যান, আগে ফ্রেশ হয়ে নিন।
-রিনি মাথা নেড়ে ঘরে ফিরে এলো। ভিজে কাপড় বদলাতে বদলাতে মার গুনগুন করে গাওয়া গান শুনতে পেল –
আর কে আছে আমার ৷ এ দুঃখ পাথারে কেবা হবে কর্ণধার৷৷
রিনি শাড়ি পাল্টে রান্না ঘরে ঢুকলো। প্লেট এ ঠান্ডা ভাত চাপা। আরেকটা বাটিতে দু’টুকরো মাংস আর অনেকখানি ঝোল। গপগপ করে তাই তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছিল। অনেকক্ষণ চেপে রাখা ক্ষিধে হঠাৎ যেন হিংস্র হয়ে উঠল।
অয়ন রিনির তক্তপোশ এর উপর সারি সারি বই থেকে একটা বই টেনে বের করল। “পোকামাকড়ের ঘরবসতি” সেলিনা হুসেনের। প্রথম পৃষ্ঠার উপর দিকে গুটিগুটি করে লেখা দুঃখ হচ্ছে হিংস্র শকুনের মতো। অয়ন এর চোখ আটকে গেছে এ লেখাটায়। মেয়েটার কি তবে অনেক দুঃখ। কিন্তু এতো সুন্দর একটা মেয়ের কেন এতো দুঃখ থাকবে। নাকি তার ঐ দুঃখের কারণ তার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে৷ এযে একদম খাঁটি  সোনার প্রতিমা। ওর চোখ দুটি উচ্ছলতায় ভরপুর। তাকালে মনে হয় হাজারটা প্রশ্নের উওর পাওয়ার আকুলতা ওর চোখে। যখন ঠোঁট নেড়ে কথা বলে তখন মনে হয় এই বুঝি দুঃখের কলতান গাইছে। চিবুকের গঠন ভঙ্গিটিসুন্দর,কেমন যেন আদুরে।  কাল রাতে কুপির আলোয় চূর্ণ কুন্তল দু এক গাছা কানের পাশে এসে যখন  পড়েছিল তখন হিঙ্গুল রংয়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এক মায়াবী ঘোরে  ফেলেছিল। এ রাঙা প্রতিমাই বটে। আজ যদি সে শহুরে আবহে থাকতো তবে হয়ত ওমন করে সুন্দর টুকু চোখে পড়ত না।
বাইরে বৃষ্টি শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রোদের দেখা পাওয়া গেছে। কে বলবে একটু আগেই দিনটি ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল। মা বারান্দায় বসে আম কাটছে। রিনি মাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলো।পথে আসতেই সখা আপাকে দেখা গেল। কলসি হাতে নদীর ঘাটে যাচ্ছে। রিনিকে দেখতে পেয়েই তার দিকে এগিয়ে এলো।
রিনি শুনছস নাকি ঝুনুর কথা?
-কি কথা?
-আজকা ঝুনুরে দেখবার আইব।
-কেডা??
-কেডা আবার অপর পইক্ষ।
-সখা আপা আমি তোমার কোন কথা বুঝতাছিনা।
হায়রে গাঁধি ওর বিয়ার আলাপ চলতাছে। আজকা ছেরার বাড়ি থাইকা মানুষ আইব।
-কি কও এইতা। আর ঝুনুতো আমারে কিছু কইছে না।
-ও জানতনা। ওর কাছে গোপন রাইখাই করা হইতাছিল কিন্তু বাড়ির হৈচৈ দেইখা এহন হে টের পাইয়া গেছে।
রিনি চাপা স্বরে বলে উঠল ঝুনুর বিয়ে! সে ব্যগ্র হরিণীর মতো ঝুনুর বাড়ির দিকে ছুটছে। পথিমধ্যে মানুষ জন তার এ দৌড় দেখে মতিভ্রম হয়েছে বলে ধরে নিল।সে এক দৌড়ে ঝুনুর ঘরে এসে ঢুকল। ঝুনু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে। তার পিঠ কান্নার দমকে নামছে, উঠছে। রিনি আলতো করে তার পিঠে হাত রাখল। এতো দিনের সম্পর্কে চেনা স্নেহের হাতখানি কার তা ধরতে তার বেগ পেতে হল না। রিনি হাত ধরে টেনে তাকে উঠে বসাল। ঝুনুর চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে৷ অনেকক্ষণ ধরে কাঁদার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ঝুনু রিনির হাতটা তার দুহাতের মধ্যে চেপে ধরে রেখেছে। দুজনই নির্বাক। কারো মুখে কোন কথা নেই। হঠাৎ ঝুনুর মা ঘরে ঢুকে আঙুল দিয়ে ইশারা করল রিনিকে তার সাথে যাওয়ার জন্য। রিনি তাঁর পিছু পিছু অন্য ঘরে গিয়ে দাঁড়াল৷ রিনির মাথায় হাত রেখে বললেন  মাইয়া তুমি একটু ঝুনুরে বুঝাইবা। তুমি বুঝাইলে হে বুঝব ৷ আইবুড়ো তো আর কম হইছে না৷ লোকে আমরারে দেইখা ছি ছি করে। এহন একটা ভালা ছেরা পাইছি৷ তুমি তো বুঝতাছই। একটু যদি বুঝাইয়া কইতা..!
