“বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বিভিন্ন জনজাতির আত্মপরিচয়” শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
স্থান: সিডিআই মিলনায়তন, ভাটিকাশর, ময়মনসিংহ।
১৫ জুন ২০২৫ (রবিবার) ময়মনসিংহের ভাটিকাশর সিডিআই মিলনায়তনে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বিভিন্ন জনজাতির আত্মপরিচয়” শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেন “ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় কমিটি, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে বিভিন্ন জনজাতির বসবাস। বাংলাদেশে “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ (সংশোধিত-২০১৬) আইনে সরকার কর্তৃক গেজেটেড ৫০টি জনজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসরত যে কয়েকটি জনজাতি বসবাস করে তার অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যাতিত সমতল অঞ্চলে বসবাস করে। উত্তরবঙ্গ ব্যাতিত ঢাকা-ময়মনসিংহ-সিলেট বিভাগের সমতল অঞ্চলে বসবাসরত ২২টি জনজাতির ৪২টি উপজেলা নিয়ে ১৯৭৭ সালের ১৫ জুন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন জনজাতি’র বৃহত্তম জাতীয় সামাজিক সংগঠন “ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন” । আজ ১৫ জুন ২০২৫ সাল রবিবার এই সংগঠনের ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও জনজাতির আত্মপরিচয়” শীর্ষক আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়। উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন, বিশিষ্ট কবি, গবেষক, অনুবাদক অধ্যক্ষ শাসসুল ফয়েজ।
অন্যান্যের মধ্যে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন কবি মোস্তফা তারেক, কবি আরাাত রিলকে, সংগঠনের সাংগঠনিক সেক্রেটারী বিন্যামিন আরেং, কেন্দ্রীয় কমিটির যুব বিষয়ক সেক্রেটারী তুরুস দাংগো, সংগঠনের দূর্গাপুর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান গিলবার্ট চিছাম, ফুলপুর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান নিখিল বিশ্বাস, সখিপুর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান মানিক বর্মন, নকলা উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান সুবাস চন্দ্র বিশ্বাস, নকলা উপজেলা শাখার ভাইস-চেয়ারম্যান দিগন্ত কুমার বিশ্বাস। ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান জনাব সুবাস চন্দ্র বর্মন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন এর কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারী জেনারেল জনাব বিপুল হাজং।
কবি শামসুল ফয়েজ বলেন, “আজ আমি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। তিনি একজন সৈনিক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন রাষ্ট্রনায়ক, যিনি "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" নামক একটি উদার, শক্তিশালী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ঐতিহাসিক ঘোষণা, “আমি মেজর জিয়া বলছি, আমি বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি”। এটি ছিল এক অনন্য সাহসিকতার প্রতীক। সেই ঘোষণার মাধ্যমেই মুক্তিকামী জনতার মনোবল আরও দৃঢ় হয়। তিনি শুধু একজন ঘোষক ছিলেন না, ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা, এক বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল এক দুর্যোগপীড়িত, বিভ্রান্ত জাতি। এই সময়েই শহীদ জিয়া জাতিকে একটি নতুন আত্মপরিচয়ের ভিত্তি দেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। তিনি বলেন, আমাদের পরিচয় কেবল ভাষাভিত্তিক নয়; আমাদের পরিচয় ভূখন্ড, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্মিলন। এই দর্শনই আজ লাখো মানুষের হৃদয়ে বাংলাদেশকে ভালোবাসার এক চেতনায় রূপ দিয়েছে।”
কবি মোস্তফা তারেক বলেন, “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ মানে কোনো নির্দিষ্ট দলের রাজনীতি নয়। এটি একটি দর্শন, একটি চেতনা, যেখানে স্থান পেয়েছে দেশের মাটি, মানুষ, আকাশ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতীয় ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসা। শহীদ জিয়া চেয়েছিলেন, দেশের প্রত্যেক নাগরিক হবে আত্মনির্ভরশীল, উদ্যমী এবং স্বাধীনচেতা। তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন “বাঁচতে হলে দেশের জন্য কিছু করতে হবে” এই মূল্যবোধ।
তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির রূপকার, আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পেয়েছিল একটি নতুন দিগন্তের দেখা। যেখানে উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও দেশের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল অঙ্গীকারের শপথ।
আমরা যারা আজ তার আদর্শে বিশ্বাস করি, আমাদের দায়িত্ব। এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে যুগোপযোগী করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, একটি আত্মমর্যাদাশীল, উন্নত ও সম্মানিত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। শহীদ জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকবেন আমাদের চেতনায়, আমাদের সংগ্রামে, আমাদের প্রেরণায়।”
কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সেক্রেটারী বিন্যামিন আরেং বলেন, “ প্রতিটি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অস্বিত্ব, আত্মপরিচয় এবং ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অবদান এবং এই ভূখন্ডে বহুজাতির মানুষের বসবাস, সেই সাথে বহুসাংস্কৃতি রয়েছে। প্রতিটি জনজাতির সংস্কৃতিক বৈশিষ্টই অনন্য। সেজন্য প্রতিটি জনজাতির বাংলাদেশী হিসেবে সম্মানজনক স্থান, আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় রয়েছে।
তিনি শুধু যুদ্ধ করেননি, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে সংবিধান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও জাতীয় দর্শনের ভিত্তি দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন জাতির মূল শক্তি আসে মাটি ও মানুষের ঐক্য থেকে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি জন্ম দিয়েছেন এক নতুন আত্মপরিচয়ের ভিত্তি। তার নাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।”
সখিপুর উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান মানিক বর্মন বলেন, “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সকল জাতিগোষ্ঠীর একটি অভিন্ন ছায়াবৃক্ষ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শুধু একটি রাজনৈতিক মতবাদ নয়, এটি একটি জাতীয় দর্শন যেখানে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সব ধর্ম, এবং বাঙালি, হাজং, গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, মনিপুরি, খাসিয়া, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইনসহ সব জনজাতি একসাথে একটি পরিচয়ে পরিচিত আমরা সবাই বাংলাদেশী।”
নকলা উপজেলা শাখার চেয়ারম্যান সুবাস চন্দ্র বিশ্বাস তার বক্তব্যে বলেন, “শহীদ জিয়া বলেছিলেন, “জাতি কোনো একটি ভাষা বা একটি জাতির একাধিপত্য নয়, জাতি হলো রাষ্ট্রভূক্ত সকল জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত পরিচয়।” এই চেতনায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠে জনজাতির আত্মপরিচয়ের রক্ষাকবচ, যেখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা ও ঐতিহ্যকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সমান মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল।
কেন্দ্রীয় কমিটির যুব বিষয়ক সেক্রেটারী তুরুস দাংগো বলেন, “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাংলাদেশের সকল জনজাতির আত্মপরিচয় এবং সকল বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যের মধ্যে ঐক্য। বাংলাদেশের মানচিত্রের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে আছে স্মরনাতীত কাল ধরে বসবাসরত বিভিন্ন জনজাতি ও জনজাতির জীবন বৈচিত্র্য। তারা এ দেশের ভূমিপুত্র। এ দেশের মাটি, বন, নদী ও পাহাড়ের সাথে তাদের আত্মার সম্পর্ক। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, গান, নাচ, উৎসব সবই বাংলাদেশের সংস্কৃতির গর্ব। কিন্তু বারবার তারা পরিচয় সংকটে পড়েছে। কখনো "অবাঙালি" বলে হেয় করা হয়েছে, কখনো "ভিন্নজাতি" বলে উপেক্ষা করা হয়েছে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এই সংকটের উত্তর দেয়। “তোমরা আলাদা নও, তোমরা এই দেশেরই সন্তান। তোমাদের পরিচয় তোমরা বাংলাদেশী, তোমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ।”
নকলা উপজেলা শাখার ভাইস-চেয়ারম্যান দিগন্ত কুমার বিশ্বাস বলেন, “আজকের দায়: শহীদ জিয়ার দর্শন বাস্তবায়ন। আজ যখন বৈষম্য, অবহেলা ও সাংস্কৃতিক বিলুপ্তির শঙ্কা বাড়ছে, তখন আমাদের দরকার শহীদ জিয়ার পথ দেখানো সেই জাতীয় ঐক্যের দর্শন। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, সকল জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার থাকবে। উন্নয়নের নামে কারও ভূমি ও পরিচয় হরণ করা হবে না। শিক্ষা, প্রশাসন ও সংস্কৃতিতে জনজাতির অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রাষ্ট্র তার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে ভালবাসতে পারে না, সে কখনোই শক্তিশালী ও মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে না।
আজ আমরা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সেই বাংলাদেশ গড়তে চাই। যেখানে "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" শুধু কাগজে কলমে নয়, বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হবে। যেখানে হাজং, গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, রাখাইন সবাই গর্ব করে বলতে পারে: “আমরা এই বাংলাদেশেরই সন্তান। আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।”
সভায় বক্তারা আরও উল্লেখ করেন, আজকের বাংলাদেশে জনজাতির আত্মপরিচয় রক্ষা, ভূমির অধিকার, মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কার্যক্রমে কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শহীদ জিয়ার “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ”-এর চেতনা পুনরুজ্জীবিত করা অত্যন্ত জরুরি।
সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান বাবু সুবাস চন্দ্র বর্মন বলেন, “শহীদ জিয়ার জাতীয়তাবাদ আমাদের বলে এই দেশের প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিই বাংলাদেশের পরিচয়। এই পরিচয়ের ভিত্তিতেই গড়ে উঠুক একটি মর্যাদাশীল, বৈচিত্র্যভিত্তিক বাংলাদেশ।”
অনুষ্ঠানে ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন এর কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারী জেনারেল বিপুল হাজং এর সঞ্চালনায় দেশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আগত সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।