রিনি এখানে আর কি বলবে। তার তো বলার কিছু নেই।সে মাথা নেড়ে ঝুনুর ঘরে চলে এলো। এরপর খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললো – আজকের সকালটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে, আজকের দুপুর টাও, আজকের রাতটাও। রিনি খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আবার বলতে লাগল – আমরা গরীব অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে। আমাদের কোন সখ নেই, বিলাসিতা নেই। কোন রকম দিন গুজরান করাই এখানের কাজ। আর সেখানে বসে আমরা স্বপ্ন দেখেছি। আশা করেছি উন্নত জীবনের। কিন্তু তা কি আর হওয়ার। ভাগ্য যে আমাদের খিঁচিয়ে বেড়ায়। তার উপর হলাম মেয়ে আজ যদি ছেলে হতাম তবে স্বাচ্ছন্দ্যে এ গাঁ ছেড়ে তুই আর আমি শহরে যেতে পারতাম। তারপর ঠিক একটা ব্যবস্থা করে নিতাম।কিন্তু মেয়ে বলে পারছিনা। আবার একেবারে ই যে ছেড়ে দিয়েছি তাও নয়। কিন্তু আজ এ ঘটনার পর কিছু চিন্তা করা দুর্ভেদ্য হয়ে যাবে। তুই তো কাল চলে যাবি?
ঝুনু কাঁপা গলায় বললো – মানে?
আজ রাতেই তোর বিয়ে। রাতে বর এখানে থেকে কাল সকালে তোকে সাথে করে নিয়ে যাবে।। কে বলেছে এসব।
-আমি জানি।
-ওরাতো আমায় দেখেনি হুট করে বিয়ে হয়ে যাবে?
-ওদের বিশ্বস্ত কেউ একজন তোকে দেখে ওদের খবর দিয়েছে এখন ওরা এসে পছন্দ করলে আজই বিয়ে।
-ঝুনু রিনির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল – আমি চলে গেলে তোর  কি খুব খারাপ লাগবে??   তুই কি খুব কাঁদবি?.
-রিনির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা, দু ফুঁটা, তিন ফোঁটা জল। এরপর অজস্র জলের কণা বের হতে শুরু করল।তুই চলে গেলে আমার পুরো পৃথিবী ই ফাঁকা হয়ে যাবে। তুই জানিস না তোকে দিনে একবার ও না দেখে থাকতে পারি না। তবে এ প্রশ্ন কেন? আমি জানি না তুই চলে গেলে আমি এ গাঁয়ে থাকব কি করে, জানি না..!
ঝুনু রিনির মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো থাম.. থাম.৷ আমায় আর কষ্ট দিস না। রিনি ঝুনুর হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল৷ তুই চলে যাচ্ছিস রিনি??
হ্যা, শুন কোন রাত্রে যদি আমার কথা মনে পড়ে তবে ভেবে নিস আমিও তোর কথা মনে পড়ে কাঁদছি। তারপর তোর এ হাত দিয়ে আমার চোখের জল মুছে দিস।
-রাতে আসবি না?
-না।
সকালে?-?
-কালকের সকালটা না,,  শুধু কালকের  সকালটা না আমার কাল থেকে প্রতি টি সকালই হবে রং, গন্ধহীন।
রিনি বড় বড় পা ফেলে তাদের ঘরে এসে দাঁড়াল। বারান্দায় আমেনা বেগম,সবুজ মিয়া  আর ঝুনুর বাপ বসে গল্প করছে। রিনির চোখের জল তখুনি শুকায়নি। মা মেয়ের ব্যাথা বুঝতে পেরে বাকি সবাইকে বলল চুপ থাকতে। সে তাদের পাশ কাটিয়ে মার ঘরে ঢুকল। দরজা টা খানিক ভিজিয়ে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল সে নিজেও জানেনা। এরপর ঘুম ভাঙল যখন বাপের ডাকে তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবু ডুবু করছে। কিরে খাইবি না? কহন থেইকা যে ঘুমাইতাছস। তোর মায়ে ঝুনুরার বাড়ি গেছে। যাইবার সময় কইয়া গেছে তোর খাওয়ার পর তোরে যেন দিয়া আই।
-তোমার দিয়া আওন লাগদ না। আমি যাইতাম না।
-ওমা তোর সখীর যে বিয়া। ওগোর মাইয়া খুব মনে ধরছে। তুই তোর হাতে সাজাইবিনা তারে। রিনি চোয়াল শক্ত করে বললো- না।
আইচ্ছা যা। এহন ভাত খা গা।
রিনি দেখল  মা বোয়াল মাছ ভুনা, পাট শাক ভুনা আর মুরগির মাংস রেঁধেছে।  কিন্তু এসব কোন খাবারই এখন তাকে আকর্ষণ করছে না। কাছের মসজিদ থেকে আজান এর শব্দ আসছে। রিনি খানিকটা সংকোচ নিয়ে অয়নের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। অয়ন ল্যাপটপে জরুরি কাজ করছিল। হঠাৎ দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে অয়ন তাকিয়েই খানিকটা অবাক হল। রিনির চোখ মুখে গাঢ় বিষাদের চাপ। অয়ন আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে আপনার?  এমন দেখাচ্ছে কেন, এখানে এসে বসুন।
রিনি খাটের এক মাথায় বসতে বসতে বলল আজ আমার একমাত্র সাথীর বিয়ে।
-কার ঐ ঝুনুর বুঝি?
-রিনি ইষৎ মাথা নেড়ে হ্যা বললো।
-কিন্তু সকালেও তো আপনারা একসাথে ঘুরতে গিয়েছিলেন।
-তখন আমরা কেউ এসব জানতাম না।
-বুঝলাম। কিন্তু আপনি মন খারাপ করে বসে আছেন কেন। আপনার তো খুশি হওয়ার কথা। নিজ হাতে সাজিয়ে দেয়ার কথা আর আপনি এভাবে…
-আমি পারবনা।ও আমায় রেখে চলে যাবে এটা মানতে পারছিনা।
-আপনি কি তাকে তার বাবা মায়ের চেয়ে বেশি ভালবাসেন। তাদের নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে কিন্তু তারাতো আপনার মতো..
-আমি ওকে অনেক বেশি ভালবাসি।
-ওহ,আজই বুঝি বিয়ে?
-হুমম।
-আচ্ছা বুঝতে পারছি আপনার খুব মন খারাপ। চলুন মন ভাল করি। আমার এখানে অনেক গান আর নাটক আছে কোনটা দেখবেন?।
-নাটক! এখানে কি করে থাকবে? তাছাড়া এটা কি?
-এটার নাম ল্যাপটপ। এটি একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র।
-এটাতে নাটক দেখা যায় কি করে?
-দেখাচ্ছি এই দেখেন..
অয়ন একটা হাসির নাটক বের করে দিল। রিনির তো হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে তার মনের সূক্ষ বেদনা টুকু চোখ মুখে ফুঠে উঠেছে।অয়নের ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সব বেদনা থেকে রিনিকে আড়াল করে নিতে।
রিনি অন্ধকারে মায়ের ঘরে বসে আছে। বাইরে জোৎস্নার মায়াময় আলোয় উঠোনে বসে বাপে বাঁশি বাজাচ্ছে। সে বাঁশির সুর চারপাশকে আরো বেদনাতুর করে তুলছে। একঘেয়ে ভাবে বাঁশি বাজাতে বাজাতে একসময় সেটা থেমে গেল৷ ঘরের দিকে একটা আলো এগিয়ে আসতে দেখে রিনি এলোমেলো শাড়ি ঠিক করতে গিয়ে ঠের পেল সে এতক্ষণ যাবৎ কেঁদে শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ফেলেছে। মা যখন কুপির আলো নিয়ে ঘরে ঢুকল ততক্ষণে সে কটকটে শুকনো চোখে মায়ের দিকে তাকাল। মা খুশিতে রিনির দিকে এগিয়ে এসে বলতে শুরু করল – হ্যারে জানছ, ঝুনুর জামাই কি কি আনছে। দুইডা শাড়ি, একজোড়া বার্মিজ জুতা,ইয়া বড় পাওডারের বোতল,কাজল আর ঠোঁট ও যে কিতা তোরা দেছ না এইতা।
-মা আমি তুমারে কিছু জিগাইছি। হুদাই প্যাচাল পারতাছ।
রিনির মা পরম উৎসাহে বলতে গিয়ে হঠাৎ বাধা পেয়ে খানিক বিব্রত হলেন। তাই নিজেকে সামলাতে রান্নাঘর এর দিকে পা বাড়ালেন। রিনি একটা কুপি ধরিয়ে কুপির আলোয় তার অর্ধেক শেষ হওয়া গল্পটা কাঁপা কাঁপা হাতে লেখতে শুরু করল।
এ গল্পের মূল চরিত্র একটা অসুস্থ ছোট মেয়ে। যে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণে। আর মা আশার আলো নিয়ে মেয়ের ছটফটানি দেখে। বাবা অনেক রাতে গাঁজা খেয়ে বাড়ি ফিরে। রিনি এখন গল্পটা কে একটা জটিল জায়গায় এসে দাঁড় করিয়েছে। বাবা মেয়েটার গাঁয়ে যখন হাত তুলতে গেল তখন সে তার ছোট শক্তিহীন হাতে হালকা প্রতিবাদ করল। এতে ও যখন কোন লাভ হলো না তখন মেয়েটি বরফ শীতল চোখে বাবার দিকে তাকাল। এযেন সম্মোহনের দৃষ্টি। বাবা মেয়ের শীতল চোখ দেখতে পেয়ে সে অনুতপ্ততায় নুইয়ে এলো। ব্যস এরপর আর রিনি লিখতে পারছে না। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কুপিটা নিভিয়ে এঘরের যে জায়গাটায় রান্নাঘর থেকে আসা কুপির আলো পড়েছে সেখানে পিঁড়ি টেনে বসে রইল অনেক্ষণ। মা উনুনে পাতিল বসাতে গিয়ে চোখ পড়ল রিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তখন মা আচমকা কেঁপে উঠলেন। রিনির দিকে প্রায় ছুটে এসে গাঁয়ে হাত রাখতেই টের পেলেন গাঁ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
ভোরবেলা যখন রিনির ঘুম ভাঙলো তখন আমেনা বেগম নামাজ পড়ছিলেন। রিনি এক দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে আছে। মা দোয়া শেষ করতেই রিনি মাকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন মা আমার ঝুনু কই? মা আমার ঝুনু কই? ইস্ কি স্বার্থপর। স্বার্থপর কথাটা কান্নার দমকে মুখ দিয়ে বের হলো।
-রিনি মাগো ঠান্ডা হও। ওমন কইরা কাইন্দ না অমঙ্গল হইব।
অমঙ্গল!  আর কি হইবার বাকি আছে মা? মা ঐ মেঘের তুলোর মতন সাদা বরফ আমার বুকে চাইপা ধরো…
রিনির কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে বাপ আর ভাইজান ছুটে এলো৷ ভাইজান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে কখনো এভাবে এর আগে রিনিকে কাঁদতে দেখেনি।
রিনি যখন খানিক সামলে নিল তখন অয়ন এলো। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখল। না গাঁ এখন ঠান্ডা। জ্বর নেই।
-এই নেন এ ঔষুধগুলো ভাত খাবারের পর খেয়ে নিবেন, কেমন?
-আচ্ছা
-আপনার লেখা গল্পগুলো পড়তে চাই দিবেন?
রিনি প্রথম এ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর অল্প মাথা নেড়ে বলল দাঁড়ান দিচ্ছি।
এরপর খাটের নিচের ব্যাগ থেকে দুটা খাতা তার হাতে তুলে দিতে দিতে বললো এখানে দুটা উপন্যাস আছে। আরেকটা লিখছি। কিন্তু শেষ করেতে পারছি না।
-শেষ করে ফেলেন। লেখাগুলো পড়ে যদি মানসম্মত মনে হয় তবে আমি এর ছাপানোর ব্যবস্থা করব। আপনি রাজি?
-রিনি এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব এ ভারী অবাক। আপনি ছাপাবেন? আপনি ছাপাতে পারবেন?
-কেন পারব না! অবশ্যই পারব।
– রিনির চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার বই ছাপিয়ে দিবে, এযে সাক্ষাৎ দেবদূত। ওহ আজ যদি রিনি জানত।
রিনির আজ চতুর্থ দিন। এই চার দিনে সে একবারও বাইরে যায় নি। পাশের ঘরে বাপে আর ভাইজান এর কথা হচ্ছে রিনির এ অবস্থা নিয়ে। তাদের ধারণা রিনির বিয়ে দিয়ে দিলে আবার সে স্বাভাবিক হবে। রিনি শূন্য খাতা নিয়ে বসে আছে। কিছু লিখতে পারছে না। এমন সময় অয়ন এসে ঘরে ঢুকলো। রিনির দুটা উপন্যাস পড়েই সে দারুণ মুগ্ধ। তার ধারণা এ বইগুলো প্রচুর জনপ্রিয়তা পাবে। তাই সে ঢাকা ফিরেই যেভাবে সম্ভব সেভাবেই ছাপাবে। রিনির একথাগুলো শুনা মাত্র কি জানি কি হল। সে একের পর এক বাক্য সাজিয়ে গল্পটাকে শেষ দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। একসময় সে লেখাটা শেষ করেও ফেলল৷ এবার সে নিজেই অবাক৷ দেরী না করে খাতাটা নিয়ে অয়ন এর ঘরে ঢুকল। রিনির মুখে এখন আত্মবিশ্বাস এর অটল ভাব। এরপর দুজনের নানা কথার ছলে খানি সময় কাটিয়ে দিল। রাতের বেলা উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে রিনির মনে হল অয়ন এক রহস্যময় মানব৷ ঐ চার দেয়ালের জগতটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে সে।
ঘরে ফিরে নতুন আরেকটা গল্পে হাত দিতেই অয়ন পেছনে এসে দাঁড়াল। অয়নের চোখ মুখ ভয়ংকর রকমের লাল। রিনি আতঁকে উঠে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে আপনার? আপনাকে এমন লাগছে কেন?
অয়ন সে প্রশ্ন এ পাওা না দিয়ে বললো I need you Rini
রিনি এর বাংলা জানে।সে এর অর্থ বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়াল। অয়ন তখন বের হয়ে যেতে যেতে আস্তে করে আবারো বলল I need you Rini.
রিনি এবার নিজের মনের সাথে বুঝাপড়া করতে লাগল। অয়ন ছেলে হিসেবে খুব ভালো। কিন্ত তাদের মধ্যে তো আকাশ পাতাল ফারাক। দুজন বড় হয়েছে দুজায়গায়। সুতরাং চলার পথে বারবার ই হোঁচট খেতে হবে। অয়ন হয়তো স্রেফ আবেগ এর বসে এসব কথা বলছে কিন্তু যখন চলার পথে হিমশিম খাবে তখন আর কিছু করার থাকবে না। সুতরাং এ নিয়ে আর ভেবে কাজ নেই। রিনি আবার লেখায় মন দিল।
পরদিন সকালে  অয়ন ব্যাগ গুছাচ্ছে আবার মাসেক খানিক পরে আসবে। কাজ এখনো বাকি। এমন সময় রিনি তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। রিনিকে দেখতে পেয়ে অয়ন কৌতুহল চোখে তাকাল।
অয়ন সাহেব আমি লিখতে পারছি না। কাল সারারাত আমি এক লাইন ও লিখতে পারি নি। আপনি পাশে না থাকলে আমি লিখতে পারব না।
রিনির শেষ কথাটি অয়নের কানে পৌঁছায় নি, ভাইজানের আর্তচিৎকারের কারণে। রিনি অয়ন দুজনই  ভাইজানের দিকে ছুটে গেল। ভাইজান  রিনিকে  জড়িয়ে ধরে, রিনিরে,,ঝুনু মইরা গেছে।। ওরে জ্বর এ লইয়া গেছে গা।
– কি!!না ভাইজান না। তুমি কি কও এইতা।
-ঠিক কইতাছি আমি।
-না তুমি ভুল হুনছ।
-নারে বইন।
রিনি কিছু না বলেই দিলো দৌড়। পাগলের মত  সে ছুটছে। নিজের ঘর ফেলে ছুটছে, ঝিনাই নদী পেছনে ফেলে ছুটছে। যেখানে সে আর রিনি অনেক সকাল আর বিকাল কাটিয়েছে সেই আড়বোলা জঙ্গল ফেলে ছুটছে। যেখানে ঝড়, বৃষ্টির ভয়াবহ তান্ডবে সে মুখ লুকিয়ে পরম আশ্রয় পেয়েছিল ঝুনুর বুকে। তাকে পাগলের মত ছুটতে দেখে, তার পেছন পেছন অয়ন ও ছুটছে। ছুটতে ছুটতে রিনি আর অয়ন ঝুনুদের বাড়ীর উঠোনে এসে দাড়ালো। উঠান ভর্তি লোকজন। বারান্দায় ঝুনুকে রাখা হয়েছে।  শিয়রের পাশে বসে চিৎকার করে কাঁদছে ঝুনুর মা। একটা সবুজ ছাদর দিয়ে ঝুনুর মুখ ঢাকা। রিনিকে দেখেই ঝুনুর মা, ঢুকরে কেদে উঠলেন, ও ও রিনিরে….! তুই আইছস? আমার রিনি আমারে ফালাইয়া কই গেলোরে…!
রিনি ঝুনুর মাথার কাছে হাটু গেড়ে বসলো । শোকে সে পাথর হয়ে গেছে। গত কয়েক দিনের কান্নাটা যেনো হঠাৎ জমাট বেঁধে গেছে। থর থর করে তার হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতে ছাদরটা সরিয়ে ঝুনুর মুখের দিকে তাকালো। ঝুনু যেনো ঘুমিয়ে আছে। মুখে স্নিগ্ধ হাসি, গালো কালো তিলটা চিক চিক করছে । মনে হলো ঝুনুর ঠোঁট নড়ছে। সে যেনো বলছে, রিনি আড়বোলার জঙ্গলে যাবি না আজ ?
লেখক পরিচিতি : আফসারা জাহিন আঁকা কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। জন্ম নেত্রকোণার আটাপাড়ায়।  ছবি আঁকা, গান, নাচের পাশাপাশি লেখালেখির খুব শখ। তার বড় মামা প্রফেসর মোশারফ হোসেন খুব ভালো লিখতেন, লিখেন ছোট মামা কামরুল হাসানও। বলতে গেলে লিখালিখি তার পারিবারিক ঐতিহ্য। গেলো বছর গল্প লিখে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র ময়মনসিংহ থেকে সে পুরষ্কার জিতেছে।
অবসর পেলেই সে লিখতে বসে। মা করুনা ও খালামনি কানন তার লিখার উৎসাহের মূলমন্ত্র।  লিখার প্রথম অনুপ্রেরণা তার বাবা।  অনেক বছর আগে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। চলে গেছেন বড় মামা মোশারফ হোসেনও। ইতোমধ্য তার  গোটা দশেক গল্প ও দুটো উপন্যাস প্রকাশের অপেক্ষায়। আঁড়বোলার জঙ্গল তার প্রথম প্রকাশিত গল্প। গল্পটি বাবা রুকন উদ্দীন আহমদ ও বড় মামার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
………………………………………..
#অনিন্দ্যবাংলা #অনিন্দ্যমিন্টু